মতামত

চীনে কৃষিকাজ আরও ফলপ্রদ করছে পেইতৌ

পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান শত শত কৃত্রিম উপগ্রহ মর্তবাসীকে বিভিন্ন ধরনের জটিল জটিল সব সেবা দিয়ে থাকে। তেমনি একটি সেবা হচ্ছে ‘স্বাধীন ভূ-স্থানিক অবস্থান’ (autonomous geo-spatial positioning) সেবা। কৃত্রিম উপগ্রহ, ইলেক্ট্রনিক রিসিভার ইত্যাদির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যে ব্যবস্থা এই সেবা দিয়ে থাকে, তাকে বলা হয় স্যাটেলাইট ন্যাভ্যাগেশন সিস্টেম (satellite navigation system)। এ ব্যবস্থা ব্যবহার করে, একটি ছোট ইলেক্ট্রনিক রিসিভারের সাহায্যে, পৃথিবীর যে কোনো স্থানের যে কোনো বস্তুর অবস্থান মোটামুটি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায়। আমরা প্রতিনিয়ত স্মার্টফোনের মাধ্যমে, জেনে বা না জেনে, এমন ধাতের সেবা গ্রহণ করছি। এই সেবা আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে, করেছে সহজতর।

Advertisement

কোনো স্যাটেলাইট ন্যাভ্যাগেশন সিস্টেম যখন বিশ্বব্যাপী এমন সেবা দেয় বা দিতে পারে, তখন তাকে আমরা বলি ‘গ্লোবাল ন্যাভ্যাগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ (জিএনএসএস)। বিশ্বে এই মুহূর্তে এমন জিএনএসএস আছে চারটি: যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস), রাশিয়ার ‘গ্লোবাল ন্যাভ্যাগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (জিএলওএনএএসএস), চীনের ‘পেইতৌ ন্যাভ্যাগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (বিডিএস), এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘গ্যালিলিও’।

এই চারটি ব্যবস্থার মধ্যে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান সক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহের সংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে চীনের বিডিএস। এই ব্যবস্থার অধীনে কক্ষপথে উপগ্রহ আছে ৩৫টি। এক্ষেত্রে ৩১টি করে সক্রিয় উপগ্রহ নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জিপিএস এবং রাশিয়ার জিএলওএনএএসএস। ইউরোপের ‘গ্যালিলিও’-র আছে ২৩টি সক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহ।

জাপানেরও একটি স্যাটেলাইট ন্যাভ্যাগেশন সিস্টেম আছে। তবে, সেটির কাজ খানিকটা ভিন্ন। ‘কোয়াসাই-জিনিথ স্যাটেলাইট সিস্টেম’ (কিউজেডএসএস) নামক এ ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের জিপিএস’র নির্ভুলতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। তবে ২০২৩ সাল নাগাদ এই সিস্টেমের জিপিএসনির্ভরতা ঝেড়ে ফেলে একে স্বাধীন ন্যাভ্যাগেশন সিস্টেম হিসেবে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ওদিকে, ভারতের ‘ইন্ডিয়ান রিজনাল স্যাটেলাইট ন্যাভ্যাগেশন সিস্টেমকে (আইআরএনএসএস) দূর ভবিষ্যতে জিএনএসএসে রূপান্তরের পরিকল্পনা আছে দেশটির সরকারের।

Advertisement

আমরা যখন চীনের বিডিএসের কথা বলি, তখন বোঝাই ‘পেইতৌ-৩’-কে। বর্তমানে চীনের ‘পেইতৌ-৩’ ব্যবস্থার ৩৫টি কৃত্রিম যোগাযোগ-উপগ্রহ মহাশূন্যে সক্রিয় আছে। এ ব্যবস্থার প্রথম উপগ্রহটি মহাশূন্যে পাঠানো হয় ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ এবং সর্বশেষটি ২০২০ সালের ২৩ জুন।

‘পেইতৌ-৩’ যখন আছে, তখন ‘পেইতৌ-১’ ও ‘পেইতৌ-২’-এর অস্তিত্বও থাকার কথা। ১৯৯৪ সালে ‘পেইতৌ-১’ যোগাযোগ-উপগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল চীনে। পেইতৌ-১ ব্যবস্থার অধীনে উপগ্রহ ছিল মাত্র ৩টি। এই ব্যবস্থা মূলত চীনের ও আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর বাসিন্দাদের সেবা দিত। ২০১২ সালের শেষদিকে এসে পেইতৌ-১ পরিত্যক্ত হয়।

এর আগে ‘পেইতৌ-২’ নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। ২০০৯ সালে ‘পেইতৌ বৈশ্বিক উপগ্রহ ন্যাভ্যাগেশন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ শুরু হয়। ২০১২ সালের শেষ দিকে ১৪টি কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে গঠিত হয় একটি নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় বিভিন্ন সেবা দিতে শুরু করে। এসব সেবার মধ্যে ছিল- পজিশনিং, ন্যাভ্যাগেশন, টাইমিং, ও ইউনিক শর্ট মেসেজসেবা। ২০১৮ সালের শেষ দিক থেকে ‘পেইতৌ ব্যবস্থা’র মৌলিক সেবার আওতায় আসে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট দেশ ও অঞ্চলগুলো। বর্তমানে ‘পেইতৌ-৩’র সেবার আওতায় এসেছে গোটা বিশ্ব।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। চীন বিশাল দেশ। দেশটির লোকসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। অন্যভাবে বললে, বিশ্বের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষের বাস এই ভূখণ্ডটিতে। অথচ এই দেশে আবাদযোগ্য কৃষিজমির পরিমাণ বিশ্বের মোট আবাদযোগ্য কৃষিজমির মাত্র ১০ শতাংশ (১২ কোটি ৭৯ লাখ হেক্টর)। অর্থাৎ বিশ্বের ১০ শতাংশ কৃষিজমিতে ফসল ফলিয়ে দেশটিকে বিশ্বের ২২ শতাংশ মানুষের মুখের আহার জোগাতে হয়। উল্লেখ করার মতো তথ্য হচ্ছে, এই ১০ শতাংশ জমিতেই চীনারা বিশ্বের ২১ শতাংশ শস্য উত্পাদন করে। এছাড়া বছরে বিশ্বের যত ফলমূল উত্পন্ন হয়, তার প্রায় ৩০ শতাংশই চীনের অবদান।

Advertisement

দৃশ্যত চীন কৃষি-উত্পাদনের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে এ অগ্রগতিও যথেষ্ট নয়। গত ১০ বছরে দেশটিতে আবাদযোগ্য কৃষিজমি কমেছে প্রায় ৭৫ লাখ হেক্টর। এ অব্স্থায় টিকে থাকা আবাদি জমি সংরক্ষণ করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য সীমিত কৃষিজমিতে খাদ্যশস্য উত্পাদন বাড়ানোও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চীনের কৃষিবিজ্ঞানীরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রচেষ্টায়, বিজ্ঞানের অন্যান্য হাতিয়ারের মতো, ব্যবহৃত হচ্ছে পেইতৌ উপগ্রহ ন্যাভ্যাগেশন সিস্টেমও।

চীনের অধিকাংশ কৃষিজমিতে চাষবাসে যন্ত্রের ব্যবহার আছে। যন্ত্র কৃষিকাজকে সহজতর করেছে। এসব যন্ত্রকে আবার দিন দিন আরও আধুনিক ও ফলপ্রদ করতে কাজ করে যাচ্ছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এদিকে, পেইতৌ ব্যবস্থা এসব যন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়াচ্ছে। কীভাবে? একটা উদাহরণ দিই। শানতুং প্রদেশের ফিংইউয়ান কাউন্টির ‘ফিংইউয়ান লুওয়াং কৃষি উন্নয়ন কোম্পানি’ কৃষিকাজে পেইতৌ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ট্রাক্টর ব্যবহার করছে গত ১৫ জুন থেকে।

এই ট্রাক্টরের সাহায্যে কৃষকরা ভুট্টা ক্ষেতে, দ্বিতীয় ফসল হিসেবে, সয়াবিন চাষ করেছেন। ভুট্টা গাছের সারির মাঝখানে নিখুঁতভাবে সয়াবিনের চারা রোপণ করেছে পেইতৌসমৃদ্ধ ট্রাক্টর। বলা বাহুল্য, এ বছরই প্রথম কোম্পানি দুটি ফসল একই সঙ্গে একই ক্ষেতে চাষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এতে ভুট্টার ফলন হ্রাস পাবে না অথচ অতিরিক্ত ফলস হিসেবে সয়াবিন পাওয়া যাবে।

জমিতে একাধিক শস্যের চারার মিশ্র রোপণের জন্য জরুরি হচ্ছে নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা। পেইতৌসমৃদ্ধ ট্রাক্টর এ কাজটা করতে পারছে নিখুঁতভাবে। শুধু তাই নয়, কাজের গতিও অনেক দ্রুত। মাত্র দুদিনে ৪০ হেক্টর জমিতে রোপণের কাজ সম্পন্ন করা গেছে। চারা রোপণের পাশাপাশি, কোম্পানি পেইতৌ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত ড্রোন দিয়ে জমিতে সার ছিটানোর কাজও করছে। এতে সার লাগছে তুলনামূলকভাবে কম; কারণ, অপচয় কমেছে। আর সারের যথাযথ ও পরিমিত ব্যবহার ফলন বৃদ্ধি ও কৃষিজমি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কল্যাণকর প্রমাণিত হচ্ছে।

শুধু শানতুং প্রদেশে নয়, চীনের অন্যান্য প্রদেশেও কৃষিকাজে পেইতৌ ব্যবস্থার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। হুপেই প্রদেশে এখন পর্যন্ত ৩৮৮৫টি সমবায়ের অধীনে ২৭,৪০৭টি কৃষিযন্ত্র পেইতৌ সেবার আওতায় আনা হয়েছে। এসব যন্ত্রের মধ্যে আছে ট্রাক্টর, ফসল কাটার যন্ত্র, শস্য শুকানোর যন্ত্র, সার ছিটানোর যন্ত্র ইত্যাদি।

হুপেই প্রদেশের উহানের হুয়াংফি ডিস্ট্রিক্টের ইয়ংওয়াং কৃষি যন্ত্রপাতি সমবায় সমিতির সব কৃষিযন্ত্র ইতোমধ্যে পেইতৌ সেবার আওতায় এসেছে। ২০১৫ সালে এ সমবায় সমিতি কৃষিজমি জরিপের কাজে পেইতৌর সেবা গ্রহণ করা শুরু করেছিল। পরে ফসল চাষ, আগাছা বাছাই, ফসল তোলা, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সব কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে তারা পেইতৌর সেবা গ্রহণ করছে।

চীনের সরকার কৃষকদের উত্সাহিত করছে কৃষিযন্ত্রে পেইতৌ সেবা ব্যবহার করতে। এ লক্ষ্যে ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে। যদি কোনো কৃষক পেইতৌসমৃদ্ধ কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করেন, তবে তিনি ভর্তুকি পাবেন ৮ হাজার ইউয়ান (প্রায় ১১৯৫ মার্কিন ডলার)। চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই দেশের প্রায় ৬ লাখ কৃষিযন্ত্রকে পেইতৌর সেবার আওতায় আনতে চায়। এই লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে সুষ্ঠুভাবে।

উহানের ইয়ংওয়াং সমবায় সমিতির স্মার্ট কৃষিযন্ত্রচালক থাও চ্য। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন গত বছর। সেই থেকে এখানে কাজ করছেন। তার কথা দিয়ে লেখার ইতি টানছি। তিনি চায়না ডেইলিকে সম্প্রতি জানান, কৃষিজমির হাল-হকিকত দেখার জন্য তাকে অকুস্থলে যেতে হয় না, তার হাতের স্মার্ট মোবাইলটিইয়ের জন্য যথেষ্ট। তিনি আরও বলেন, ‘প্রযুক্তি আমাদের কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। ক’দিন আগে আমার বাবা-মা কৃষিজমিতে স্মার্ট যন্ত্রপাতির ক্যারিশমা দেখতে এসেছিলেন। স্বয়ংক্রিয় ট্রাক্টরের নিখুঁত কাজ দেখে তারা তো অবাক! তাদের আমলের কৃষিকাজ আর এখনকার কৃষিকাজের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পেইতৌর মতো আধুনিক প্রযুক্তির।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimuh@yahoo.com

এইচআর/ফারুক/জেআইএম