দেশজুড়ে

বেড়ায় ঈদ ঐতিহ্যে হাজীবাড়ি

পাবনার বেড়া উপজেলার নতুন পেঁচাকোলার ‘হাজী বাড়ি’ গোটা উপজেলায় একটি পরিচিত নাম। এ হাজীবাড়ির প্রাণপুরুষ ছিলেন মরহুম কিছমত আলী। তিনি পবিত্র হজ করেছিলেন। তার স্ত্রী মরহুমা রহিমা খাতুনও হজ করেছিলেন। তাদের সাত ছেলেও সস্ত্রীক হজ করেছেন। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত। কেউ শিল্পপতি, কেউ পদস্থ কর্মকর্তা, কেউ ব্যবসায়ী। কর্মসূত্রে সবাই দেশ-বিদেশে অবস্থান করেন। তবে ঈদে একত্রিত হন। তাদের সাত ভাই আর দু’বোনের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা বছরের খালি বাড়িটি। এবারের ঈদেও হাজীবাড়ি মুখর ছিল। আর হাজীরা ছিলেন জনসেবায় নিবেদিত।

Advertisement

নতুন পেঁচাকোলার সন্নিকটে নাকালিয়া বাজারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাজী কিছমত আলী। এটা ২০০০ সালের কথা। তিনি নিজের চার বিঘা জমি দান করেছিলেন। সেখানে দোকানপাট প্রতিষ্ঠা করে নামমাত্র দামে দোকান রেজিস্ট্রি করে দিয়েছিলেন অনেককে। তিনি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে দোকান ঘর নিতে উৎসাহিত করেছিলেন মানুষজনকে। এমনও হয়েছে দোকান ঘরের টাকা না পেয়েও নিজের খরচে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। সেদিনের সেই অঙ্কুর আজ মহীরুহ। নাকালিয়া বাজারে ৩-৪শ’ দোকান ঘর গড়ে উঠেছে। সেসব দোকানের একেকটির দাম আজ ২০-২৫ লাখ টাকা।

হাজী কিছমত আলীর মৃত্যুর পরও তার ছেলেরা দোকানের দাম বিবেচনায় আনেননি। যাদের রেজিস্ট্রি করা বাকি ছিল তাদের নামে বাবার দেওয়া জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন অকাতরে। নাকালিয়া বাজার চরের মানুষের জন্য যা আশীর্বাদস্বরূপ। নাকালিয়া বাজারে চরের সবজি আর ফসল কেনাবেচা হয়। নৌকায় এসে চরের মানুষ যেমন সহজে ফসলাদি বেচাকেনা করতে পারেন তেমনি চরের টাটকা সবজি কিনতে পারেন ক্রেতারাও।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরের বাদাম, তিল, মসুর, সরিষার হাট লাগে এখানে। ব্যাপারীদের মাধ্যমে এসব দ্রব্যাদি যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এখানে হাট না থাকলে চরের মানুষজন তাদের ফসল বাজারজাত করা নিয়ে মহাবিপাকে পড়তেন। সে হিসাবে একটি দূরদর্শী কাজ করে গেছেন মরহুম কিছমত হাজী। আর হাট-বাজারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কত শত মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

Advertisement

নাকালিয়া এলাকায় ‘মিরাকল’ ঘটিয়ে যাওয়া মরহুম কিছমত হাজীর সাত ছেলেও আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। মেয়েরা নিজ নিজ সংসারে ভালো রয়েছেন। বাবার আদর্শে গড়ে উঠেছেন তারা।

কিছমত আলী হাজীর ছেলেরা হলেন যথাক্রমে- আলহাজ আসাদুল্লাহ (ঢাকায় থাকেন), আলহাজ শাহজাহান আলী (চট্টগ্রাম থাকেন), আলহাজ হেলাল উদ্দিন (এএসপি, নারায়ণগঞ্জ নৌ পুলিশে কর্মরত), আলহাজ ইউসুফ আলী (সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া থাকেন), আলহাজ ইউনুছ আলী (বিশিষ্ট শিল্পপতি, রূপসা কেমিকেলের স্বত্বাধিকারী), আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম (বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, ঢাকায় থাকেন) ও আলহাজ আমিনুর রহমান (বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, ঢাকায় থাকন)।

কিছমত আলী হাজীর বড় ছেলে হাজী আসাদুল্লাহ জানান, তার বাবা-মা উভয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। করোনার জন্য ৪টি ঈদে তারা একত্রে গ্রামের বাড়ি আসতে পারেননি। ভাই- বোন ও তাদের ছেলে-মেয়ে বা কারো মেয়ে জামাইসহ অন্তত ৫০ জন তারা ঈদে সমবেত হন। এছাড়া স্থানীয় আত্নীয়-স্বজন এসে যোগ দেন তাদের বাড়িতে। ঈদ উপলক্ষে এসে তারা এলাকার লোকজনকে যতটা পারেন সহযোগিতা করতে চেষ্টা করেন।

তিনি জানান, তাদের আসলে ভালোবাসা ও দোয়া ছাড়া নেওয়ার কিছু নেই। ঈদে তার বাবার আদর্শ অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শত শত মানুষকে তারা আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন। ঈদে গ্রামের বাড়িতে আসার সমস্যা, কষ্ট সব দূর হয়ে যায় মানুষের ভালোবাসায়।

Advertisement

শুধু ঈদে বাড়ি আসার মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ থাকেননি। বাড়ির বিশাল আঙিনার পাশে গড়েছেন মসজিদ ও হাফিজিয়িা মাদরাসা। তাদের মাদরাসাটি জেলার অন্যতম একটি সেরা মাদরাসা হিসেবে পরিচিত।

হাজীবাড়ির আরেক সন্তান হাজী শাজাহান আলী চট্টগ্রামে বসবাস করেন। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। জানান, তাদের বাবা বেঁচে থাকা অবস্থাতেই তারা একত্রে ঈদ করতেন। বাবার হাতে গড়া মসজিদ ও গোরস্থান উন্নয়ন করেছেন। গ্রামের মানুষের জন্য প্রতি সপ্তাহে এমবিবিএস চিকিৎসক দ্বারা ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবস্থাও করেছেন।

তিনি জানান, দূরে থাকি। সপরিবারে আসতে কষ্ট হয়। কিন্তু ঈদ আনন্দ আর মানুষের ভালোবাসা পেয়ে সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।

হাজীবাড়ির আরেক সন্তান আলহাজ হেলাল উদ্দিন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)। তার কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জ। তিনি জানান, পুলিশের চাকরিতে ছুটি পাওয়া কঠিন। কিন্তু তিনিও চেষ্টা করেন পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদ করার।

জানান, তারা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখতে। ঠিক তার বাবারও তাদের এভাবে শিখিয়ে গেছেন।

আরেক সন্তান হাজী ইউনুছ বলেন, মায়ের নামানুসারে রহিমিয়িা এতিমখানা ও হিফ্জ খানা প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা।

নতুন পেঁচাকোলা গ্রামের বাসিন্দা আলেয়া খাতুন (৬৫) জানান, হাজীবাড়ির সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে বেঁচে আছেন। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ান সব সময়। তাদের দ্বারা শান্তি পান।

অরেক বৃদ্ধা জাহিরন খাতুন জানান, হাজী সাহেবরা উপকার করেন। বিপদে আপদে তাদের বাড়ি আসি। তাদের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাই।

একই কথা বললেন দহেরপুরের আইয়েল হোসেন (৬৬)। আরো বহু সংখ্যক মানুষজন জানিয়েছেন তারা হাজীবাড়ি থেকে অনেক বছর ধরে উপকৃত হয়ে আসছেন।

হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ সরকার জানান, তিনি হাজীবাড়ির কথা জানেন। হাজীরা কয়েক ভাই অসাধারণ মানুষ। তাদের আচার-আচরণ খুবই অমায়িক। তারা এলাকার মানুষকে অকাতরে সাহায্য সহযোগিতা করেন।

তিনি জানান, এ পরিবারটি অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের পাড়শোনায়ও সহযোগিতা করে। ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর ফরম ফিলআপের টাকা তারা পরিশোধ করে দিয়েছিলেন।

তিনি আরও জানান, তাদের ব্যক্তিগত সাহায্য সহযোগিতা বিতরণী কাজে কয়েকবার তাকেও (চেয়ারম্যানকে) আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ ইউনিয়নে কোনো সমস্যা বা কারো বিপদ- আপদ সম্পর্কে তার কাছে থেকেও অনেক সময় জেনে নেন। হাজীবাড়ির মানুষেরা এলাকায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

নাকালিয়া মনজুর কাদের ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আক্তার উদ্দিন জানান, তিনি হাজীবাড়ির কথা জানেন। তারা পরোপকারে নিবেদিত। তারা পরিবারের মধ্যেও একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এফএ/জেআইএম