দিল্লি থেকে প্লেন যখন কোয়েম্বাতুর রানওয়ে ছুঁলো তখন দুপুর। আকাশ কিছুটা মেঘলা। বৃষ্টির আভাস রয়েছে। রানওয়ে থেকে দেখা যাওয়া দূরের কালো পাহাড়গুলো জানান দিলো পা এখন দক্ষিণের শৈল শহরে। কেরালার সীমানাঘেঁষা তামিলনাড়ু রাজ্যের একটি জেলা কোয়েম্বাতুর। গন্তব্য শৈল শহরের রানি খ্যাত ‘উটি’। পাহাড়ি জেলা নীলগিরির সদরদপ্তর। দূরত্ব কোম্বারয়াতু থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার। প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ।
Advertisement
উটির পাহাড়
সময় লাগবে তিন ঘণ্টার বেশি। যত কাছে যাওয়া হয়, পাহাড় তত দূরে সরে যায়। এটাই পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রেও হলো তাই। অসংখ্য সুপারি আর নারিকেল গাছ দুপাশে। মসৃণ সড়ক ধরে পথ চলতে কষ্ট হয় না। বিমানবন্দর থেকে এত দূরত্ব হওয়ার পরও মানুষ যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বোধ হয় এ সড়কের জন্য। ট্যুরিস্ট বাসগুলোও সুন্দর। সমতল ধরে কিছুদূর এগোতেই আরও দৃশ্যমান হতে থাকলো পাহাড়শ্রেণি। রিফ্রেশমেন্টের জন্য থামলো ঘণ্টাখানেক পর। রাস্তার পাশের একটি ধাবায়। খাবারের পাশাপাশি ট্র্যাডিশনাল চকলেট, মসলাও মেলে আশপাশের দোকানে। ধাবা কমপ্লেক্সে দাঁড়িয়ে মনে হয় এই বুঝি ছুঁয়ে ফেললাম শৈলচূড়া! অনিয়ন দোসা আর চায়ে পেটপূজা সেরে আবার সড়ক ধরলো গাড়ি। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় দূরে দেখতে পাওয়া কালো মেঘ ততক্ষণে আমাদের মাথার ওপর। শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।
ট্র্যাডিশনাল টোডা হাউজ
Advertisement
কিছুক্ষণ পর চালক জানালেন আমরা এখন পাহাড়ে উঠবো। শুরু হলো আঁকাবাঁকা সড়ক ধরে পথচলা। পাহাড় বর্ষায় যৌবন ফিরে পায়। থাকে সবুজ। মেঘেরা বাসা বাঁধে তার মাথায়। অভিমান হলেই গুমরে ঝরে পড়ে বৃষ্টি হয়ে, হয়তো উড়ে অন্য চূড়ায়ও আশ্রয় নেয় কখনো সখনো। কয়েক জায়গায় হাতি চলাচলের জন্য সতর্কবার্তাও দেখা গেলো। এই পাহাড়ি বনে বানর, হরিণ, নীলগাই, চিতা বাঘসহ বিভিন্ন প্রাণী ও পাখির আবাস। বানরদল চোখে পড়লো বেশ কয়েকবার। যাত্রা বিরতিতে একবার নীলগাইও দেখা দিলো। তাও আবার একজোড়া। একেবারে বন্য অবস্থায় এসব প্রাণী দেখতে পাওয়াও সৌভাগ্যের।
তৈরি হচ্ছে চকলেট
ফল ও মসলার জন্যও তামিলনাড়ু বিখ্যাত। পথে কোনো কেমিক্যাল ছাড়া পাহাড়ে উৎপাদিত ফলের দোকানও মিললো। সেখানে আপেল, নাশপাতির পাশাপাশি স্থানীয় কিছু ফলেরও দেখা পাওয়া গেলো।
পাহাড়ের শরীরে ঝুলে ঝুলে যাওয়া জিগজ্যাগ এ পথ কিন্তু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পাড়ি দিতে থাকলেন চালক। হর্ন বাজালেন না বললেই চলে। উটি যুগলদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। তবে পরিবার নিয়েও ছুটি কাটাতে যান অনেকে। জুলাই ট্যুরিস্ট সিজন না হলেও সড়কে গাড়ির চাপ নেহায়েত কম নয়। উঠতে হবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচু শহরে।
Advertisement
চা ফ্যাক্টরি
চায়ের জন্যও বেশ নাম আছে উটির। একসময় টোডা নামে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত ছিল এ অঞ্চল। পরে ব্রিটিশদের উপনিবেশ থাকায় বলা যায় তারাই গড়েছিল শহরটি। উটির আশপাশের ছোটখাট শহরগুলোর নাম এখনো সেই ব্রিটিশদের নামানুসারে। ওয়েলিংটন নামে শহর পড়লো উটি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার আগে। যত উপরে উঠছিলাম সৌন্দর্য তত যেন পেখম মেলে বসছিল। তবে যারা উত্তর ভারতের সিক্কিম বা দার্জিলিং গেছেন তাদের কাছে এ প্রাকৃতিক গঠন আলাদা কিছু নয়। সৌন্দর্যও তা-ই।
মাঙ্কি পাজল ট্রি
পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা বসতি সত্যি এক বিস্ময়। সবুজ পাহাড়ের কঠিন বুক চিরে সাজানো লাল-নীল সব সংসার। টোডা নামে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এ অঞ্চলের আদি অধিবাসী। তাই শহরজুড়ে তাদের নানান চিহ্ন ছড়িয়ে। পথ চলতে চলতে পাহাড়ে সন্ধ্যা নামলো। বৃষ্টি তখনও পড়ছে একটু। উটির স্টারলিং পাহাড়ের একটি রিসোর্টে আমাদের রাতের আবাস। দিল্লির ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় যাত্রা শুরু করে ফার্ন হিল রিসোর্টে পৌঁছাতে তাপমাত্রা নামলো ১২ ডিগ্রিতে। নিজস্ব রীতিতে সেখানে সম্পন্ন হলো অভ্যর্থনা পর্ব।
বোটানিক্যাল গার্ডেন
রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার পালা। দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্ত সবাই। দক্ষিণ ভারতের খাবার মানেই মসলার আধিপত্য। বাঙালি এখানে খুব বেশি আসে না। তাই মেন্যুতে কিছু কন্টিনেন্টাল ফুড রাখা ছিল আমাদের টিমের কথা মাথায় রেখে। খাবার শেষে ক্লান্তি সত্ত্বেও রাতের আশপাশটা দেখার সুযোগ ছাড়লো না কেউ কেউ।
পরদিন ভোরের আলোয় টুপটাপ বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙলো। পর্দা সরাতেই জুড়িয়ে গেলে হৃদয়। মন ভালো করা বৃষ্টি, প্রশান্তির বৃষ্টি, অনেকটা তীব্র গরমে একটু ঠান্ডা পানীয়ের স্বাদের মতো। সবুজ পাহাড় অবগাহন করছে বৃষ্টিতে। ঝুলে আছে বিভিন্ন রঙের বাড়ি। নিশ্বাসে অন্যরকম আনন্দ তখন। পানির জন্য বেশ সংগ্রাম করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। বৃষ্টি তাই আশীর্বাদ।
চকলেট-মসলার পসরা
সাউথ ইন্ডিয়ান ইডলি, দোসার পাশাপাশি কন্টিনেন্টালে নাস্তা সেরে এবার চারপাশটা দেখার পালা। রিসোর্টের সামনে নানান প্রজাতির ফুল চোখ জুড়ালো। সবুজ দেয়াল তৈরি করে রাখা ঝুলন্ত টবের সব গাছে ফুল নেই। চারপাশের পরিচ্ছন্ন আর নির্মল বিশুদ্ধ বাতাস হৃদয় জুড়ায়। বৃষ্টি তখনও পিছু ছাড়েনি। এরমধ্যেই বেরিয়ে পড়া।
ছবির মতো শহর উটি
প্রকৃতিকে এরা আঘাত না দিয়েই জীবন গড়েছে। সেটা এখানে অনুভূত হয়। জীবনের তাগিদে যতটুকু কাঁটাছেঁড়া করা দরকার ঠিক ততটাই। প্লাস্টিক এখানে নিষিদ্ধ। রুমের পানির বোতলও সব কাচের। কোনো পণ্য কিনলে মেলে কাগজ কিংবা কাপড়ের ব্যাগ। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এখানে প্রচুর চা, কফি ও চকলেট হয়। উটি শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরের একটি চা জাদুঘরে নিয়ে গেলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সাব-ইন্সপেক্টর।
দেয়ালগুলো সেজেছে এভাবে
এ এক অন্যরকম জাদুঘর। টিকিট ১০ রুপি। ভেতরে ঢুকে চোখে পড়লো এ অঞ্চলে চায়ের ইতিহাস সম্বলিত কিছু ছবি। চায়ের কাঁচাপাতার ঘ্রাণ লাগছে নাকে এসে। একটু ঘুরে তাকিয়ে দেখা গেলো চায়ের পাতা একেকটি কন্টেইনারে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে মেশিনের মধ্যে। এটি একটি চা কারখানাও। দর্শনার্থীদের কাছে বড় আকর্ষণ এটি। চা উৎপাদন লাইভ দেখা।
প্যাঁচানো লোহার ঘেরা পথ ধরে যখন চা উৎপাদনের সব প্রক্রিয়া শেষ তখন নিচে নামতেই চমক দেবে উৎপাদিত টাটকা চায়ের গরম গরম এক কাপ চা। দর্শনার্থীদের জন্য এটা ফ্রি। বাইরে বেরিয়ে সারি ধরে চায়ের দোকান। সেখান থেকে কেনা যাবে হরেক পদের চা। সর্বনিম্ন ২শ টাকা থেকে শুরু সর্বোচ্চ নয় হাজার টাকা দামের চা কিনতে পারবেন এখানে। এছাড়া টি অয়েল থেকে শুরু করে মিলবে বিভিন্ন হারবাল পণ্য।
উটির পথে পথে থরে থরে ফোটা ফুল
চমক এখানেই শেষ নয়, চা দেখে বের হওয়া যাবে না। আবার উপরে উঠতে হবে। এবার চকলেট কারখানা দেখার পালা। হাতে তৈরি চকলেট সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে বিখ্যাত। সেই চকলেট তৈরি দেখা এবং কেনার সুযোগও আছে। দাম কেজিপ্রতি ৮শ থেকে ২ হাজার রুপি পর্যন্ত। ফ্যাক্টরির বাইরে পরিবেশটাও মন ভোলানো। পর্যটকদের কীভাবে আকর্ষণ করতে হয় এরা তা জানে।
পাহাড় সব সময়ই বৈচিত্র্যের আধার। ঘোরার জন্য বিশেষ কোনো জায়গা না হলেও চলে। পথেঘাটে চলতে ফিরতে প্রকৃতি যে পসরা সাজিয়ে বসে আছে সেটাই বা কম কী।
অপরূপ উটি
উটি মূলত নীলগিরি জেলার পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত। প্রশাসনিক সদরদপ্তর উটি (ওটাকামুদ বা উধাগমন্ডলম নামেও পরিচিত)। জেলাটি পশ্চিমে কেরালার মালাপ্পুরম জেলা, দক্ষিণে কোয়েম্বাতুর ও পালাক্কাদ, পূর্বে ইরোড এবং কর্ণাটকের চামরাজনগর জেলা এবং উত্তরে কেরালার ওয়ানাদ জেলায় ঘেরা। তিনটি রাজ্য তামিলনাড়ু, কেরালা ও কর্ণাটকের সংযোগস্থলে অবস্থিত। জনসংখ্যার অধিকাংশ মালয়ালি ও কান্নাডিগা।
অনেকগুলো ঘোরার জন্য বিশেষ জায়গা থাকলেও বোটনিক্যাল গার্ডেন ছাড়া অন্য জায়গাগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি একদিনে। তামিলনাড়ু হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের অধীনে পরিচালিত ২২ একরের উদ্যানটিও বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানের বিশেষ আকর্ষণ মাঙ্কি পাজল ট্রি ও দুই কোটি বছর আগের একটি গাছের জীবাশ্ম। মাঙ্কি পাজল ট্রির বিশেষত্ব হলো প্রায় সব গাছে চড়তে পারলেও বানর এতে চড়তে পারে না। এ গাছ সাতশ বছর বাঁচে। উদ্যানে দুটি গাছ রয়েছে। একটি শতবর্ষী। গাছের পাতা দেখতে ছোট সবুজ হলেও পাতা বেশ শক্ত এবং কাঁটার মতো। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল, অর্কিডসহ কয়েক হাজার প্রজাতির গাছ।
যেন দূর থেকে ভ্রমণপিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকে সে
সময় থাকলে আরও ঘুরে আসতে পারেন রোজ গার্ডেন (দুই হাজারের বেশি প্রজাতির গোলাপ আছে কালো ও সবুজসহ), উটির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দোদাবেত্তা (২৬২৩ মিটার), উটি লেক, কালাহাটি জলপ্রপাত, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ নীলগিরি মাউন্টেন রেল স্টেশন প্রভৃতি জায়গা। সময় মিললে চড়তে পারেন টয়ট্রেনেও।
ফার্ন হিল রিসোর্টের সার্ভিস ম্যানেজার যোগেশ মেহতা জাগো নিউজকে বলেন, উটিতে মানুষ বেড়াতে আসার অন্যতম কারণ এখানকার আবহাওয়া। সব সময় সহনীয় তাপমাত্রা থাকে। দেশের অন্য জায়গায় যত গরম পড়ুক উটির তাপমাত্রা কম থাকে। দক্ষিণের তিন রাজ্যের সংযোগ হওয়ায় এখানে দক্ষিণের লোকই আসে বেশি। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী আসে ঘুরতে, জানতে।
পাহাড়-সমতলের শহর উটি
কেনাকাটাউটি হাতে তৈরি ট্র্যাডিশনাল চকলেট, চা পাতা, কফি, টোডাদের তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্পের জন্য নামকরা। এছাড়া শীতপ্রধান জায়গা হওয়ায় শীতের শাল, জ্যাকেট, সোয়েটার পাবেন বেশ সস্তায়। তাদের ট্র্যাডিশনাল পোশাক ছেলেদের লুঙ্গি, সাদা জামা, বেল্ট ও পাগড়ি বা ওড়নাও পাবেন মোটামুটি সস্তায়। খুব ভালো মানের সব ধরনের মসলা পাবেন এখানে। কেনাকাটার জন্য মার্কেট রয়েছে সব পর্যটন স্পট ঘিরে। তবে লোকাল মার্কেটে দাম কম। কোনো অটোওয়ালাকে বললে তিন-চার ঘণ্টায় পুরো শহর ঘোরাবে মাত্র হাজার রুপিতে।
যাতায়াতপ্লেন বা ট্রেনে যেতে গেলে ভারতের যে কোনো প্রান্ত থেকে যেতে হবে কোয়েম্বাতুর জেলায়। ওখান থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার সমতল ও পাহাড়ি পথ বেয়ে উটি।
থাকা-খাওয়াথাকার জন্য প্রচুর সংখ্যক হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে এখানে। সব মানের রুম পাবেন। সিজনে গেলে আগে বুকিং দিয়ে যেতে হবে। আর দক্ষিণ ভারতের বিশেষ সব মসলাযুক্ত খাবার আপনার না-ও পছন্দ হতে পারে। তবে ইডলি, দোসা, চিকেন সিক্সটি ফাইভ, নারিকেলের বিভিন্ন পদ, চানা মসলা, বিভিন্ন ধরনের চাটনি চেখে দেখতে পারেন।
এএসএ/এমকেআর/জেআইএম