ছোট বয়সেই বাবাকে হারান সাজিনা বেগম (২৩)। অভাব-অনাটনের সংসার। ছোট ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ আর বিধমা মায়ের দুঃখ ঘোচাতে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের আহম্মদপাড়া গ্রাম থেকে তাই ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকায়। পোশাক কারখানায় কাজ করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাবেন, ভাইকে পড়ালেখা শেখাবেন এই আশায়। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হলো না অভাগী সাজিনার। স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দুই চোখে এখন ঘোর অমানিশাই দেখছেন সাজিনা।স্বামীর পরকীয়ায় বাধা এবং তাকে ডিভোর্স দেয়ার অপরাধে সাজিনার হাত-পায়ের রগ কেটে বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে তারই লম্পট স্বামী রহিম বকস। সুস্থ হয়ে উঠলেও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা সম্ভব হবে না কোনদিন-তা বুঝতে পেরেছেন সাজিনা। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে গিয়ে কোথায় থাকবেন সেও ভাবিয়ে তুলছে তাকে। শুক্রবার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে স্বামীর নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে দুই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছতে মুছতে সাজিনা জাগো নিউজকে জানান, বছর খানেক আগে পার্শ্ববর্তী পাইকান বকরিরটারী এলাকার জসিম উদ্দিনের ছেলে লম্পট রহিম বকসর (৩৫) কু-নজর পড়ে তার উপর। ঢাকায় গিয়ে উত্ত্যক্ত করা ছাড়াও প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকেন রহিম বকস। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই রহিম বকসকে বিয়ে করেন সাজিনা। সেই বিয়েই কাল হয়ে উঠে তার জীবনে। বিয়ের পরপরই ঢাকা থেকে ফিরে আসেন বাড়িতে। এসে জানতে পারেন স্বামীর আরো এক স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে রয়েছে। সেখানে ঠাঁই না হওয়ায় বিধবা মায়ের কাছেই আশ্রয় নেন সাজিনা। স্ত্রীকে শশুর বাড়িতেই রেখে মাঝে মাঝে যাতায়াত করতেন রহিম বকস।সাজিনা আরো জানায়, একপর্যায়ে তাকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করানোর মতলব আটেন লম্পট রহিম। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় নির্যাতন। মাঝে মাঝে অন্য নারীকে নিয়ে এসে ওই বাড়িতেই রাত কাটানোর ইচ্ছেটাও তার বাধায় অপূর্ণই থেকে যায় রহিমের। ফলে বাড়তে থাকে শারীরিক নির্যাতনের মাত্রাও।অব্যাহত শারীরিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামী নামের সেই নরপশুটাকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গত ৪ জানুযারি গোপনে কাজির বাড়িতে গিয়ে একতরফা তালাকও দেন সাজিনা। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন রহিম বকস। এরপর ৮ জানুয়ারি বিকেলে পার্শ্ববর্তী বড়াইবাড়ি বাজারে যাবার পথে লম্পট রহিম ও সঙ্গীরা তার পথরোধ করেন। একপর্যায়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেন রহিমের ছোট ভাই জিয়াল ও শাহালম। এরপর সাজিনার বুকের উপর পা দিয়ে শফিকুল দুই পা চেপে ধরেন। এসময় রহিম ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার বাম পা ও ডান হাতের রগ কেটে দেয়া ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। শুধু তাই না, আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে যখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তখন সাজিনার বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এতে তার মাথা গাঁজার শেষ সম্বলটুকুও আগুনে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। প্রায় সপ্তাহখানেক রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকার পর সাজিনাকে রংপুর মেডিকেল থেকে গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন।সাজিনা জানান, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার কারণে এখন থাকারও কোনো জায়গা নেই তাদের। হাসপাতাল থেকে ফিরে গিয়ে কোথায় থাকবেন, অসহায় বিধবা মা কতটুকুই বা করতে পারবেন তাই এখন ভাবিয়ে তুলছে তাকে।এ ঘটনায় গত ১৯ জানুয়ারি গঙ্গাচড়া মডেল থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন তিনি। তবে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করলেও মূলহোতা রহিম বকসকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। রহিম ও তার স্বজনেরা এখন তাকে ও তার মা ফিরোজা বেগমকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। ফলে হাসপাতালেও চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তার।সাজিনা বেগমের মা ফিরোজা বেগম জাগো নিউজকে জানান, কপাল-ঘর দু’টাই পুড়লো। তার মেয়েকে চিরতরে পঙ্গু করা এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পরও রহিম গ্রেফতার হয়নি। তিনি অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির দাবি জানান।সাজিনা বেগমের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতালের কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুরা মোশারফ জাগো নিউজকে জানান, ধীরে ধীরে সাজিনার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। পুরোপুরি সেরে উঠতে চার মাসের মতো সময় লাগবে। তবে সাজিনা আগের মত স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারবেন না বলেও জানান ওই চিকিৎসক।এ ব্যাপারে গঙ্গাচড়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন জাগো নিউজকে জানান, এ ঘটনার জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করা হলেও মূল আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে তাকে গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।জিতু কবীর/এআরএ/আরআইপি
Advertisement