সাফিয়া আক্তার বিথি (২৬)। রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা। ঢাকার আদালতে এসেছিলেন ভুল হওয়া নামের বানান সংশোধনের কাজে। তার শিক্ষা সনদের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের নামের বানানের মিল নেই। তিনি প্রথমে তিনশত টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প কেনেন। এরপর আদালত সংলগ্ন একটি কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে সংশোধনের বিবরণ উল্লেখ করে তা স্ট্যাম্পে প্রিন্ট করেন। তার পরিচিত এক আইনজীবীর মাধ্যমে হলফনামায় স্বাক্ষর নেন। এরপর তিনি নোটারি পাবলিকের সামনে হলফনামা দেন।
Advertisement
হলফনামাটি ঢাকা সিএমএম আদালতের তিন তলায় নেজারত শাখায় জমা দেন। নেজারত শাখা থেকে তাকে বলা হয় সংশ্লিষ্ট আদালতে যেতে। তাদের কথা অনুযায়ী তিনি সংশ্লিষ্ট আদালতে যান। আদালতে ডাকা হলো তাকে। বিচারকের সামনে তিনি তার সংশোধনের কারণ উল্লেখ করেন। বিচারককে দেখান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। বিচারক বলেন, ‘ঠিক আছে। আপনি নেজারত শাখা থেকে আপনার হলফনামাটি নিয়ে নিয়েন।’
এরপর বিথি চলে যান নেজারত শাখায়। সেখানে তাকে হলফনামা কাগজের একসেট ফটোকপি দিতে বললেন। ফটোকপি দেওয়ার পর নেজারতের এক কর্মচারী তার কাছে খরচাপাতি চাইলেন। খরচাপাতি ছাড়া হলফনামার নম্বর দেওয়া হবে না, এ-ও জানান। বিথি বাধ্য হয়ে নেজারতের ওই কর্মচারীকে ২০০ টাকা দেন।
সাফিয়া আক্তার বিথি বলেন, আদালত ন্যায় প্রতিষ্ঠার জায়গা। ম্যাজিস্ট্রেট কাগজ দেখে স্বাক্ষর করে দেন। কিন্তু নেজারত শাখায় কাগজ নেওয়ার জন্য গেলে সেখানে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। দিতে হচ্ছে টাকা। টাকা ছাড়া হলফনামার নম্বর দিতে চান না নেজারতের কর্মচারীরা।
Advertisement
সাইফুল আলম রাজ (৩৩)। পাসপোর্টের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের মিল না থাকায় তা সংশোধন করতে সাভার থেকে আসেন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালতে। তার বন্ধু খাদেমুল ইসলাম রয়েছেন আইন পেশায়। বন্ধুকে তিনি বিস্তারিত বললেন। আইনজীবী বন্ধু তাকে ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প কিনতে বলেন। এরপর খাদেমুলের চেম্বারে কম্পিউটারের মাধ্যমে বিস্তারিত লিখে স্ট্যাম্পে প্রিন্ট করেন। শনাক্তকারী হিসেবে খাদেমুল তাতে সই করেন। রাজকে তিনি নোটারি পাবলিকের সামনে হলফনামায় সই করে নিয়ে আসেন। এরপর সিজিএম আদালতের দ্বিতীয় তলায় নেজারত শাখায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন। এখানেও নেজারত থেকে বলায় হয় সংশ্লিষ্ট আদালতে যেতে।
সংশ্লিষ্ট আদালতে গেলে বিচারক তার কাছে সংশোধন করার কারণ জানতে চান। রাজ বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার নাম দেওয়া আছে ‘সাইফুল আলম রাজ’ আর পাসপোর্টে ‘সাইফুল আলম রাজা’। নামের শেষে একটা আকার বেশি পড়ে গেছে। বিচারক বললেন ঠিক আছে। এরপর নেজারত শাখায় হলফনামা আনতে যান রাজ। সেখানে এক কর্মচারী তার কাছে খরচাপাতি চান। রাজ বললেন, কীসের খরচাপাতি। আমি খরচাপাতি দেবো না। কর্মচারী বললেন খরচাপাতি ছাড়া আপনার হলফনামায় নম্বর দেওয়া হবে না। রাজ বিষয়টি তার বন্ধুকে জানান। বন্ধু বললেন এরা এমনই। টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। এরপর রাজ বাধ্য হয়ে কর্মচারীকে ২০০ টাকা দিয়ে হলফনামা নিয়ে চলে আসেন।
সাইফুল আলম রাজ বলেন, নাম সংশোধনের জন্য হলফনামা নিয়ম মেনে আদালতের নেজারত শাখায় জমা দেই। নেজারত শাখা থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয় আমার হলফনামার কাগজ। ম্যাজিস্ট্রেট কাগজ দেখে আমাকে ঠিক আছে বলেন। এরপর আমি নেজারত শাখায় আমার হলফনামা আনতে গেলে সেখানে তারা টাকা দাবি করেন। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে হলফনামা নিতে হলো। এই যদি হয় বিচারিক আদালতের অবস্থা তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে ন্যায় পাবো।
বিথি ও রাজের মতো বহু ন্যায়প্রত্যাশী মানুষ প্রতিদিন ঢাকার আদালতে আসেন বিভিন্ন ধরনের হলফনামার জন্য। বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা শিক্ষা সনদে ভুল সংশোধন বা তথ্য পরিবর্তনের জন্য। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হলফনামা দিতে হয়। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন তথ্যগত বিষয়ে হলফনামা চেয়ে থাকে। এর বাইরে আম-মোক্তারনামা, অংশীদারত্ব চুক্তি, ধর্মান্তরসহ নানা কারণে করতে হয় হলফনামা।
Advertisement
ভুল সংশোধনের হলফনামার ক্ষেত্রে ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে বিবরণসহ হলফনামা করতে হয়। একজন আইনজীবী হলফকারীকে শনাক্ত করে থাকেন। এরপর নোটারি পাবলিকের সামনে হলফনামা দেওয়ার পর তা জমা দিতে হয় আদালতের নেজারত শাখায়।
এ হলফনামা করতে এসে পড়তে হয় খরচাপাতির কবলে। খরচাপাতি ছাড়া হলফনামায় নম্বর দেওয়া হয় না। খরচাপাতির টাকা দিতে না চাইলে কখনো খারাপ আচরণও করেন তাদের সাথে। দায়িত্বে থাকা নাজিরের কাছে গিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। এতে অনেক আইনজীবীও হন হয়রানির শিকার। অথচ এসব অবৈধ খরচাপাতির কায়কারবার দেখার যেন কেউ নেই।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের তৃতীয় তলায় নেজারত শাখা। সেখানে ঢাকা মেট্রোপলিটন থানা এলাকার মানুষ সবসময়ই হলফনামা করতে আসেন। প্রতি কর্মদিবসে দুপুর ১টার মধ্যে হলফনামার কাগজ জমা দিতে হয়। হলফনামার কাগজ নেজারত শাখা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। ম্যাজিস্ট্রেট শুনানি শেষে পাঠিয়ে দেন নেজারত শাখায়। নেজারত শাখায় আসার পর সেখানে মাইনুল ও হুমায়ুন নামে দুই ব্যক্তি খরচাপাতি দাবি করেন। হুমায়ুন সিএমএম আদালতের লিফটম্যানের দায়িত্বে থাকলেও তিনি লিফটম্যানের কাজ না করে নেজারত শাখায় হলফনামার নম্বর দিয়ে টাকা ওঠান। মাইনুল আদালতের নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী নন। দুজনই টাকা তুলে জমা দেন সেখানকার কর্মকর্তা খালিদের কাছে। খালিদ তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাগাভাগি করেন। অন্যদিকে ঢাকার চিফ জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দ্বিতীয় তলায় নেজারত শাখা। সেখানে ঢাকা জেলার বাসিন্দারা হলফনামা করতে আসেন। সেখানেও টাকা ছাড়া দেওয়া হয় না হলফনামার নম্বর। তবে সিএমএম আদালতের নেজারত শাখা থেকে সিজিএম আদালতের নেজারত শাখায় জোর করে টাকা নেওয়ার চাহিদাটা অনেকটাই কম।
দুই জায়গায়ই খরচাপাতির পরিমাণ সর্বনিম্ন ১০০ টাকা। অনেকের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২০০ টাকাও। টাকা নেওয়ার প্রতিবাদ করলে কর্মচারীদের কাছ থেকে মেলে খারাপ আচরণ। নম্বর না দিয়ে রেখে দেওয়া হয় হলফনামাটি। নম্বর ছাড়া হলফনামা বৈধ হয় না। তাই বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে হলফনামার নম্বর নিতে হচ্ছে ভুক্তভোগী মানুষকে।
অভিযোগ পেলে ক্ষতিয়ে দেখবেন সংশ্লিষ্টরা
এ বিষয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের নাজির রেজওয়ান খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, হলফনামার নম্বর দিয়ে টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ, তা সত্য নয়। কেউ আমাদের এ বিষয়ে অভিযোগ দিলে তা ক্ষতিয়ে দেখবো।
ঢাকার চিফ জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালতের নাজির আরিফুর রহমান বলেন, সরকার আমাদের বেতন দিচ্ছেন। কেউ আমাদের খুশি করে হলফনামার বাবদ টাকা দিলে তা আমরা নেই। বাধ্যতামূলকভাবে কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয় না।
জড়িতদের আইনের আওতায় আনলে কমবে দুর্নীতি
সাবেক আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যারা এ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনলে আদালত অঙ্গন থেকে দুর্নীতি কমবে।
ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, আদালতের দুর্নীতির বিষয়গুলো আমাদের কানে বারবার আসে। অভিযানের পর কিছুদিন বন্ধ থাকে এগুলো। কদিন পর আবার শুরু হয়। আদালতে দুর্নীতি বিস্তারের জন্য এক ধরনের চক্র রয়েছে। এসব চক্র টাকা ওঠানোর পর তা ভাগাভাগি করে নেয়। আদালত থেকে দুর্নীতি দূর করতে ঢাকা আইনজীবী সমিতিকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যারা ম্যাজিস্ট্রিটির সঙ্গে জড়িত তাদের দুর্নীতির বিষয়ে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
নেজারত শাখায় হয়রানির শিকার হচ্ছে মানুষ-ছবি জাগো নিউজ
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে আদালতপাড়ায় বকশিশের রেওয়াজ চালু। আদালত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি বকশিশের কথা। ঘুস হিসেবে নয়, বকশিশ হিসেবে এটা প্রচলিত। তবে এই প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটা বেআইনি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিচার অঙ্গনের মধ্যে একটা দুষ্টচক্র দাঁড়িয়ে গেছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিলে তা অনেকটা কমে আসবে। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জাতীয় শুদ্ধাচার নীতি অনুযায়ী সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিতভাবে হালনাগাদ প্রকাশ করতে হবে। বিচার বিভাগের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করতে হবে। তাহলে দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসবে।
আইনজীবীদের ভাষ্য
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট নাজনীন আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, হলফনামায় ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর সম্পন্ন হওয়ার পর স্মারক নম্বর দেওয়ার সময় এক থেকে দুইশো টাকা নেজারত শাখায় দেওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। নেজারত শাখায় হলফনামা নেওয়ার সময় টাকা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ আইনে টাকা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। জিম্মি করে আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, হলফনামা স্বাক্ষরকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের টাকা নেওয়ার বিষয়টি অজানা। ম্যাজিস্ট্রেটের নাম ভাঙিয়ে নেজারত শাখা এক ধরনের চাঁদাবাজি করছে। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়কে অনুরোধ করছি।
হলফনামা করতে এসে পড়তে হয় খরচাপাতির কবলে-ছবি জাগো নিউজ
আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা বলেন, হলফনামার কাজটা একটা সিন্ডিকেট করে। টাকা ছাড়া হলফনামার নম্বর দেওয়া হয় না। টাকা না দিলে সেখানকার কর্মচারীরা খারাপ আচরণ করেন। সেখানকার কর্মচারীরা বিচারকের নাম ভাঙিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছেন। হলফনামার টাকা নেওয়ার কোনো বিধান আইনে নেই। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি।
আইনজীবী ফরিদ হোসেন বলেন, হলফনামার নম্বর দেওয়ার সময় নেজারত শাখা থেকে খরচাপাতির নামে টাকা চাওয়া হয়। টাকা না দিলে হলফনামার নম্বর দিতে চায় না। খরচাপাতির পরিমাণ কমপক্ষে এক থেকে দুইশো টাকা। এ টাকার জন্য কোনো রশিদও দেওয়া হয় না। নেজারত শাখার কর্মচারীরা খরচাপাতি জন্য এ টাকা নেন। টাকা না দিলে তারা খারাপ আচরণ করেন। আইনজীবী তোফায়েল হোসেন বলেন, নেজারত শাখা থেকে হলফনামার স্বারক নেওয়ার সময় টাকা দেওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। আইনের জায়গায় নেজারত শাখার কর্মচারীরা বেআইনি কাজ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি। জেএ/এমকেআর/এসএইচএস/জিকেএস