দেশজুড়ে

২১ বছরেও শেষ হয়নি জাপা নেতা কাশেম হত্যার বিচার

খুলনা মহানগর জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ আবুল কাশেম ও তার ড্রাইভার মিখাইল হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পার হলেও এখনো শেষ হয়নি বিচার কাজ। এই মামলার বাদী, প্রধান সাক্ষী, তদন্ত কর্মকর্তা ও দুই আসামির মৃত্যু হলেও উচ্চ আদালতের কয়েক দফা স্থগিত আদেশে মামলার বিচার কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের ২৫ এপ্রিল দুপুরে খুলনা সদর থানার অদূরে স্যার ইকবাল রোড়ে বেসিক ব্যাংকের সামনে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গুলিতে শেখ আবুল কাশেম ও তার ড্রাইভার মিখাইল নিহত হন। হত্যাকাণ্ডটি ঘটে খুলনা থানা থেকে মাত্র ২৫ হাত দূরত্বে মধ্যে।শেখ আবুল কাশেমের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ আবুল কাশেম দলবল নিয়ে জাতীয় পার্টি হতে বিএনপিতে যোগদান করবে এমন কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়েছিল সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর সঙ্গে। এই বিএনপিতে যোগদান আর চিংড়ি ঘেরবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এনজিওদের অর্থায়নে সেই সময় এই ডবল মার্ডারটি হয়। শেখ আবুল কাশেম হত্যাকাণ্ডের পর বদলা নিতে গিয়ে নিহত হন এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সাবেক ডেপুটি মেয়র জাপা নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন বাবুল। বাবুল হত্যাকাণ্ডের মামলায় কাশেম পরিবারের একাধিক সদস্যকে আসামি করা হয়। যে মামলায় সকল আসামি পরে বেকসুল খালাস পান। পরে নিহত কাশেম পরিবারের আশ্রয়দাতা হিসাবে চরমপন্থিদের হাতে নিহত হন আওয়ামী লীগের ঘোষিত মেয়র প্রার্থী এসএমএ রব। সে মামলায় বিচারকাজ শেষে সকল আসামি খালাস পেয়ে যায়।এসএমএ  রব হত্যার পর মহানগর আওয়ামী  লীগের সভাপতি অ্যাড মঞ্জুরুল ইমামসহ তিনজন চরমপন্থিদের হাতে নিহত হন। এই সময় চরমপন্থিদের বক্তব্য ছিল শেখ আবুল কাশেমের ভাইপো আসাদুজ্জামান লিটরে আশ্রয়দাতা হিসেবে মঞ্জুরুল ইমামকে হত্যা করা হয়। একইভাবে পরস্পর বিরোধী দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ধারাবাহিক বিরোধের জের হিসেবে খুন হয় গনেশ, সুজা, ছাত্রদল নেতা ওয়াহেদুজ্জামান চঞ্চল। শেখ আবুল কাশেম হত্যাকেণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে শিল্পপতি সৈয়দ মনিরুল ইসলামকে এরশাদ শিকদার বেদম প্রহর করে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়।  একইভাবে আসাদুজ্জামান লিটুকে ক্রশফায়ারে হত্যা করার পেছনে বড় বড় প্রভাবশালীরা কলকাটি নেড়েছিল। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কাশেম হত্যার পর পরস্পর বিরোধী ঘটনায় ৬/৭ জন একই কায়দায় খুন হয়।খুলনা থানায় মামলা দায়ের হলেও পরে মামলাটি তদন্তর দায়িত্ব পড়ে সিআইডির উপর। তারা দীর্ঘ তদন্ত করে ৫ মে ১৯৯৬ সালে দশজনের নামে চার্জশিট দাখিল করে। চার্জশিটে আসামি ছিলেন- সৈয়দ মনিরুল ইসলাম (আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পপতি), তরিকুল হুদা টপি, (সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমান  ব্যবসায়ী), আব্দুল গফফার বিশ্বাস, (জাপা নেতা ও সাবেক এমপি), ইকতিয়ার উদ্দিন বাবলু (বিএনপি নেতা সাবেক ডেপুটি মেয়র, গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত), কাজী  আমিনুল হক (সাবেক মেয়র, আওয়ামী লীগ নেতা, বর্তমানে খুলনা চেম্বার প্রেসিডেন্ট), ওসিকুর রহমান, (সাবেক জাপা নেতা, বর্তমানে ঢাকায় ব্যবসায়ী), মোশফেকুর রহমান (সাবেক ছাত্রদল নেতা, বর্তমানে ঢাকায় ব্যবসায়ী, ২০০৮ সালে বাগেরহাটে বিএনপির এমপি প্রার্থী ছিল), মফিজুর রহমান (প্রথম থেকেই পলাতক), মিল্টন (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) তারেক (চরমপন্থি নেতা)।কিন্তু এই দশ আসামির বেশির ভাগ বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা ও বিত্তবান হওয়াই মামলাটি বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ৮ জুন বিচার কাজ শুরু হলেও দীর্ঘদিনে শেষ হয়নি। বিচার কাজ শুরুর প্রথম দিনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় সিআরপিসি ৪৯৪ ধারামতে প্রজ্ঞাপনে চার্জশিট হতে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মেয়র কাজী আমিনুল হকের নাম বাদ দেয়। বাদী পক্ষ এই প্রজ্ঞাপনের বিরদ্ধে না রাজি দিয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করলে প্রথম মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। পরে বাদী পক্ষ কাজী আমিনুল হকের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে তাকে বাদ দিয়ে বিচার কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়। এই সময় অপর আওয়ামী লীগ নেতা শিল্পপতি সৈয়দ মনিরুল ইসলাম নিজের অংশ বাদ রেখে বিচার চালানোর আবেদন করলে উচ্চ আদালত মামলার বিচার কাজ স্থগিত করে।এ বিষয়ে নিহতর বড় ভাই জাপা নেতা আলহাজ্ব শেখ আবুল হোসেন  দীর্ঘদিনেও বিচারকাজ শেষ না হওয়াই হতাশা ব্যক্ত করেন এবং এই মামলার কারণে নিহতের ভাইপো মামলার প্রধান সাক্ষী আসাদুজ্জামান লিটু ওয়ার্ড কাউন্সিলার ক্রসফায়ারে নিহত হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় মামলার সাক্ষীদের হুমকি দেয়া হয়। আবুল হোসেন বলেন, আলোচিত এ হত্যা মামলার বিচার কাজে যদি এতো বাধা আসে তাহলে সাধারণ মামলার বিচার হবে কিভাবে ? তিনি হতাশা থেকে বলেন, তারা বিচারের ভার আল্লার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, মামলা বাদী দশ বছর আগে ইন্তেকাল করেছে। প্রধান সাক্ষী আসাদুজ্জামান লিটুকে ক্রসফায়ায়ে হত্যা করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসপি খোন্দকার ইকবাল  নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, তারা কোনো স্থগিত আদেশ ভ্যাকেট করার চেষ্টা করেননি।নিহত শেখ আবুল কাশেমের স্ত্রী আর পুত্র সন্তানরা হতাশা থেকে মামলার ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি নন ।কয়েক দফা এইভাবে মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকার পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খুলনার বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে ২৪ এপ্রিল ২০০৮ পুনরায় বিচার কাজ শুরু হয়। এই সময় মোট ৩২ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য হওয়ার পর ২০ নভেম্বর ২০০৮ মামলাটি নিদিষ্ট সময় শেষ না হওয়াই জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইবুনালে ফেরত আসে। সৈয়দ মনিরুল ইসলামের পর জাপা নেতা আব্দুল গফফার বিশ্বাসের পক্ষে পরে ২০০৮, ২০০৯, ২০১৪ সালের আবারও উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। সেই থেকে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের পর আর গত ৮ বছর ধরে মামলার বিচার কাজ পুরাপুরি স্থগিত।সাবেক এমপি আব্দুল গাফফার বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, শেখ আবুল কাশেম তার ঘনিষ্ঠ আত্নীয়। তিনি চান মামলার কার্যক্রম দ্রুত শেষ হোক। উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকার কারণে মামলা পরিচালনা করতে পারছেন না স্বীকার করেন জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী দ্রুত অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি অ্যাড আরিফ মামমুদ লিটন। তিনি বলেন, শেখ আবুল কাশেম খুলনার জনপ্রিয় জননেতা ছিলেন। তার মামলাটি এভাবে স্থগিত থাকা উচিত নয়। তিনি জানান, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ভ্যাকেট করার জন্য বাদীকেও উদ্যোগ নিতে হবে।আলমগীর হান্নান/এসএস/আরআইপি

Advertisement