একসময় মানুষ চলাচলের জন্য হাতি, ঘোড়া, উট, নৌকা বা জাহাজ ব্যবহার করতো। ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর বদলে যায় দৃশ্যপট। এখন জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষ পুরোটাই মানুষের নিয়ন্ত্রণে। এখন নৌপথ, সড়কপথ, রেলপথ, আকাশপথে মানুষ দ্রুত এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে পারে। গতি বিবেচনায় আকাশপথ মানে বিমানই এগিয়ে আছে, ব্যয়ের বিবেচনায়ও। তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ চলাচল করে সড়কপথে। কমফোর্ট বিবেচনায় নিলে আমি সবার ওপরে রাখবো রেলকে। কেউ কেউ নৌপথকেও আরামদায়ক বিবেচনা করেন। কিন্তু কারও কারও সি সিকনেস আমলে নিলে আরামের বিবেচনায় নৌপথকে টেক্কা দিয়ে রেল এগিয়ে যাবে। তবে ইদানীং দ্রুতগতির নানা ট্রেন পাল্লা দিচ্ছে বিমানের গতির সাথে।
Advertisement
উন্নত বিশ্বে অনেক জায়গায় বিমানের চেয়েও খরুচে ট্রেন ভ্রমণ। দীর্ঘ সময় বিমানে একই আসনে বসে থাকা খুবই বিরক্তিকর, একই কথা খাটে বাসের ক্ষেত্রেও। নৌপথে অনেক বিলাসবহুল জাহাজে আরামদায়ক ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। বড় অনেক জাহাজ তো একটি আস্ত শহরের মতো, সব সুযোগ-সুবিধাই থাকে তাতে। তবে আরাম এবং বৈচিত্র্য বিবেচনায় নিলে রেলের কোনো বিকল্প নেই। চাইলেই আপনি হাঁটতে পারবেন, আড্ডা মারতে পারবেন। আর দুই পাশের দৃশ্য বদলে যায় ক্ষণে ক্ষণে।
কিন্তু এই যে এত আরামের বাহন ট্রেন, সেটা বাংলাদেশের মানুষের ভোগান্তির অনন্ত উৎস যেন। বিশ্ব যখন রেলওয়ে সেবাকে আরও কীভাবে উন্নত করা যায়, ট্রেনের গতি কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখন আমাদের প্রতিযোগিতা যেন সেবার মান আরও কতটা খারাপ করা যায়। ব্রিটিশ আমলে এ আমলে রেল নেটওয়ার্কের যাত্রা।
একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত ভারতের রেলওয়ে সেবা আজ কোথায়, আর বাংলাদেশের রেলওয়ে সেবা কোথায়; তুলনা করতে গেলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। সেবার মান তলানিতে, তবু মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। কোনো উৎসব এলেই মানুষ ট্রেনের টিকিটের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ঈদযাত্রায় ট্রেন ঢেকে যায় মানুষের আড়ালে।
Advertisement
ট্রেনের ভোগান্তির কত ধরন, তা ভুক্তভোগীরাই কেবল জানে। টিকিট কাটতে ভোগান্তি, ট্রেনে উঠতে ধাক্কাধাক্কি, আসন পেতে হয়রানি- আসলে হয়রানির কোনো শেষ নেই। নোংরা ট্রেন, তারচেয়েও বেশি নোংরা টয়লেট, নিম্নমান কিন্তু উচ্চ দামের খাবার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে যেন বারবার মানুষকে বার্তা দেয়, তোমরা কেউ ট্রেনে চড়ো না। শুধু উৎসবের সময় নয়, সাধারণ সময়ও ট্রেনের একটা কাঙ্ক্ষিত টিকিট পাওয়ার দুর্ভোগ কম নয়। এরচেয়ে সহজে বিমানের টিকিট পাওয়া যায়।
রেলের এত নেতিবাচক বার্তা সত্ত্বেও মানুষ রেলকেই ভালোবাসে। কিন্তু এত জনপ্রিয়তা, এত চাহিদার পরও রেল বছরের পর বছর লোকসান গুনছে। শুধু যাত্রী পরিবহন নয়, মালামাল পরিবহনেও রেলের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এত সম্ভাবনার পরও বাংলাদেশের ইতিহাসে রেল কখনো লাভ করতে পারেনি। বরং বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে রেল নিজেকে শ্বেতহস্তী হিসেবে প্রমাণ করেছে। কালো বিড়ালরা রেলের সব সর খেয়ে নেয়।
এটা মানতেই হবে, বর্তমান সরকার রেলবান্ধব। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে রেলকে আলাদা করে রেলপথ মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছে। রেলওয়েতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। নতুন নতুন রেলপথ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে যেন এক ব্ল্যাকহোল, যাই দেবেন সব হারিয়ে যাবে, একদম পারফেক্ট তলাবিহীন ঝুড়ি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রথম মন্ত্রী ছিলেন ঝানু রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু এই রেলের ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে গেছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সারাজীবনের সব অর্জন। মুজিবুল হক অবশ্য রেলমন্ত্রী হয়ে শেষ বয়সে সংসার পেয়েছেন। মধ্যরাতে রেল কর্মকর্তার চাকরি খেয়ে বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের চাকরিই প্রায় খেয়ে দিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। রেলপথ আসলেই যেন একটা কুফা মন্ত্রণালয়।
Advertisement
বাংলাদেশে রেলওয়ের বিশাল নেটওয়ার্ক, বিপুল সম্পদ রয়েছে, রয়েছে বিপুল চাহিদাও। তারপরও তারা কেন লোকসানে চলে, এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। আমার ধারণা কারোরই জানা নেই। সেবার কথা বললেই, বলা হয়, লোকবল সংকট। আরও লোকবল নিয়োগ করলে তো লোকসান আরও বাড়বেই শুধু। রেলওয়ের যে বিপুল সম্পদ, তার সদ্ব্যবহার করলেও রেলের লোকসান কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে যেন ‘সরকারকা মাল দরিয়া মে ঢাল’র প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
দিনের পর দিন রেলওয়ের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা ভেবেছি, এটাই বুঝি রেলওয়ের নিয়ম। দেওয়ালের ঠেকানো মতো পিঠও আর বাকি নেই। কিন্তু সবাই তো আমাদের মতো মুখ বুজে সয়ে যাওয়া ধরনের নাও হতে পারেন। যেমন নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন রনি। গত ঈদের আগে অনলাইনে টিকিট কাটতে গিয়ে তিনি রীতিমতো প্রতারণার শিকার হন। তার টাকা কেটে নিলেও টিকিট পাননি।
এই অনিয়ম তাকে ক্ষুব্ধ করে। নানা অনিয়ম প্রতিদিন আমাদেরও ক্ষুব্ধ করে। কিন্তু আমরা সেই ক্ষোভ গিলে ফেলি। কিন্তু মহিউদ্দিন রনি আমাদের মতো নন। বুকভরা ক্ষোভের বারুদ নিয়ে তিনি রেলের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে একাই আন্দোলনে নামেন। ৭ জুলাই থেকে তিনি ৬ দফা দাবি নিয়ে কমলাপুরে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। তার আন্দোলন একার এবং শান্তিপূর্ণ। এমনকি ঈদের দিনও তিনি কমলাপুরে কাটান।
শুনে একজন বললো, এই ছেলে পাগল নাকি। হয়তো পাগল। কিন্তু রনির মতো পাগলরা এখনও আছেন বলেই দেশটা এখনও ধ্বংস হয়ে যায়নি। রনির অবস্থানে রেলওয়ের টনক নড়েনি, তবে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে হাইকোর্টের। তারাও জানতে চেয়েছেন, রেলওয়ের অনিয়ম নিয়ে। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযানেও সত্যতা মিলেছে রনির অভিযোগের। এরই মধ্যে রেলওয়ের অনলাইন টিকিট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সহজডটকমকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও যথারীতি কমিটি গঠন, খতিয়ে দেখা হচ্ছে ধরনের দায়সারা বক্তব্যে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সমাধান ছাড়া মাঠ ছাড়তে রাজি নন মহিউদ্দিন রনি। এরই মধ্যে তার প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। অনেকেই রনির দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছেন।
তার আগে দেখে নেয়া যাক, রনির ৬ দফা দাবিগুলো। ১. টিকিট ব্যবস্থাপনায় হয়রানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, হয়রানির ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে; ২. যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে টিকিটের কালোবাজারি বন্ধ করতে হবো; ৩. অনলাইন কোটায় টিকিট ব্লক করা বা বুক করা বন্ধ করতে হবে। অনলাইন বা অফলাইনে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে; ৪. যাত্রী চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রেলের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে; ৫. রেলের টিকিট পরীক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কসহ দায়িত্বশীলদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে আনতে হবে এবং রেলের সেবার মান বৃদ্ধি করতে হবে; ৬. রেলে ন্যায্যমূল্যে খাবার বিক্রি, বিনামূল্যে পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মহিউদ্দিন রনির দাবির সাথে একমত হবেন না, এমন লোক একজনও নেই। আমার ধারণা রেলমন্ত্রী নিজেও রনির সাথে একমতই হবেন। সবাই জানি সমস্যা, রেলের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও হচ্ছে; কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। সহজডটকমকে অনলাইন টিকিট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে টিকিট প্রাপ্তিকে আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে। রনি একা হলেও রেলেওয়ের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তাকে শত্রু মনে না করে, তার এই দাবিগুলোকে সামনে রেলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া। বাংলাদেশ যেভাবে এগোচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে রেলকেও আধুনিক, সেবামুখী ও লাভজনক করতে হবে।
মাঝে মধ্যেই আমরা খবর পাই, ট্রেন লাইনচ্যুত, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু বাংলাদেশের গোটা রেল ব্যবস্থাপনাই অনেক আগে লাইনচ্যুত হয়ে আছে। আমাদের সবার উচিত লাইনচ্যুত রেলকে লাইনে তুলতে মহিউদ্দিন রনির একার সংগ্রামে সঙ্গ দেওয়া। তাতে সবার লাভ, রেলওয়ের লাভ, দেশের লাভ, দশের লাভ।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম