দেশের উন্নয়ন কোন পথে? অর্থনীতির গতি কি স্বাভাবিক? আমাদের অর্থনীতি তো শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যাবে না? অর্থনীতির সূচকগুলো কি ইতিবাচক? এসব প্রশ্ন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতো আমারও। অর্থনীতির সূচকগুলো এখন যে জায়গায় অবস্থান করছে, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ছাত্র হিসেবে আমি শঙ্কিত না হয়ে পারি না!
Advertisement
দেশের অর্থনীতিবিদরা কি ভাবছেন বিরাজমান অর্থনীতি নিয়ে তা দেখা যাক- ক’দিন আগে রাজধানীর ধানমন্ডি সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ’ শীর্ষক এক আলোচনায় প্রতিষ্ঠানটি মন্তব্য করে বলেছে- অর্থনীতির আগামী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপগুলো পর্যাপ্ত নয়। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, রাজস্ব আহরণ ও আটকে পড়া ঋণ আদায়ে আরও নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, বর্তমান সংকট মধ্যমেয়াদি হলেও বর্তমান অবস্থায় চললে দেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটের দিকে যাবে! বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো না হলেও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে! তাই দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, শ্রীলঙ্কার মতো খাদে না পড়লেও দেশ অর্থনীতিতে ঝুঁকি রয়েছে। গণহারে খেলাপিদের সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, সাধারণ মানুষের বর্তমান কষ্টের কথা! তার মতে, দেশে আয়ের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি! অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বেশ উষ্মার সঙ্গেই বললেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিরাজমান বিদ্যুৎ সংকটে উদ্বিগ্ন অধ্যাপক ম তামিমও। তিনি বলেছেন, আমদানিনির্ভরতার কারণেই বিদ্যুতের বর্তমান সংকট। দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎ আনার জন্য এক সময় তেলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। পরামর্শ ছিল সেটাকে ৩-৫ বছর অবধি রাখা। অর্থনীতির সূচকগুলো এখন যে জায়গায় আছে, তাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অতটা খারাপ বলে মনে করছেন না বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ কেএএস মুরশিদ। তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ তিনিও দেখছেন। তার ভাষায়, ‘দেশ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির শিকার।’
Advertisement
বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরপরই মহামারি এসে উপস্থিত। গত দুই বছরে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেই ধাক্কা সামলে ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মহামারির মতো কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ লাগিয়ে দিল রাশিয়া। তাতে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হলো বিশ্ব বাণিজ্যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সাজানো ঘরও নড়ে উঠলো উপুর্যপরি দুই ঝড়ে।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছেছে দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল, চাল ও ডালের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। মহামারির ধাক্কা সামাল দেওয়ার পরপর আমদানি বৃদ্ধিতে স্বস্তি পাচ্ছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু সার্বিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন ডলারের দাম চড়তে শুরু করায় পণ্য আমদানিই এখন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিহাসের সর্বোচ্চে ঘাটতিতে পড়েছে। ডলারের দর হয়ে উঠেছে পাগলা ঘোড়া! ২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের মে- এই এক বছরে ডলারের বিপরীতে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মান হারিয়েছে টাকা।
এদিকে রফতানি বাড়লেও রেমিট্যান্সে টান পড়েছে। কিন্তু পণ্য আমদানি করতে গিয়ে ডলার বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক। তাতে চাপ পড়ছে রিজার্ভে। ভয়ের ক্ষেত্র আরও পোক্ত করেছে সাম্প্রতিককালে খাদে পড়া শ্রীলঙ্কা। ডলারের সংকটে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দক্ষিণ এশিয়ার নিকটবর্তী দেশটি নাম লিখিয়েছে ঋণখেলাপির খাতায়। মূল্যস্ফীতি আর অর্থনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি পাকিস্তানেও সরকার পতন হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিরাজমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে পণ্য মূল্যের দাবানল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোকেও পোড়াচ্ছে।
কয়েকদিন আগে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, সামনে দেশে অর্থনীতির জন্য বড় চাপ আসছে। মেগা বা বড় প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসছে, যা অর্থনীতির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
Advertisement
এবার আসি দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর সাম্প্রতিককালের উপাত্ত ও পরিসংখ্যান প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে প্রবাসীরা মোট ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। মে মাসের এই অংক আগের মাস এপ্রিলের চেয়েও ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ কম।
অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৯১৯ কোটি ৪৪ লাখ মার্কিন ডলার। আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় তা ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। দেশে জিডিপির ১২ শতাংশের মতো আসে প্রবাসে থাকা কর্মীদের পাঠানো অর্থ থেকে। দেশের বিদেশি মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় প্রধান উৎস এই রেমিট্যান্স। দেশে প্রবাসীদের আয় কমে গেলে রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকে।
যদিও সরকার এই ধাক্কা সামলে রেমিট্যান্স আয়ে গতি ফেরাতে নগদ প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থের উৎস প্রকাশের বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে। করোনার অতিমারির প্রথম বছরেও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) বড় উদ্বৃত্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল দেশ। কিন্তু দুই বছরের মাথায় তা ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঘাটতিতে পৌঁছেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১৬৫ কোটি ডলার। দেশের ইতিহাসে লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে এত বড় ঘাটতি আর কখনও হয়নি। কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি রফতানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয় ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না।
এই ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়! বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখানে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে ৬ হাজার ৮৬৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৪ হাজার ১১০ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়েছে, রফতানি থেকে আয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তাতে সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ১০ মাসের ঘাটতি তার চেয়ে প্রায় ৫৩ শতাংশ বেশি। গত ২৫ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতির পরিমাণ ছিল ৪২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ গত আগস্টে রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল।
লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে মূল্যস্ফীতির হার। সয়াবিন তেলের দাম ছাড়িয়েছে আকাশচুম্বী। এর প্রভাবে জুন মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা গত মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। সাধারণ মূল্যস্ফীতির হারও মে মাস থেকে বেড়েছে জুন মাসে। জুন মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, গত মে মাসে যা ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।
পরিসংখ্যানটি গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া। মে মাসের ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ তথ্যে এমনটা বলা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এর কারণ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। তা বন্ধ হলে সব স্বাভাবিক হবে। বিবিএস জানায়, খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়েছে, গত মাসে যা ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ মে মাসের তুলনায় জুন মাসে সব খাতেই মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী।
ক্রেতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার আশা ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অথচ বাজেট ঘোষণার পরই রেকর্ড হারে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত মে মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এর অর্থ হলো, ২০২১ সালের মে মাসে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের মে মাসে একই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৭ টাকা ৪২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এ মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর অর্থ হলো, ২০২১ সালের মে মাসে যে খাদ্যপণ্য বা খাবারের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, চলতি বছরের মে মাসে একই খাবারের জন্য ১০৮ টাকা ৩০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত ও খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। প্রসাধন সামগ্রী, জুতা, পরিধেয় বস্ত্র, বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি পণ্য, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, শিক্ষা উপকরণ এবং বিবিধসেবা খাতের মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এছাড়া জুলাই মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
দুই বছর আগে অতিমারি করোনা শুরু হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। বেশির ভাগ দেশে সংকুচিত হয় অর্থনীতি। এরপর ধীরে ধীরে তা ঘুরে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদরা ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনার আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সব ছক বদলে দিয়েছে গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে আবারও টালমাটাল করে দিয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউক্রেন রাশিয়া চলমান যুদ্ধের কারণে সামনের দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা মন্দাভাব আসতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে। এতে করে বাংলাদেশের রফতানি খাতে আবারও কালো মেঘ দেখছেন তারা। মন্দা নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরাও। তারা বলছেন, এর প্রভাবে এরই মধ্যে ইউরোপের বাজারে ২০ শতাংশ পোশাক পণ্যের আদেশ কমে গেছে।
বাংলাদেশে মোট পোশাক রফতানির ৫৬ শতাংশ যায় ইউরোপের দেশে। পোশাক খাতে মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে! নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ইউরোপে এরই মধ্যে মন্দাভাব শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে আমাদের পোশাক পণ্য পরবর্তী প্রান্তিকের জন্য প্রায় ২০ শতাংশ আদেশ (অর্ডার) কমে গেছে। পরিস্থিতি উত্তরণে দুটি চালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। গ্যাস সংকটের দ্রুত সমাধান করা এবং ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখা। রফতানি ধরে রাখতে হলে ডলার কেনাবেচার পার্থক্য সর্বোচ্চ ১ থেকে দেড় টাকার মধ্যে রাখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে জরুরি হস্তক্ষেপ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশ যখন ৩ শতাংশের কম হয়, তখন সে পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক মন্দা বলা যায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার মতে, প্রতি আট থেকে ১০ বছর অন্তর বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দেয়। বিশ্বমন্দা হলে সব দেশই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বড় অর্থনীতির দেশে মন্দা না হলেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এই অঞ্চলের অর্থনীতি মন্দার সম্ভাবনা কম। তবে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। তবে অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞায় পর পর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হলে তাকে মন্দা বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশিদের টাকার ‘পাহাড়’ জমেছে সুইস ব্যাংকে। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে মাত্র ১২ মাসে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ জমা করেছেন তারা। সব মিলিয়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে এখন বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৫ কোটি, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) গত ১৬ জুন ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২১’ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার এ উপাত্ত উঠে এসেছে।
দেশে যখন টাকা পাচার ঠেকানোর তোড়জোড়, তখন নজিরবিহীন গতিতে সুইস ব্যাংকে টাকা জমিয়েছেন বাংলাদেশিরা। গত এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ আগের বছরের ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ থেকে বেড়ে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়েছে।
দেশে লোডশেডিং এখন মাথাব্যথার আরেকটি কারণ। বিদ্যুৎ সংকট চলছে তা বিন্দুমাত্র মিথ্যা নয়! বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার মেগাওয়াট। তবে এখন ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশে ৭৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হওয়ায় পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি নয় লাখ হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রা ২৫ হাজার মেগাওয়াটকে ছাড়িয়ে গেছে! বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ৮ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানালেও বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। রাজধানীতে কম লোডশেডিং হলেও বাইরের জেলা শহর ও গ্রামে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাচ্ছে। তাহলে বিদ্যুতের এমন ঘাটতি বা সংকট কেন? সক্ষমতার নজির তো জনগণ দেখছে না!
কোনো দেশের বিনিয়োগ সক্ষমতার অন্যতম মাপকাঠি হলো সঞ্চয় জিডিপি অনুপাত। যে দেশের সঞ্চয় জিডিপি অনুপাত যত বেশি, সে দেশের বিনিয়োগ সক্ষমতাও শক্তিশালী। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে সঞ্চয় জিডিপির ন্যূনতম প্রত্যাশিত অনুপাত ৩২-৩৪ শতাংশ। তিন বছর আগেও দেশে এ অনুপাত ছিল প্রত্যাশিত মাত্রার কাছাকাছি। এরপর গত তিন বছরে জিডিপির আকার লাফিয়ে বাড়লেও সে অনুপাতে সঞ্চয় বাড়েনি। উল্টো গত অর্থবছরে সঞ্চয় জিডিপির অনুপাত আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে সঞ্চয় জিডিপি অনুপাত ছিল ৩১ দশমিক ১৪ শতাংশ। পরের অর্থবছরে এ অনুপাত কিছুটা বাড়লেও তারপর থেকে কমছে। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয় জিডিপির অনুপাত নেমে আসে ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে (২০২১-২২) দেশের সঞ্চয় জিডিপির অনুপাত নেমেছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশে।
বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে রক্ষায় রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি বিনীতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বময় শান্তি বিরাজ না করলে সব দেশই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে।
আশার কথা, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। দেশে ডলারের চাহিদা সামাল দিতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের সুফল মিলতে শুরু করেছে। কমছে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৭৩৮ কোটি ২৬ লাখ (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা, যা গত ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগের মাসে ৮২০ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। এর অর্থ এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ৮২ কোটি ডলার সাশ্রয় হয়েছে।
আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে এলসি খোলার পরিমাণ কমছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। আমদানি কমাতে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয় ১৭ এপ্রিল। ওইদিন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রফতানিমুখি শিল্প এবং কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। অতি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। চলমান জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সরকার একগুচ্ছ সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে বিদ্যুতের চাহিদা আয়ত্তে রাখতে অঞ্চলভেদে লোডশেডিং করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানি খরচ কমছে বলে আমিও মনে করি।
এছাড়া পদ্মা বহুমুখী সেতু, বরিশাল-ভোলা দীর্ঘপথের সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ বেশ কটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়েছে। মন্দার কবলে হয়তো পড়বে না বাংলাদেশ! তবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। অর্থনীতির সূচকগুলোর সাম্প্রতিক নিম্নমুখী প্রবণতা সে আভাসই দিচ্ছে। রফতানি আমদানি বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, প্রবাসী আয় ও জাতীয় সঞ্চয় কমে যাওয়া, বিদেশে অর্থপাচার বন্ধ না হওয়া, বিদেশি ব্যাংক দেশের ধনাঢ্য শ্রেণির অর্থ আমানত বৃদ্ধি, দেশের বাইরে আরেকটি দেশকে সেকেন্ড হোম বানানো, ঋণখেলাপি ও অর্থ কেলেংকারির সঙ্গে যুক্তদের বড় শাস্তি না দিয়ে তাদের জামাই আদর করা, বিদ্যুৎ ঘাটতির ভেলকিবাজি, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি প্রণোদনাপ্রাপ্তদের ভোগবিলাস এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অমনোযোগী, তাদের শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চনা ইত্যাদি দেশের সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য সুখকর নয়। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। বিশ্ব মোড়লদের নিষেধাজ্ঞা এবং যুদ্ধের মধ্যেও দেশপ্রেমিক ও যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক ভ্লাদিমির পুতিনের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় রাশিয়ার অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা।
আমাদের জন্যও তা অনুকরণীয় হতে পারে। অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্তভাবে অপচয় রোধ করে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে মানসম্পন্ন টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি দেশপ্রেমই পারে আমাদের শঙ্কামুক্ত করতে। নিকট অতীতে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা পেরেছি। আগামীতেও পারবো। ভাবতে হবে দেশটা আমাদের সবার।
লেখক: কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক।reporterpranab@gmail.com
এইচআর/ফারুক/জেআইএম