আইন-আদালত

‘খরচাপাতি’র জোরে আসামির হাতে যায় খাবার, বলা যায় কথাও

পারভীন আক্তার (৪৫)। ঢাকা মহানগর আদালতের হাজতখানার সামনে নারিকেল গাছের সামনে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে বসে আছেন। উদ্দেশ্য হাজতে থাকা তার ছেলেকে এই খাবার দেবেন। তার ছেলে সাব্বির হোসেন (২২) নারীঘটিত একটি মামলায় এক বছর ধরে কারাগারে আটক। প্রতি মাসে হাজিরার জন্য কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে আনা হয় আদালতে। এসময় পারভীন আক্তার ও তার স্বামী সালাম আসেন তাদের ছেলের সাথে দেখা করতে। ছেলের সাথে দেখা করতে ১৫০ টাকা দিয়ে নেন বিরিয়ানির প্যাকেট। কথা হয় ছেলের সাথে। এজন্য হাজতখানার পুলিশকে দিতে হয় ৩০০ টাকা খরচাপাতি।

Advertisement

খরচাপাতি ছাড়া খাবার দিতে দেয় না পুলিশ। কথাও বলতে দেয় না। তাই তারা বাধ্য হয়ে টাকা দেন হাজতখানার পুলিশকে।

সাব্বিরের মা পারভীন আক্তার বলেন, আমি মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করি। প্রতি মাসে ছেলের হাজিরার তারিখে আদালতে আসি। ছেলের জন্য ১৫০ টাকা দিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট কিনেছি। ছেলে বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করে। এই বিরিয়ানির প্যাকেট ছেলেকে দেওয়ার জন্য ৩০০ টাকা খরচাপাতি দিতে হয় এখানকার পুলিশকে। টাকা ছাড়া তারা খাবার দিতে দেয় না। টাকা না দিলে ছেলের সঙ্গে কথাও বলতে দেয় না। মানুষের বাসায় কাজ করে যে টাকা পাই সেটা দিয়ে নিজে চলাই কষ্টকর। এর মধ্যে প্রতি মাসে ছেলেকে দেখতে এসে টাকা দিতে হয় পুলিশকে।

সাব্বিরের বাবা সালাম বলেন, আমি রিকশা চালাই। ছেলেকে দেখার জন্য আমরা দুজন দারুসসালাম থেকে আদালতে আসি। আসা যাওয়া অনেক খরচ হয়ে যায়। এর মধ্যে ছেলকে খাবার কিনে দেই। তার চেয়ে দ্বিগুণ টাকা দিয়ে সেই খাবার ছেলেকে দিতে হয়। ছেলের সাথে কথা বলতে গেলে পুলিশকে আলাদা করে টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না আদালতে।

Advertisement

রিয়াজুল ইসলাম (৪০)। থাকেন ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুবাড্ডা পূর্ব পাড়ায়। হিরোইনসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার তার ভাই রানা (৩৮)। তারা দুজনই পরিবহন চালক। খবর পেয়ে পরদিন রানাকে দেখতে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালতে আসেন তার ভাই রিয়াজুল, মা লিলি ও বাবা জামাল। উদ্দেশ্য তার ভাইকে একনজর দেখবেন। কিন্তু রানার রিমান্ড না চাওয়ায় তাকে ওঠানো হয়নি আদালতে। সিজিএম আদালতের হাজতখানায় খবর নিয়ে জানতে পারেন তার ভাইকে আদালতে উঠানো হবে না। রিয়াজুল হাজতের সামনে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে বললেন আমার ভাই ভেতরে আছে। তার সাথে দেখা করতে হবে ও খাওয়ার দিতে হবে। পুলিশ সদস্য তাকে বললেন এজন্য এক হাজার লাগবে। এরপর পুলিশ সদস্য তার কাছ থেকে টাকা দিয়ে খাওয়ারসহ রিয়াজুল, তার মা ও বাবাকে হাজতের ভেতরে নিয়ে যান। হাজতের ভিতরে বেশকিছু সময় তারা গল্প করেন। এরপর তারা খাওয়ার দিয়ে হাজত থেকে চলে আসেন।

রিয়াজুল বলেন, আমার ভাই রানাকে হিরোইনসহ র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। আমরা তার সাথে দেখা করতে আদালতে আসি। তার রিমান্ড না চাওয়ায় আদালতে ওঠানো হয়নি। আমি তার সাথে দেখা করা ও খাওয়ার জন্য হাজতের সামনে থাকা এক পুলিশ সদস্যর সাথে কথা বলি। পুলিশ সদস্য আমার কাছে এক হাজার টাকা চাইলেন। টাকা দেওয়ার পর আমাদের হাজতের ভেতরে নিয়ে যায় পুলিশ। আমরা হাজতের ভেতরে রানার সাথে বেশকিছু সময় কথা বলি। এখানে টাকা ছাড়া তারা কিছু বুঝে না। মানবতার কোনো মূলায়নই নেই আদালতপাড়ায়।

রানার মা লিলি বলেন, ছেলেকে দেখার জন্য আদালতে ছুটে আসি। একশত টাকার বিরিয়ানি কিনে পুলিশকে এক হাজার টাকা দিয়ে সে খাবার ভেতরে পাঠাই। সেই সাথে আমরাও তার সাথে দেখা করি। টাকা দিলে আদালতে সবকিছুই হয়।

পারভীন আক্তার ও রানার মতো অনেক ভুক্তভোগীর পরিবার আসে ঢাকার আদালত পাড়ায়। উদ্দেশ্য তাদের প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করা। সাথে খাবারও দেওয়া। আদালত পাড়ায় কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য স্বজনদের সাথে দেখা করানো ও খাবার দেওয়ার বিনিময়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। টাকা না দিলে স্বজনদের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না। দিতে দেওয়া হয় না কোনো খাবার। যদিও আইনগতভাবে আদালতের অনুমতি ছাড়া আসামির সঙ্গে স্বজনদের দেখা করা ও বাইরের খাবার দেওয়ার নিয়ম নেই। এরপরও অনেকে আইনের বাইরে এসে স্বজনদের সাথে দেখা করছেন। খাবার দিচ্ছেন অনেকে। এতে লাভবান হচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্য।

Advertisement

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার আদালত পাড়ায় প্রতিদিন অসংখ্য ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা আসেন। উদ্দেশ্য তাদের প্রিয় মানুষকে একনজর দেখবেন আর কিছু খাবার কিনে দেবেন। তাদের অনেকেই জানেন না, খাবার দিতে কিংবা কথা বলতে আদালতের অনুমতির দরকার হয়। কিন্তু এতটুকু বোঝেন আদালতপাড়ায় টাকা খরচ করলে সবই সম্ভব। এখানে আসামিদের খাবার দেওয়ার জন্য দুই থেকে পাঁচশত টাকা নেন কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য। এছাড়া হাজতের ভেতরে আসামির সাক্ষাতের জন্য নেন এক থেকে দেড় হাজার টাকা। অনেকে স্বজনের সঙ্গে আদালতের ভেতরে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য নেন দুই থেকে পাঁচশত টাকা।

এছাড়া হলমার্ক ও ডেসটিনির মামলার আসামিদের যেদিন আদালতে হাজির করা হয় সেদিন অনেক অসাধু পুলিশ সদস্য ঈদ মনে করেন। তাদের সাথে থাকা পুলিশ সদস্যদের দেওয়া হয় এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা। খাবার ও সাক্ষাতের একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারলে দেওয়া হয় আরও বেশি টাকা। এছাড়া বড় মামলার আসামিদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই চিত্র।

আদালত চত্বরে অনেক অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করেছে অসাধু চক্র-তথ্যচিত্র জাগো নিউজ

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আদালত হলো মানুষের বিচার প্রাপ্তির সর্বশেষ স্থান। বিভিন্ন গবেষণায় আদালতের দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার বলেছেন, দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি আছে বলেই তিনি এসব কথা বলেছেন। বিচারাঙ্গনের সঙ্গে যারা জড়িত, সবারই দুর্নীতির বিষয়টি জানা। দুর্নীতির কারণে বিচারপ্রার্থীরা প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অবৈধ লেনদেনের কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বাড়ছে।

তিনি বলেন, বিচারাঙ্গনের মধ্যে একটা দুষ্টচক্র দাঁড়িয়ে গেছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। প্রধান বিচারপতি যদি দুর্নীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেন তাহলে দুর্নীতি অনেকটা কমে আসবে। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জাতীয় শুদ্ধাচার নীতি অনুযায়ী, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিত হালনাগাদ ও প্রকাশ করতে হবে। বিচার বিভাগের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করতে হবে। তাহলে দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসবে।

হাজিরার জন্য কিংবা গ্রেফতারের পর আদালতে তোলা আসামিদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই-ছবি জাগো নিউজ

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে আদালতপাড়ায় বকশিশের রেওয়াজ। ঘুস হিসেবে নয়, বকশিশ হিসেবে এটা প্রচলিত। খুশি হয়ে অনেকে বকশিশ দেন। চাপ প্রয়োগ করে যারা বকশিশ নেন তারা অন্যায় করেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মের বাইরে কেউ নয়। সবাইকে নিয়মের মধ্যে চলতে হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি জাফর হোসেন বলেন, অনৈতিক বিষয় কেউ কাজ করলে তার দায় তাকে নিতে হবে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে আমরা তা ক্ষতিয়ে দেখবো। যারা এ ধরনের অপরাধের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এভাবেই আসামিদের খাবার দেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন স্বজনরা-ছবি জাগো নিউজ

ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কোর্ট পরিদর্শক মতিউর রহমান বলেন, অনৈতিক কাজের সাথে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। খাবার নিয়ে যেসব পুলিশ সদস্য টাকা নেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, আদালতের দুর্নীতির বিষয়গুলো আমাদের কানে বার বার আসছে। অভিযানের পর কিছুদিন থেমে থাকে এগুলো। কদিন পর আবার শুরু হয় দুর্নীতি। আদালতে দুর্নীতি বিস্তার করার জন্য এক ধরনের চক্র রয়েছে। চক্ররা টাকা উঠানোর পর তা ভাগাভাগি করে নেয়। আদালত থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

আদালতে প্রিজন ভ্যানের পেছনেও স্বজনদের ছুটতে দেখা যায়-ছবি জাগো নিউজ

দেখা ও খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকলে কমবে দুর্নীতি

এ বিষয়ে আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা বলেন, আসামিদের হাজিরা থাকে তারা ভোরে গাড়িতে উঠে আদালতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। আবার যেতে হয় রাতের বেলায়। রাতের বেলায় গিয়ে তারা খাবার পায় না। মধ্যখানে আদালতের হাজতখানায় আসামিদের খাবারের ব্যবস্থাও নেই। আদালতে আসা আসামিদের খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকার কারণে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা টাকার বিনিময়ে খাবার দেন। বিধি মোতাবেক খাওয়া ও দেখা করার ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের দুর্নীতি অনেকটা কমে আসবে।

আইনজীবী ইব্রাহীম খলিল বলেন, আদালতের হাজতখানায় খাবার দেওয়ার জন্য গেটে থাকা পুলিশ সদস্যরা চার-পাঁচশত টাকা নেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি টাকা নেন। আদালত এলাকায় এটা প্রচলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ সদস্যরা আসামিদের স্বজন থেকে খাবার নিয়ে তাদের পোশাকের ভেতরে করে তা পৌঁছে দেন। অনেকে প্যাকেটে করে খাবার পৌঁছে দেন। আসামিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পরে ভাগাভাগি করেন। এছাড়া আসামিদের স্বজনদের দেখা করার জন্যও টাকা নেন। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনগত ব্যবস্থা না নিলে এদের দুর্নীতি কিছুতেই কমবে না।

আসামিদের দেখার জন্য গারদের পাশে ভিড় জমায় স্বজনরা-ছবি জাগো নিউজ

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জিএম মিজানুর রহমান বলেন, কারাগার থেকে প্রতিদিন শত শত আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এছাড়া যারা নতুন গ্রেফতার হয়েছেন তাদেরও আদালতে হাজির করা হয়। আদালতের হাজতখানায় আসামিদের খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। কারাগার থেকে যে খাবার দেওয়া হয় তা খেয়ে থাকতে হয় আসামিদের। আসামিদের আত্মীয়স্বজনরা খাবার দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। অস্থির হয়ে পড়েন তাদের দেখার জন্য।

এ সুযোগটি কাজে লাগান এক ধরনের সুবিধাবাদী পুলিশ সদস্য। তারা কিছু টাকার বিনিময়ে আসামিদের খাবার ব্যবস্থা করেন। দেখা করারও ব্যবস্থা করেন অসাধু পুলিশ সদস্যরা। আসামিদের যদি হাজতখানায় খাবারের ব্যবস্থা থাকে তাহলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। অন্যদিকে যারা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জেএ/এসএইচএস/জেআইএম