গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাষ্ট্রপতি যখন দেশের ত্রয়োদশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম ঘোষণা করলেন, তখন নিউজরুমে তোলপাড়। তার অতীত, তার জীবনী, তার প্রতিক্রিয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়।
Advertisement
২০১৭ সালে অবসর নেওয়ার পর থেকে তিনি একটু আড়ালেই ছিলেন। তাই তার বর্তমান অবস্থান জানা একটু কঠিন হয়। নানা জায়গায় ফোন করে একটা নাম্বার পেলেও সেই নাম্বার কেউ ধরছিল না। আমি সাবেক এক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে ফোন করতেই তিনি বললেন, আরে হাবিব তো আমার বন্ধু। ওনার কাছ থেকে নাম্বার নিলাম। জানতে চাইলাম, বাসা কোথায়? বললেন, ওয়ালসো টাওয়ার।
শুনেই লাফিয়ে উঠলাম। ফোনে না পেলেও বাসা যেহেতু আমাদের কাছাকাছি, দ্রুত টিম পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের টিম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লিফটের গোড়ায় তাকে পেয়ে গেল। এটিএন নিউজের সাথে চ্যানেল আইয়ের টিমও সেখানে পৌঁছাতে পেরেছিল। তিনি রমনা পার্কে হাঁটতে গিয়েছিলেন। তাই ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি আমাদের কাছেই প্রথম তার নিয়োগের খবর শুনলেন।
লিফটের সামনে দাঁড়িয়েই লম্বা প্রতিক্রিয়া দিলেন। বুঝলাম, তিনি কথা বলতে ভালোবাসেন। তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া শুনে আমার নিজের দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো। কাজী হাবিবুল আউয়ালের আগের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বরিশালের মানুষ। তার কথায়ও আঞ্চলিকতার টান ছিল। দিনের পর দিন আঞ্চলিক উচ্চারণের কথা শুনতে অস্বস্তি হয়। কাজী হাবিবুল আউয়ালের বাড়ি সন্দ্বীপে হলেও তার উচ্চারণ একদম প্রমিত, শ্রুতিমধুর।
Advertisement
ভাবলাম, যাক আগামী পাঁচ বছর আমাদের কান অনেক আরাম পাবে। কিন্তু বেশি কোনো কিছুই ভালো না, আরামও না। লিফটের গোড়ায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া শুনেই আমার শঙ্কা জেগেছিল, অতিকথনই না তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়!
পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন হাবিবুল আউয়াল। কিন্তু মাত্র পাঁচ মাসেই আমার শঙ্কা সত্যি হয়ে গেছে। এই পাঁচ মাসে প্রমিত উচ্চারণ দিয়েও তিনি মানুষের মনে যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করেছেন। বিরক্তি যে উৎপাদন করেছেন, সেটা তিনি নিজেও টের পেয়ে গেছেন। নিজেই বলেছেন, ইউটিউবে নিজের বক্তব্য তিনি শোনেন না ভয়ে। কারণ নিচে থাকে অঢেল গালাগাল।
এবারই প্রথম সংবিধান মেনে প্রণীত আইনের আওতায় গঠিত সার্চ কমিটির খুঁজে দেওয়া নাম থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের উচ্ছ্বাসটা আমরা উপভোগ করতে পারিনি। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি।
এই প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দলকে অংশ নিতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তারা কোনো প্রক্রিয়া বা নির্বাচনে অংশ না নিলে সেটা গ্রহণযোগ্য বা অংশগ্রহণমূলক হয় না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিএনপিকে আলোচনায় আনার, নির্বাচনে আনার নানা চেষ্টা করে যাচ্ছেন, নানা আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু তার কথায় এখনও চিড়ে ভেজেনি। বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো আলোচনায় আগ্রহী নয়।
Advertisement
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নির্বাচন কমিশন দফায় দফায় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময় করছে। নির্বাচন নিয়ে সব পক্ষের মানুষের মতামত নেওয়াটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা হলো প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল যতটা শুনছেন, বলছেন তারচেয়ে অনেক বেশি। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় চলছে। আর তাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দফায় দফায় কথা বলছেন।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের মিডিয়াপ্রীতি আগের যে কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের চেয়ে অনেক বেশি। তুলনামূলক বিবেচনায় তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। যত শুদ্ধ উচ্চারণে গুছিয়ে বলুন না কেন, কথা হলো একধরনের ফাঁদ। যত কথা বলবেন, আপনার চারপাশে গর্ত খুঁড়বেন আপনি। যতই সাবধান থাকুন, সেই গর্তে আপনাকে পড়তেই হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অতিকথন অবশ্য সাংবাদিকদের জন্য মন্দ নয়। প্রতিদিনই শিরোনাম পাওয়া যায়। মনে আছে, নব্বইয়ের দশকে আমি নিজে যখন নির্বাচন কমিশন বিট কাভার করতাম, তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারদের একটু মন্তব্যের আশায় তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতাম। সারাদিন বসে থাকার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন বাসায় যাওয়ার জন্য অফিস থেকে বেরুতেন, আমরা সিঁড়ির গোড়ায় তাকে আটকাতাম।
মুড ভালো থাকলে দাঁড়িয়ে দুয়েক মিনিট কথা বলতেন, নইলে হেঁটে গাড়িতে উঠতে উঠতে দুয়েক লাইন বলতেন। তাতেই আমাদের সারাদিনের বসে থাকা সার্থক হতো। অন্তত একটা রিপোর্ট তো হলো। এখনকার নির্বাচন কমিশন বিটের রিপোর্টারদের দেখে রীতিমতো হিংসা হয়। তারা সকাল-দুপুর-বিকাল তিন বেলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের লম্বা লম্বা বক্তব্য পাচ্ছেন, কোনটা ফেলে কোনটা শিরোনাম করবেন দশা। তবে বেশি কথা বললে যা হয়, সকালের কথা বিকালে পাল্টে দিচ্ছেন, পরদিন প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইছেন। শুরুর দিনে যে শঙ্কাটা জেগেছিল, দিনে দিনে সেটা আরও বাড়ছে, কথার জালে জড়িয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ডুবে যান কি না।
কাজী হাবিবুল আউয়াল গত পাঁচ মাসে কী কী বলেছেন, তার ফিরিস্তি দিতে গেলে মহাকাব্য লিখতে হবে। তবে তার সব কথা ছাড়িয়ে গেছে তলোয়ার-রাইফেল তত্ত্ব। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের একপর্যায়ে সিইসি বলেছিলেন, ‘আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকেও কিন্তু রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে।’
অবশ্য বিকেলেই তিনি তার সকালের কথা উল্টে দেন। পরদিন রীতিমতো ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, ওটা ছিল কথার কথা। তবে সিইসির আসনে বসে কথার কথা বলা যায় না। সিইসি হলেন নির্বাচনী মাঠের রেফারি। খেলায় কেউ ফাউল করে রেফারির দায়িত্ব হলো তাকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সাবধান করা বা লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া।
প্রতিপক্ষকে আরও বড় ফাউল করার উসকানি দেওয়া কোনোভাবেই রেফারির কাজ নয়। কেউ তলোয়ার নিয়ে মাঠে নামলে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব তাকে গ্রেফতার করা, কাউকে রাইফেল নিয়ে মাঠে নামার পরামর্শ দেওয়া নয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই সিইসি বিরোধী দলকে মাঠ ছেড়ে না গিয়ে ইউক্রেনের জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। তার এই বক্তব্যকে বাংলাদেশের রাশিয়াবিরোধী অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করে রুশ দূতাবাস অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলছেন অনেক বেশি। কিন্তু আসলে কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে। তবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রথম পরীক্ষায় ভালো পরীক্ষা দিয়েও তিনি ফেল করেছেন। নির্বাচন ভালো হলেও শেষ বেলায় ফলাফল ঘোষণায় বিলম্বের কারণে বিতর্কের মুখে পড়তে হয় কমিশনকে। কাজী হাবিবুল আউয়াল বারবার কথায় নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন।
একাধিকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন রাতে হবে না, দিনে হবে। আগামী নির্বাচন ২০১৮ সালের মতো হবে না। এই বক্তব্য দিয়ে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলোরই বৈধতা দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন। তবে শুধু কথায় বিরোধী দলের আস্থা তিনি পাবেন না। কাজে প্রমাণ করতে হবে। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী বলবেন না বলবেন, সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাকে পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে মুখের কথা আর বন্দুকের গুলি একবার বেরিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই সংযত হয়ে কথা বললে, তার জন্যই মঙ্গল। আর সিইসির মঙ্গলের সাথে জাতির মঙ্গলও জড়িত। একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন এখন জাতির আকাঙ্ক্ষা। আর সেই আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম