দেশজুড়ে

নদীবেষ্টিত নারায়ণগঞ্জে মাছের আকাল

নদীবেষ্টিত জেলা নারায়ণগঞ্জ। মূল শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা, দক্ষিণ-পশ্চিমে ধলেশ্বরী। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদও জেলার পশ্চিম দিক দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে নারাণগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরীতে মিলিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এসব নদীর সঙ্গে শহরের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে যুক্ত রয়েছে অসংখ্য খাল-নালা-বিল। অথচ নারায়ণগঞ্জবাসীর খাবারের প্লেটে জোটে না দেশি মাছ। এখানকার চাহিদা পূরণ হয় অন্য জেলা থেকে আসা ও চাষ করা মাছে।

Advertisement

যে কারণে মাছের দেখা মিলছে না

জেলার নদীগুলো ধুকছে শিল্পদূষণে। বাসা বাড়ির ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে শহরের খাল-বিল, নালা। ড্রেজার দিয়ে বালুভরাটের কারণে পুকুর, খাল-বিল, নালাসহ মৎস্য সম্পদের সব উৎস চাপা পড়েছে বালুর নিচে। নদীর পাড়ঘেঁসে শোভা পাচ্ছে বাড়িঘর, দালান, শিল্পকারখানা আর দোকানপাট। ফলে বিলুপ্ত হচ্ছে মছের আবাসস্থল।

বন্দর এলাকার বাসিন্দা কাজী সোহাগ বলেন, প্রভাবশালীরদের কারণে নদ-নদীতে মাছতো নেই-ই, এমনকি পানিতে গোসলও করা যায় না। গোসল করলে শরীর চুলকায়, নানা রোগ দেখা দেয়। ফলে এক সময় সুখ্যাতি পাওয়া দারকিনি, মলা, ডেলা, ভাগনা, শরপুঁটি, স্বর্ণপুঁটি, মহাশোল, মহাশের, কালাবাটা, শিলং, দেশি পাঙাশ, বইচ্চা, ঘাউরা, দেশি রিঠা, গুজিআইড়, চিনুয়া (চেউয়া), বাঘাইড়, দেশি চিতল, নেপতানি, কুমিরের খৈল, কুচিয়া, একথোটা, গজার, গুইচ্ছা, কাসখৈয়া, ভোল, খোকসা, গইন্না, ভাগনাবাটা, কালিবাউস, কালিয়া, টাটকিনি, রানীপুতুল, রানী, মধুপাবদা, কানি, বোয়ালীপাবদা, পাবদা, গাঙ মাগুর, ছিকা, কাজলী, টেংরা, আইড়, খইলসা, ফলি, খল্লা, মেনি, বেদা, নাপিত কৈ, বিশতারা, চান্দা, রাঙাচান্দা, বামুস, তিতপুঁটি, তারাবাইম, চিরকা, খইলসা ও বইচ্চা মাছ এখন বিলুপ্তির পথে।

Advertisement

মাছ ধরা এখন গল্প

শহরের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশির দশকে নারায়ণগঞ্জে খাল-বিল ও নদীতে প্রচুর মাছ মিলতো। কাশীপুর দেওয়ানবাড়ি, হাজীপাড়া ও জেলেপাড়ার ত্রিমোহনায় বছরজুড়ে একাধিক বড় বড় বাঁশ পুঁতে বিশাল জাল (বেহাল জাল) দিয়ে মাছ ধরতো জেলেরা। এরপর বাংলাবাজার থেকে বাবুরাইল পর্যন্ত কমপক্ষে ১০-১২ পয়েন্টে বেহাল জাল বা খরা পেতে মাছ ধরতো। সেই মাছ বাংলাবাজার বা বৌবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হতো। তখন বড়শি ফেললেই মাছ মিলতো। শীতকালে যখন ক্ষেত-খামারের পানি শুকিয়ে যেত, তখন বিল ও নীচু জমিতে কচুরিপানা পরিষ্কার করে কাঁদাময় পানিতে মাছ ধরার ধুম পড়ত। দেশিয় মাছের সেই সোনালী দিন হারিয়ে গেছে ড্রেজারের আগ্রাসনে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরতলীর কাশীপুর, বাংলবাজার, ভোলাইল, বারৈভোগ, চর কাশীপুর, চর নরসিংপুর, নবীনগর, শ্রীধরদী, মুসলিমনগর, আমতলা, এনায়েতনগর, সৈয়দপুর, হাটখোলা, পাইকপাড়া, খিলমার্কেট, মাসদাইর, নাগবাড়ি, পানির ট্যাংকী, লিচুবাগ, পূর্বনগর, পশ্চিমনগরও আশপাশে খাল-বিল-নালা ও পুকুরে সারাবছর দেশি মাছ পাওয়া যেতো। বর্ষায় পুকুর বা খালে গাছের ডালপালা ফেলে রাখা হতো। যাতে মাছ আটকা থাকে। শীতকালে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে বিশেষ করে শুক্রবারে সবাই মিলে মাছ ধরতো। শোল, গজার, বোয়াল, রুই, কাতলা, মেনি, খইলসা, কই, মাঝারি আকারের শিং, মাগুর ও ফলি মাছের দিন ছিল। তখন পুটি, টেংরা, বাইন, গুত্তুম ও টাকি মাছ ছিল গরীবদের মাছ। যারা বড় মাছ কিনতে পারতেন না তারা ছোট মাছ খেয়েই আমিষের চাহিদা পূরণ করতো। নুন্দি বাইল্যা, কেচকী ও বজুরি জাতীয় ছোট মাছ বাজারে কোনো ধনীর খলইয়ে ঠাঁই পেত না।

শহরের প্রবীণ ব্যক্তি মো. সালাউদ্দিন বলেন, আশির দশকে বর্ষা মৌসুমে খাল বিলে নতুন পানি আসতো। তখন মাছ ধরার ধুম পড়তো। দিন রাত মাছ ধরতাম। এসব কথা এখন গল্প হয়ে গেছে। কত তরতাজা মাছ খেয়েছি। এখন খাই চাষের মাছ। খালবিল না থাকায় দেশি মাছ মেলে না।

Advertisement

চোখেও দেখা যায় না মাছ

শীতলক্ষ্যার কিনারে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন জাকির। তিনি বলেন, নদীতে কোনো মাছ নেই। আগে জাল ফেললে অল্প সময়ের মধ্যেই ঝুড়ি ভরে যেত। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও ঝুড়ির তলা-ই ভরে ন। এই পানিতে কিভাবে মাছ থাকবে? মানুষই কিছুক্ষণ থাকলে তার শরীরের চামড়া পরিবর্তন হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, ছয়-সাত বছর আগেও কিছু মাছ পাওয়া যেত। এখন বছরের মধ্যে কয়েক মাস পাওয়া যায়। বাকি সময় মাছ চোখেও দেখা যায় না।

বিশিষ্ট মাছ ব্যবসায়ী জামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, নদীর মাছ এখন চোখেও দেখি না। নারায়ণগঞ্জের মাছঘাটে শহরের বিভিন্ন নদী ও খালের মাছ আসতো। এখন দেখি না। নারায়ণগঞ্জের মানুষের ভরসা এখন চাষের মাছ। আগে শীতলক্ষ্যায় বড়শি দিয়ে অনেক মাছ ধরেছি। নদীতে সারের পানি পড়লে মাছ ধরে শেষ করতে পারতাম না।

মাছ ব্যবসায়ী শাহিনুর বলেন, ছোটবেলায় নদী থেকে অনেক মাছ ধরেছি। কিন্তু এখন ডাইংয়ের পঁচা পানির কারণে মাছ পাওয়া যায় না। বড়শি নিয়ে আধাঘণ্টা বসলে প্রচুর মাছ ধরতে পারতাম। এমনও দিন গেছে একদিনেই একজনই এক থেকে দুই লাখ টাকার মাছ ধরেছে এই নদী থেকে। এখন মাছ তো দূরের কথা, মানুষ গোসলই করতে পারে না। নারায়ণগঞ্জের সব নদী নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুর খাল বিল বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছে।

নারায়ণগঞ্জে মাছঘাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. হোসেন সনি জাগো নিউজকে বলেন, এক সময় শীতলক্ষ্যায় ইলিশ ছাড়া সব মাছ পাওয়া যেতো। এখন শীতলক্ষ্যায় সাপ পড়লে মরে যায় যায়। মাছ কিভাবে থাকবে?

মৎস্য কর্মকর্তারা যা বলছেন

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোসাম্মৎ শাহরিয়ার সালমা বলেন, নারায়ণগঞ্জে শিল্পবর্জে্যর কারণে যেমন নদী ও খালের পানিতে প্রভাব পড়ছে তেমনি বদ্ধ জলাশয়ে অর্থাৎ পুকুরে মাছ চাষ করা ব্যক্তিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আয়নাল হক জাগো নিউজকে বলেন, শিল্পনগরী হওয়ায় শিল্পবর্জ্যে নদী-নালা-খাল- বিল দূষিত হচ্ছে। ফলে মাছ উৎপাদন কমেছে। দেশের উন্নয়নে শিল্পের যেমন প্রয়োজন তেমনি পুষ্টি পূরণে মাছের বিকল্প নেই। কিন্তু শিল্পবর্জে্যর কারণে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গায় মাছ নেই। খালেও মাছ পাওয়া যায় না। বর্ষায় কিছুটা মাছের দেখা মিলে। তবে শিল্পবর্জ্যের কারণে বিষক্রিয়ার প্রভাব থেকেই যায়।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন শিল্প কারখানার মালিকরা ইটিপি স্থাপন করলেও সেটি ঠিকমতো চালায় না। তাদেরকে অনুরোধ করেছি অন্তত ইটিপিতে চুনের ব্যবহার ঠিকমতো করে। কিন্তু কেউই সেটি করে না। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জে যে পরিমাণ মাছের চাহিদা রয়েছে তাতে উৎপাদনকৃত মাছ থেকে ৫০ ভাগ পূরণ হয়।

এএইচ/জিকেএস