অর্থনীতি

আতঙ্ক জেঁকে বসেছে শেয়ারবাজারে, কাজে দেবে কি বিএসইসির দাওয়াই

আতঙ্ক জেঁকে বসেছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ফলে ঘটছে টানা দরপতন। পতনের মধ্যে পড়ে প্রতিদিন পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে নীরবে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তাদের। পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীদের এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ‘ফ্লোর প্রাইস’ দাওয়াই নিয়ে এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

Advertisement

তবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এই দাওয়াই কতোটা কাজে দেবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও বিনিয়োগকারীরা। তারা বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে হয়তো সাময়িকভাবে শেয়ারবাজারের দরপতন হবে। কিন্তু বাজারে লেনদেন কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা চাইলেও তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে ব্যর্থ হবেন।

তারা বলছেন, বিএসইসি শেয়ারবাজারকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে তা সঠিক উপায় নয়। বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। তা না হলে বাজারের স্বাভাবিকতা নষ্ট হবে। আবার বাজার ভালো করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের বৈঠক নজিরবিহীন। ফলে শেয়ারবাজারে যারা কারসাজি করে তারা আরও সাহস পাবে।

গত ঈদের আগে থেকেই শেয়ারবাজার পতনের মধ্যে রয়েছে। তবে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জ্বালানি সাশ্রয়ে ১৮ জুলাই সরকার সারাদেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলে পতনের মাত্রা বেড়ে যায়।

Advertisement

ঈদের পর টানা নয় কার্যদিবস দরপতন হলে ২৫ জুলাই ৩০ জন বড় বিনিয়োগকারীর সঙ্গে বৈঠক করে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ওই বৈঠকের পর বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন বড় বিনিয়োগকারীরা। সেই সঙ্গে বড় বিনিয়োগকারীরা মার্কেট মেকারের ভূমিকা পালন করবেন।

বড় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিএসইসির বৈঠকের পর ২৬ জুলাই লেনদেনের একপর্যায়ে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক একশ পয়েন্টের ওপর বেড়ে যায়। তবে লেনদেন শেষে সূচক বাড়ে মাত্র ২৯ পয়েন্ট এবং পরের দুই কার্যদিবস আবার বড় পতন হয় শেয়ারবাজারে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে বড় বিনিয়োগকারীরা আসলেই কি বিনিয়োগ বাড়িয়েছে নাকি বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বেশি দামে শেয়ার বিক্রির পাঁয়তারা চালিয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বিএসইসির কাছে বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ বাড়ানোর যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করেছে কি না নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেখা উচিত। যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের কেউ বাজার থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে তা বাজারের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিএসইসি বৈঠক করতে পারে। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিএসইসির এ ধরনের বৈঠক করা উচিত হয়নি। বিএসইসি হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তারা কেন ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করবে? আবার বৈঠকে বিতর্কিত বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতিও ছিল। এদের নিয়ে বৈঠক করলে তারা তো আরও মাথায় চেপে বসবে। এদের তো শাস্তি দিতে হবে, এদের নিয়ে বৈঠকের দরকার নেই।

Advertisement

এদিকে বড় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠকের পরও দরপতন বন্ধ না হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বিএসইসি। শেষ পাঁচ কার্যদিবসের ক্লোজিং প্রাইসের গড় দাম হবে প্রতিটি সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস। আগামী রোববার থেকেই এই ফ্লোর প্রাইস কার্যকর হবে।

এ বিষয়ে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস কতোটা কার্যকর হবে তা আমি জানি না। তবে শেয়ারবাজারে এভাবে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া হয় না। এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এমন কোনো পেনিক সিচুয়েশন তৈরি হয়নি। সূচক এখনো ছয় হাজার পয়েন্টের মতো। এ পরিস্থিতিতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া আমার মতে একেবারেই যুক্তি সংগত নয়। যদি দু-চারদিনের মধ্যে এটা উঠে না যায়, তাহলে বাজারে লেনদেন কমে যাবে।

তিনি বলেন, বাজারের যে স্বাভাবিক লেনদেন সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সেটা তো তাহলে কোনো স্টক মার্কেট থাকে না। সরকার এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দেওয়ার পর বাজারে কিছুটা পতন হয়েছে। মানুষ পেনিক হয়ে যাওয়ার এই পতন হয়েছে। তবে আমি মনে করি পতন যা হওয়ার হয়েছে, আবার শেয়ারবাজারে পতন হওয়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই।

ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস সাময়িক সময়ের জন্য দেওয়া হয়েছে। এতে শেয়ারবাজারের দরপতন কিছুটা হলেও বন্ধ হবে। তবে এটাকে দীর্ঘমেয়াদি করা যাবে না। দীর্ঘ সময়ের জন্য হলে বাজারে লেনদেন কমে যাবে। সেটা বাজারের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বিনিয়োগকারীদের নীরবে রক্তক্ষরণ

ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়ায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম ৫০ শতাংশের ওপরে পড়ে গেছে। এরপরও ক্রেতা না থাকায় বড় ধরনের লোকসান দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ। ফলে প্রতিদিন শেয়ারের দাম কমতে থাকায় নীরবে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এসব বিনিয়োগকারীদের।

শরিফুল নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমি একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ১৬৪ টাকা করে কিনেছিলাম। দাম কমে যাওয়ায় কয়েক দফা সেই শেয়ার কিনে ১৩০ টাকা করে সমন্বয় করেছি। কিন্তু এখন তার দাম ৭০ টাকার নিচে। এক প্রতিষ্ঠানেই আমার বিনিয়োগ করা অর্থ অর্ধেক নেই হয়ে গেছে। শুধু ওই প্রতিষ্ঠান নয়, বহুজাতিক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছি। প্রতিদিন যেভাবে শেয়ারের দাম কমছে তাতে চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না।

বাজার ছেড়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী

পতনের ধকল সইতে না পেরে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছাড়ছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসেই বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব কমে গেছে দুই লাখের ওপর। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে প্রায় সাত লাখ।

বর্তমানে (২৮ জুলাই) সক্রিয় বিও হিসাব আছে ১৮ লাখ ৪০ হাজার ৮০১টি। এক মাস আগে বা ৩০ জুন বিও হিসাব ছিল ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৭১টি। এ হিসাবে এক মাসে বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ২৭০টি। ২০২১ সালের জুন মাসের শেষ কার্যদিবস বা ২৯ জুন বিও হিসাব ছিল ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩১টি। এ হিসাবে এক বছরে বিও হিসাব কমেছে ৬ লাখ ৯৫ হাজার ৬৩০টি।

বাজার মূলধন নেই সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা

শেয়ারবাজার টানা পতনের মধ্যে পড়ায় তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমায় ঈদের পর মাত্র ১৩ কার্যদিবসেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ২৬ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা কমে গেছে। গত ৭ জুলাই ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ১৮ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। ২৮ জুলাইয়ের লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দাম ওই পরিমাণ কমে গেছে।

সূচক ও লেনদেন

গত ৭ জুলাই ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ৩৬৬ পয়েন্টে। টানা পতনের মধ্যে পড়ে তা এখন ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্টে নেমে গেছে। অর্থাৎ মাত্র ১৩ কার্যদিবসে সূচকটি কমেছে ৩৮৬ পয়েন্ট। এদিকে কিছুদিন আগেও লেনদেন ছিল আটশ কোটি টাকার ওপরে। সেই লেনদেন কমতে কমতে চারশ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে সামনে লেনদেন আরও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এমএএস/এসএইচএস/এমএস