এনাম রাজু
Advertisement
‘যা কিছু ভালো, দেখায় আলো। তা নিয়ে লেখ, তাকে তুলে নাও পরম আদরে। বুক টান টান করে রাখো কবিতার চাদরে।’ সত্যি অসাধারণ এই পঙক্তিকে প্রকৃত লেখকরাই বুকে বেঁধে রাখেন। শুধু যে বুকে রাখে তা নয়। হৃদয়ে লালন করে আলো ও আঁধারের পথকে চিহ্নিত করে। সেই আলো-আঁধারি পথের বাঁকে বাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে জমা পড়ে শুদ্ধতা, সততা, সরলতা। মূলত যা কিছু মিথ্যা তার বিরুদ্ধে সত্যের জয়গান গাওয়ার এক শক্ত হাতিয়ারের নাম কবিতা। কবিতা কথা বলে মানুষের, কথা বলে সমাজের, কথা বলে মন্দের বিপরীতে। কখনো সে কথা কারো অন্তরে তোলে ব্যথা, কারো হৃদয়ে এনে দেয় ক্ষরণ। কেননা কবিতা প্রথমে পড়ে কবিকে তারপর তা নিজেকে বিলিয়ে দেয় পাঠকের দরবারে। এই লেখক ও পাঠক সামনাসামনি বসে কখনো কখনো কথা হয় কবিতা নিয়ে, জীবন নিয়ে, জীবিকা নিয়ে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই পাঠক লেখককে খুঁজে নেয় শব্দের বুননে কবিতার গঠন, পঠন-পাঠনে। তাই তো এক একটা কবিতা পাঠ করেই পাঠক একেকবার একেকভাবে কবিকে আবিষ্কার করে। পরে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নিয়ে কবিকে জীবিত রাখে হৃদয়ের বামে। আমিও পাঠক হয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কবিকে নিজের ভেতর লালন করি। পড়ি কবির লেখা নতুন নতুন বাক্যের খেলা। দেখি কবি কতটা এগিয়ে গেছেন শব্দের চাষে।
এই শব্দের চাষে কে কতটা এগিয়ে অথবা দশক নিয়ে মসকরা করা আমার কাজ নয়। কোনো কবিকে দশকের খাতায় লিপিবদ্ধ করে তাকে দেওয়ালে আটকে খাটলির চারপাশে ঘোরাতেও বসিনি। লিখতে বসেছি বহুমাত্রিক লেখক মামুন রশীদের কবিতা সম্পর্কে। তার কবিতায় বসবাস করে সময়ের রেখাচিত্র। তিনি পার্থক্য করেছেন ভালো-মন্দের, সাদা-কালোর। কবিতায় তুলে এনেছেন পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়। কখনো ছন্দে কখনো বা ছন্দের খোলস ছেড়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। কবিতায় তুলে ধরতে চেয়েছেন মানুষ ও মানবতা। লিখেছেন প্রকৃতির সকল রসদ নিয়ে। শিরোনামহীন একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘শ্মশান আর নদীর মধ্যে রয়েছে যেমন যোগসূত্রচুম্বনের আগে ও পরে রয়েছে যেভাবে আলাদা কাঁপনপরিত্যক্ত বাড়ির পেছনে আমাদের হৈ হুল্লোড়প্রাত্যহিক আড্ডা, যৌবনের কুমন্ত্রণা...’তার কবিতায় তুলে এনেছেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখের কথা। তার কাব্যে একই সাথে সমাজের নানা অবক্ষয়, শাসকগোষ্ঠীর ভালো-মন্দের নানা ফিরিস্তি। বিশেষ করে এ দেশের মাটি ও মানুষের সব প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত, লুকায়িত রূপের বর্ণনার চিত্র ফুটে উঠেছে।
তিনি কবিতার মাধ্যমে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সমাদৃত হয়েছেন। কারণ তার কবিতায় অবিমিশ্রভাবে মিশে গেছে বৃহত্তর মানব জীবনের ব্যথা-বেদনার জীবন দর্শন। তাই তো তার কবিতার ভাষা দোলা দেয় মননকে। তিনি লিখেছেন—‘ঘুমন্ত শহরকে আমি জাগতে দেখলাম। মৃত্তিকায় সহস্র ঊর্ণনাভ বিস্তার করেক্রুর হাসিতে প্রকাণ্ড ফনা তোলা কালো সাপ তার ধূসর হিংস্র জিহ্বা সরিয়েঝাঁপির ভেতরে ক্রমশ শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আজকের দিনে...’। পৃথিবীজুড়েই চলছে দখলের খেলা। এই অযাচিত মানচিত্র দখলের খেলায় মাতোয়ারা অধিকাংশ মানুষ। এই কুসংস্কার থেকে তথাকথিত সাহিত্যিক বোদ্ধারাও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এই খেলার কারণে প্রতিনিয়ত একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অন্যদিকে অপসংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে। এই খেলায় যেসব সাহিত্যিক জড়িত, তাদের অধিকাংশই লেখালেখির চেয়ে দলাদলির কাজে সক্রিয়। তেলবাজ এসব কবি ও সাহিত্যিকের কারণেই ধীরে ধীরে সাহিত্য জগৎ নিয়ে হাস্যরস চোখে পড়ে।
Advertisement
সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়ারা প্রতিনিয়ত শান্তিপ্রিয় মানুষের স্বর্গীয় শান্তি হরণ করে। পৃথিবীর এমন ভয়ংকর রূপ প্রকৃত কবিকে ভাবায়। মানবপ্রেমিক কবি কবিতার ভাষায় এসব নির্মমতা ফুটিয়ে তুলে ধরেন খুব নীরবে-নিভৃতে। বিশ্বজুড়ে যে অশান্তির খেলা চলছে তার ভয়াবহতার কথা, অস্থিরতার দৃশ্য কবিকে একাকিত্বে নিমজ্জিত করে। কবি তাই সর্বদা একাকী হন। কবি মামুন রশীদও সেই পথের পথিক। প্রতিটি মানুষের জীবনে একান্ত সঙ্গীর প্রয়োজন, যার সাথে সারাটি জীবন নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। একাকিত্ব মানুষকে নিস্ব আর নিঃশেষ করে দেয়। শত পাওয়ার মধ্যেও একাকী জীবনে একটি না পাওয়া থেকে যায়। কবির জীবনে এই অনুষঙ্গ যোগ করে সম্ভবত সুসাহিত্য। পরিবার, পরিজন ও বৈশ্বিক চাহিদা মূলত অন্যায়কে উস্কে দিচ্ছে। কবি তাই বড় একা হয়ে পড়েন। কবিতায় খোঁজেন একাকিত্ব মোচনের যাবতীয় রসদ। তার কবিতায় মানবজীবনে সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন—‘মানুষের ভীড়ে দাঁড়িয়ে যখনএকা—একা হয়ে যাই, তখন গাছেদেরমত চোখ কান বন্ধ করে দেই।আমার ভেতরে কোনো হাওয়া আসে না,বরং আমি একা হাওয়া করে যাই।’প্রেমের কবিতায় কবি মামুন রশীদের উজ্জ্বলতা চোখে পড়ার মতো। প্রেমের আলোমাখা সুখের পরশ কবিকে দোলায়িত করে। অস্থির রাখে প্রেমের নৌকায় বসে জনম পাড়ি দিতে। প্রেমই যে তার কাছে বৃহৎ চাহিদার চাদর। এ কারণেই হয়তো দুঃখের নদীতে বৈঠাহীন নৌকায় বসেও তিনি প্রেমকে উপজীব্য করে রচনা করেছেন তাঁর নকশিকাঁথা। হৃদয়ের বামে যে গভীর আকুলতা তারও গভীরে গিয়ে তিনি প্রণয়ের সমুদ্রে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে প্রেমিক হৃদয় যাপনে সজাগ জোছনা।
কবিতাকে তিনি প্রেম-প্রবাহের নদীমাতৃক করে তুলেছেন। তার কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার পরে মেঘ জমলে’র প্রতিটি কবিতায় ঘুরে ফিরে তাই হয়তো প্রেমই প্রকাশিত হয়েছে। কবির একমাত্র চাওয়া প্রেম। অভিমানের যাত্রা বিরতি দিয়ে, নীরবতা ভেঙে কবি তাই তো ঘুরে-ফিরে আসেন তারই আরাধ্য মানুষটির হৃদয়ের উঠানে। তাই তো প্রেমকে নিয়ে অনেক খেলা খেলেছেন কবিতায়। স্পর্শহীন প্রেম ছোঁয়াহীন ভালোবাসা কাছে না এসেও কাছে থাকার টান প্রেমের পোশাক পরে আজীবন বটগাছ হওয়ার বাসনা কায়াহীন মনন তার কবিতাকে করেছে রূপকথার দেশের রাজপুত্রের মতো। মানুষের মনে প্রেম জাগ্রত হলে যেভাবে মানুষ চৈতন্যহীন হয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন; তেমনই তার কবিতা পড়লে এরকম এক প্রেমিকের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন—‘দেখা হলে কী করবো? জড়িয়ে ধরবো?আরক্তিম হয়ে ওঠা গালে চুমু খাবো?সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে চোখে নির্লিপ্তমিলনের উদাসীনতা ছড়িয়ে দেবো?’
বহুমাত্রিক লেখক মামুন রশীদ সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে হাত রেখেছেন। কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, সমসাময়িক বিষয়ের ওপর কলাম লিখেও খ্যাতি অর্জনের পথে হেঁটে চলেছেন। তিনি সাহিত্যের মাঠে শুধু দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তা নয়। সংগঠন, সম্পাদনা বা তৈল মর্দনের পথ পরিহার করে সৃজনের পথে নিজের ভিত তৈরি করতে বদ্ধপরিকর। আমার বিশ্বাস প্রিয় লেখক মামুন রশীদ তার লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের আপনা ঘরে স্থায়ীভাবে বসতের স্বাক্ষর রাখবেন।
এসইউ/এমএস
Advertisement