রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্য সব দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে। দেশে গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিং হচ্ছে। এতে অনেক জায়গায়ই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে সেপ্টেম্বর নাগাদ।
Advertisement
জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। রাজধানীতেও এর প্রভাব পড়েছে। গত ৩ জুন থেকে দিনের বেলায় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ার পর লোডশেডিং মোটামুটি বিদায় নিয়েছিল। বিদ্যুতের ভোগান্তির কথা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল।
শহরে বিদ্যুৎবিভ্রাট হতো না বললেই চলে। এখন সেই লোডশেডিং আবার ফিরেছে। দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এছাড়াও বিদেশ থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়। তবে স্বস্তির কথা এই যে, ঈদের সময় লোডশেডিং ছিল না বললেই চলে।
বিদ্যুতের এ সমস্যা যে শুধু আমাদেরই তা নয়। সমস্যা শুরু হয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে। উন্নত অনুন্নত কেউ বাদ নেই। পরিচ্ছন্ন, নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণের দেশ এবং ধনী অস্ট্রেলিয়া এখন বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী ক্রিস বোয়েন। একই সঙ্গে সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। বিশ্বে কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানিতে তালিকার শীর্ষের দিকে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
Advertisement
দেশটির চার ভাগের তিন ভাগ বিদ্যুৎই কয়লা ব্যবহার করে উৎপাদন করা হয়। এরপরও গত মে মাস থেকে বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে দেশটি। এই সংকটের পেছনে কারণও রয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে নিউ সাউথ ওয়েলস ও কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের কয়েকটি কয়লার খনি পানিতে তলিয়ে যায়।
প্রযুক্তিগত কারণেও দুটি খনি থেকে কয়লা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। খনিগুলো থেকে নিউ সাউথ ওয়েলসের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ হয়। এ মুহূর্তে নানা সমস্যার মুখে অস্ট্রেলিয়ার চার ভাগের এক ভাগ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে বিদ্যুতের বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
উন্নত দেশ ছাড়া আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি নাজুক। বিশ্বের অন্যতম পিছিয়ে পড়া দেশ পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সংকট এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, দেশটির টেলিকম অপারেটররা তাদের মোবাইল এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। গত ৩০ জুন এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যম জিও নিউজ।
কয়লা সংকটের পাশাপাশি গ্রীষ্মের চরম দাবপ্রবাহের কারণে ভারতজুড়ে নিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিচ্ছে। ফলে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার। চলতি বছরের টানা তাপপ্রবাহের কারণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং শিল্পকারখানার কর্মকাণ্ডে কোভিড সংক্রান্ত সব বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কার্যক্রমে ভারতের বিদ্যুতের চাহিদা রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। এই চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ভারত সরকার।
Advertisement
আমরা সবাই জানি শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংকটেও নাজেহাল। শ্রীলঙ্কা বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এখন এক অন্ধকার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে আমাদের এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক জায়ান্ট চীনের বিদ্যুৎ পরিস্থিতিও মারাত্মক খারাপ। বিদ্যুতের জন্য চীন কয়লার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। চীনের কিছু কর্মকর্তা ও স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় এর সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গোটা দুনিয়ার দেশে দেশে যখন বিদ্যুতের এই অবস্থা, তখন আমাদেরও এর বাইরে থাকার সুযোগ নেই। আমাদেরও নির্ভর করতে হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল কয়লা কিংবা এলএনজি আমদানির ওপর, আন্তর্জাতিক বাজারে যার দাম এই মুহূর্তে আকাশছোঁয়া।
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার এই সময় আমদানি যত কম করা যায়, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। সরকারের কাছে প্রত্যাশার পারদ ওপরে থাকার পাশাপাশি আমাদের সব নাগরিকের সহনশীল আচরণও কাম্য। দেশের জনগণকে শুধু একবার মনে করতে বলব, ২০০১-২০০৬ আমলে সেই সময়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে নেগোসিয়েট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে বাংলাদেশকে জেনারেটর, ইউপিএস বাজার বানানোর আমলের কথা কিংবা বৈদ্যুতিক তারবিহীন খাম্বা-খুঁটির দেশে পরিণত করার কথা। সেই সময় থেকে বাংলাদেশের এখনকার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেক ভালো। কারণ, বাংলাদেশের এখন চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭, যা এখন ১৫২টিতে দাঁড়িয়েছে। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রতিদিন ৫ হাজার মেগাওয়াটের কম, যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ)। অবশ্য এত বিদ্যুতের চাহিদা দেশে নেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৫-১৬ হাজার মেগাওয়াট। বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করে অনেক কেন্দ্রকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দেওয়া, বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, এখন সরকার লোডশেডিং করছে এক প্রকার বাধ্য হয়ে। সরবরাহ সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম চড়া। তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আপাতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০২০ সালে যে গ্যাস প্রতি ইউনিট ৪ মার্কিন ডলারে নেমে গিয়েছিল, তা এখন বেড়ে ৩৮ ডলার ছাড়িয়েছে।
সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে। এতে নতুন করে এলএনজি গ্যাস কিনতে বিপুল বাড়তি ব্যয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে। তাই সরকার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলেই মনে হয়। কারণ, এই মুহূর্তে বাড়তি দামে কিনতে গেলেও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর মারাত্মক চাপ পড়বে, যা পরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনৈতিক চাপের এই সময়ে মারাত্মক হুমকিতে ফেলতে পারে। হয়তো জনগণের কিছুটা কষ্ট হবে, কিন্তু তারপরও এখন সময় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের। এর কোনো বিকল্প নেই।
সার্বিক বিবেচনায় এখনকার সমস্যাটা সাময়িক বলেই মনে হয়। যেটি জ্বালানি সংকট কাটলেই স্বাভাবিক হবে। কাজেই কোনোভাবেই আমাদের আবার জেনারেটর, ইউপিএস বাজারে পরিণত হওয়ার সুযোগ নেই। বিদ্যুতের তারবিহীন খাম্বা-খুঁটির দেশেও পরিণত হবে না, এটা নিশ্চিত। অপেক্ষা শুধু সুসময়ের জন্য।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম