পার্থ সরকারহাওর প্রধান এলাকা হওয়ায় সুনামগঞ্জ জেলার সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতি তথা আর্থ সামাজিক অবস্থা এখানে বেশ নাজুক। এখানকার প্রায় ৩০ লাখ লোকের ভেতর বিরাট সংখ্যক দরিদ্র ও অতিদরিদ্র। ৬ মাস পানির নিচে থাকে বেশিরভাগ কৃষি জমি, তার উপর আছে আগাম বন্যা। মূলত এক ফসলী জমি। গো-খাদ্যের সংকটের কারণে এখানে গবাদি পশু পালন সহজ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুসারে গড়ে বাংলাদেশের ২৮ ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। তবে এদের ভেতর সুনামগঞ্জের পরিসংখ্যানটা বেশি ভয়ংকর, প্রায় ৪৪ শতাংশ শিশু এখানে অপুষ্টির শিকার।
Advertisement
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মাছিমপুর গ্রামে স্বামী ও দুই ছেলেমেয়েসহ বসবাস করেন রাবেয়া খাতুন। রাবেয়া খেয়াল করলেন, বড় ছেলেটির মতো তার ৮ মাস বয়সী মেয়েটিরও স্বাস্থ্য বেশ ভঙ্গুর এবং ওজন কম। চিন্তিত রাবেয়া এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে মাছিমপুর সুরমা কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের (সিএসজি) কথা জানতে পারেন। কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ জানায়, শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাভাবিক খাবারও তাকে দিতে হয়। কারণ এ সময়ে শিশুর শরীরের চাহিদা শুধু বুকের দুধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয় না। কমিউনিটি ক্লিনিকে রাবেয়ার মেয়ের ওজন ও উচ্চতা মাপাসহ অন্যান্য তথ্য নেওয়া হয় এবং ছবি ও কার্ড দেখিয়ে বুঝিয়ে বলা হয় ৬ মাসের বেশি বয়সী শিশুর কেন বাড়তি খাবার প্রয়োজন।
এখন শিশুটির বয়স ১ বছর। শিশুর স্বাস্থ্যের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না জানতে চাইলে রাবেয়া জানান, কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের সদস্যরা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি আগে জানতাম না যে, বাচ্চাকে ৬ মাসের পর থেকেই বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হবে। এখন আমি জানি যে, কেন আর কী ধরনের খাবার আমার শিশুকে দিতে হবে। আমার মেয়ের স্বাস্থ্য এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছে।
রাবেয়া খাতুনের মতো বাংলাদেশের লাখ লাখ প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নে ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনার পাশাপাশি দরিদ্র, লিঙ্গ বৈষম্য এবং প্রান্তিকীকরণ কমাতেও এটিকে জরুরি বলে মনে করে আন্তর্জাতিক এই উন্নয়ন সংস্থাটি।
Advertisement
দেশের পুষ্টি পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সংস্থাটি প্রমাণভিত্তিক উদ্ভাবনী এবং টেকসই মডেল তৈরিতে কাজ করছে। মডেলগুলো হলো– ১. কমিউনিটি সাপোর্ট সিস্টেমকে শক্তিশালীকরণ (সিএমএসএস- সিএসজি এবং সিজি মডেল) এবং ২. পুষ্টির জন্য বহুখাতভিত্তিক কার্যক্রম (উপজেলা পুষ্টি সমন্বয় মডেল, যাকে ইউএনসিসি বলা হয়)। বাংলাদেশ সরকার এই মডেলগুলোকে অনুমোদন ও গ্রহণ করেছে।
কেয়ার বাংলাদেশ পরিচালিত গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিটিভিত্তিক পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হলো- সমষ্টি, এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন সাপোর্ট অ্যাকটিভিটি নিউট্রিশন অ্যাট দ্য সেন্টার, হোমগ্রোন, কেয়ার-জিএসকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভ ফেজ ৩, জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন, আইএমএনসিএস, ইন্টিগ্রেটেড কন্টিনিউয়াম অব কোয়ালিটি অব ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ কেয়ার ইত্যাদি।
কেয়ার প্রান্তিক এবং দরিদ্র লোকদের একত্রিত করে তাদের চাহিদাগুলোকে চিহ্নিত করে। এরপর কর্মসংস্থান, জননীতি এবং উন্নয়ন অনুশীলনকে প্রভাবিত করতে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। জুলাই ২০১৭-২০১৮ সালের জুনের মধ্যে, কেয়ার ৬৬ টি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৬০% এরও বেশি এলাকায় কাজ করেছে এবং সরাসরি প্রায় ৮০ লাখ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় আড়াই কোটি সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছেছে।
প্রান্তিক মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে কেয়ার বাংলাদেশ সৌহার্দ্য-৩ এর নেতৃত্ব দিচ্ছে ১৩টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে। এর আগে সৌহার্দ্য-১ এবং সৌহার্দ্য-২ বাংলাদেশের কিছু দরিদ্র অঞ্চলে পুষ্টিহীনতা শতকরা ৫৬% থেকে ৪০% এ হ্রাস করার সফলতা অর্জন করেছে।
Advertisement
নিউট্রিশন অ্যাট দ্য সেন্টার ২০১৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত এবং পরবর্তিতে ২০২০ সাল পর্যন্ত কালক্টেভি ইমপ্যাক্ট ফর নউিট্রশিন নামে সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে অসংখ্য মা ও শিশুর পুষ্টি উন্নয়নে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখে। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পুষ্টি, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে সমন্বিত করে নারীদের (১৫-৪৯ বছর বয়সী) রক্তস্বল্পতা এবং শিশুদের (০-২৪ মাস বয়সী) খর্বায়ন ও রক্তস্বল্পতার হার কমানোর মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে কেয়ার বাংলাদেশ কাজ করছে।
বর্তমানে মা ও শিশুর পুষ্টি উন্নয়নে কেয়ার বাংলাদেশের ‘জানো’ প্রকল্পটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। রংপুর ও নীলফামারী জেলার অর্ন্তগত ৭ টি উপজেলায় মোট ৬৪ টি ইউনিয়নে ‘জানো’ প্রকল্পটি কাজ করছে। এই প্রকল্পের সার্বিক উদ্দেশ্য হলো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি নিরসন এবং গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারী এবং কিশোরীদের পুষ্টি চাহিদা নিরুপণ অবদান রাখা।
প্রকল্পটির (সেপ্টেম্বর ২০১৮-আগষ্ট ২০২৩) লক্ষ্য অপুষ্টি প্রতিরোধ, স্থানীয় পর্যায়ে পুষ্টিসেবা ও পুষ্টি গভর্ন্যান্সকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মা ও শিশুর পুষ্টি উন্নয়নে কার্যকরী ও সমন্বিত একটি মডেল বা রূপরেখা তৈরি করা যা এ প্রকল্পের কর্ম এলাকার ৫০% গর্ভবতী নারীদের রক্তস্বল্পতা এবং ২৭.৭% দুই বছরের নিচের বয়সী শিশুদের র্খবায়ন হ্রাস করার লক্ষ্যে কাজ করতে সক্ষম হবে। জানো বিভিন্ন কার্যক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রথম সারির কর্মী, কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের সদস্য, স্কুল, ৭৪ টি জেলা ও উপজেলা পুষ্টি সমন্বয় কমিটি এবং স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করে তাদের সামর্থ্য ও দক্ষতার বৃদ্ধি করা যাতে তারা প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরও উন্নত ও সমন্বিত সেবা প্রদান করতে পারে।
নিজেদের দীর্ঘ উপস্থিতি থেকে, দেশের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জীবনযাত্রায় টেকসই পরিবর্তনের জন্য সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে সংস্থাটি। এই দীর্ঘযাত্রায় কেয়ার বাংলাদেশ উপলব্ধি করেছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে তৃণমূল, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করাটাই সর্বোত্তম কৌশল।
কেএসকে/জেআইএম