দুই বছর পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। অনেকদিন ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপর স্থিতিশীল থাকার পর নিচে নামাটা কিছুটা অস্বস্তির হলেও শঙ্কিত হওয়ার মতো নয়। কারণ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে মানে ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। মূলত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়ই রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। তবে এখনও বাংলাদেশের সাড়ে ৫ মানের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ আছে। সাধারণভাবে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মূদ্রা থাকলেই নিরাপদ মনে করা হয়। তাই নিরাপদ সীমার প্রায় দ্বিগুণ রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ধরে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
Advertisement
তবে শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া দশার সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়ায় অনেকে খুব উল্লসিত। তারা ভাবছেন, এই বুঝি বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে গেলো। যারা উল্লসিত, তাদের জন্য একটা ছোট্ট তথ্য দেই। তাদের প্রিয় তুরস্কের রিজার্ভ এখন ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম, মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার। আর পাকিস্তানের রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলার। সেদিন ফেসবুকে একজন লিখেছেন, পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় থাকলেও পাঁচ মাস পর কী হবে? তার ধারণা, পাঁচ মাস পর বাংলাদেশের রিজার্ভ বুঝি শূন্য হয়ে যাবে। তাকে বোঝানোর জন্য একটা ছোট্ট তথ্য, এই পাঁচ মাসে বাংলাদেশ তো শুধু কিনবে না, বিক্রিও তো করবে। তাই বাংলাদেশের রিজার্ভ ফুরিয়ে যাওয়া বা বিপজ্জনক সীমায় নেমে যাওয়ার মতো কিছু ঘটবে না। আমদানি ব্যয় বেড়েছে এটা যেমন সত্যি, আবার গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে; সেটাও স্বস্তির।
বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে তিন ‘আর’র ওপর। পর্যাপ্ত রাইস মানে ধান উৎপাদন করে কৃষকরা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত রেখেছেন। বাকি দুটি ‘আর’ হলো আমাদের রিজার্ভের মূল উৎস। আরএমজি মানে তৈরি পোশাক থেকে আসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ। তৃতীয় ‘আর’ মানে রেমিট্যান্স হলো আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অটো উৎস। যেদিন পত্রিকায় রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়ার খবরটি ছিল, সেদিনের পত্রিকায়ই ঈদের আগে রেমিট্যান্সে বিশাল উল্লম্ফনের খবরও ছিল। ঈদের ছুটির আগের সাতদিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার, মানে ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
এই যে আমাদের প্রবাসী ভাইবোনরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখছেন, রিজার্ভ বাড়াচ্ছেন, তাদের জন্য আমরা কী করছি? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আসলে আমরা কিছুই করছি না। সস্তায় শ্রম কেনা যায় বলে বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের শ্রমিকরা ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ প্রবাসী। তবে এই প্রবাসীদের দুটি ধরন আছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় অনেকেই আছেন; যারা একেবারে বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। তারা সেখানে গিয়ে প্রথমেই থাকার অনুমতি জোগাড় করেন।
Advertisement
পরে ধীরে ধীরে নাগরিকত্ব নিয়ে নেন। তারা বাংলাদেশ থেকে নিজেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে সেসব দেশে নিয়ে যান। সেখানে বাড়ি-গাড়ি কেনেন, আয়েশি জীবনযাপন করেন। এই উচ্চবিত্তের প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনো উপকার তো করেনই না, বরং দেশের সম্পদ পাচার করে দেশের বারোটা বাজান। আরেক ধরনের প্রবাসী হলেন, যারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নিজের রক্ত পানি করে অর্থ উপার্জন করে। নিজে সেখানে অমানবিক জীবনযাপন করে উপার্জিত অর্থের প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।
এরাই আমাদের অর্থনীতির আসল বন্ধু, আদর করে এদের আমরা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলি, কিন্তু এই যোদ্ধাদের কোনো মর্যাদা দেই না। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা পদে পদে প্রতারিত হন, বঞ্চিত হন, অপমানিত হন। যাওয়ার আগে তারা প্রতারিত হতে পারেন, গিয়েও অনেকে কাঙ্ক্ষিত কাজ পান না। অনেকে নিঃস্ব হয়ে যান, অনেকের প্রাণও যায়। সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র অমানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। বিদেশে আমাদের হাইকমিশনেও এদের সাথে কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ করা হয়।
বিমানবন্দরে দুই ধরনের প্রবাসীর সাথে দুই ধরনের আচরণ করা হয়। যারা দেশ থেকে অর্থপাচার করে নিয়ে যান, আসা-যাওয়ার পথে তারা ভিআইপি মর্যাদা পান। আর যারা রক্ত পানি করা অর্থ দেশে পাঠান, তাদের মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না। গ্রামের অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলো বিমানবন্দরে ফরম পূরণ করা থেকে শুরু করে নানা ফর্মালিটিজ শেষ করতে পদে পদে হোচট খান। কেউ তাতেদর সহায়তা তো করেনই না, উল্টো গালাগাল শুনতে হয়। দেশে ফেরার সময় পাচারকারী প্রবাসীরা গ্রিন চ্যানেল দিয়ে নিমেষে বেরিয়ে আসেন।
আর বিশাল লাগেজ নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয় ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’দের। কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাজারটা প্রশ্ন আর সন্দেহজনক দৃষ্টি তাদের কাবু করে ফেলে। বাড়ি ফিরেও অনেকে স্বস্তি পান না। দেখেন তাদের পাঠানো টাকায় ভাইয়রা ফুলে ফেপে উঠেছে। অনেকে কয়েক বছর পর এসে স্ত্রী ফিরে পান না। তার পাঠানো অর্থে প্রেমিকের সাথে লাপাত্তা হয়ে যান অনেক প্রবাসীর স্ত্রী। দেশে-বিদেশে, ঘরে-বাইরে, বিমানবন্দরে পদে পদে লাঞ্ছনার শিকার হওয়া মানুষগুলো তবু দেশে টাকা পাঠানো অব্যাহত রেখেছে বলেই রিজার্ভ নিয়ে আমাদের অত ভাবতে হয় না।
Advertisement
দেশে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন সরকার তাদের সিআইপি মর্যাদা দেয়। সিআইপি মানে হলো কমার্শিয়ালি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন। সিআইপিরা দেশে নানা অনুষ্ঠানে বা বিমানবন্দরে বিশেষ মর্যাদা পান। অর্থনীতির বিবেচনায় প্রবাসীরা কমার্শিয়ালি ইম্পট্যান্ট। কিন্তু বিশেষ মর্যাদা তো দূরের কথা, তাদের ‘পারসন’ হিসেবেই গণ্য করা হয় না।
কে কত বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে তাদেরও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। আর বিমানবন্দরে সহায়তা ও মর্যাতা তো সবারই প্রাপ্য। একজন মানুষ বৈধ ভিসা ও বিমান টিকিট নিয়ে দেশের বাইরে যাবে বা ফিরবে; সেখানে তাকে অপমান করা হবে কেন? রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যাতে নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়া করতে পারে, সেজন্য বিমানবন্দরে আলাদা ডেস্ক, আলাদা লাইন করা যেতে পারে। নিয়মটা হওয়া উচিত, আগে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যাবে, পরে অন্যরা। কিন্তু হয় উল্টোটা।
শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে তিন ‘আর’র কথা বলেছি। এই তিন ‘আর’র মধ্যে আরএমজি সেক্টরের উদ্যোক্তরা হলেন সুয়োরানী। তারা সুযোগ-সুবিধা, মর্যাদা, প্রণোদনা সব পান। কিন্তু রাইস উৎপাদনকারী কৃষক আর রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীরা যেন দুয়োরানী। যতই লাথিগুতা মারেন, তারা ধান ফলাবে আর ডলার পাঠাবে। আর তাতে আমরা বিলাসিতা করবো। রিজার্ভ চাঙ্গা রাখতে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের আমাদের সামগ্রিক মনোভাবটা বদলানো জরুরি।১৭ জুলাই, ২০২২
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জিকেএস