এক সময় গাঁজা উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে নওগাঁর বেশ সুনাম ছিল। গাঁজার উৎপাদনকে কেন্দ্র করে শহরে চারটি গুদামঘর তৈরি করা হয়। যে কারণে এলাকাটি ‘গাঁজা গোলা মোড়’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। গড়ে উঠেছে গাঁজা সমবায় সমিতি। শহরজুড়ে ব্রিটিশ আমলের গাঁজা সোসাইটির কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ের পাশে অবস্থিত ‘গাঁজা সমবায় হিমাগার’অন্যতম। তবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও গত দুই বছর ধরে হিমাগারটি ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই এখন স্থায়ীভাবে বন্ধের পথে গাঁজা সোসাইটির এ হিমাগারটি।
Advertisement
নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পুনর্বাসন সমবায় সমিতি অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে হিমাগারটি তৈরি করা হয়েছিল, যা ২০০৪ সাল পর্যন্ত মার্কেটিং সোসাইটির আওতায় ছিল। এরপর ২০০৫ সালে গাঁজা সোসাইটির আওতাভুক্ত হয়। হিমাগারের তিনটি ঘরে ধারণক্ষমতা প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন। একসময় এটি ছিল জেলার মধ্যে একমাত্র হিমাগার। ২০০৬ সাল থেকে একবছর মেয়াদি ইজারা দেওয়া হতো। প্রতিবছর ৩ লাখ ৩৬ টাকার হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। সর্বশেষ ইজারা দেওয়া হয় বছরে ২ লাখ ১২ হাজার টাকায়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শহরের মো. শেখ আল মামুন নামে এক ঠিকাদারের কাছে ইজারা ছিল। ২০২০ সালে হিমাগারটি ইজারা দেওয়ার জন্য গাঁজা সোসাইটি থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় কেউ ইজারা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ফলে দুই বছর থেকে হিমাগারটি বন্ধ রয়েছে। হিমাগারটি দেখভালের জন্য একজন ম্যানেজার, একজন অপারেটর ও দুইজন প্রহরী (নাইটগার্ড) রয়েছেন।
এদিকে, গাঁজা সোসাইটির অফিস এখন দেখভাল করেন অফিস সহকারী আনিসুর রহমান। তার তথ্যমতে, সমিতির সম্পত্তির মধ্যে আছে ২৮টি ভবন, একটি হিমাগার, চারটি গোডাউন, একটি সরাইখানা, একটি মিটিং গ্রাউন্ড, তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১১টি উচ্চবিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, একটি মন্দির, সাতটি বড় পুকুর ও একটি লেক। এসব সম্পদ নওগাঁ সদরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শতবছর ধরে নওগাঁর উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে গাঁজা সোসাইটির এসব সম্পদ।
একসময় গাঁজা সোসাইটির হিমাগারটি ছিল জেলার একমাত্র হিমাগার। ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করা হলে হিমাগারটি আলুর বীজ রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। তখন এর বেশ চাহিদাও ছিল। ব্যবসায়ী ও কৃষকরা এখানে আলুর বীজ সংরক্ষণ করতেন। তবে জেলায় ব্যক্তিগত হিমাগার তৈরি হওয়ার পর থেকে এটির গুরুত্ব কমতে থাকে। জেলায় এখন চারটি কোল্ড স্টোরেজ (হিমাগার) রয়েছে। যেখানে আলুর ধারণক্ষমতা প্রায় ৫ লাখ বস্তা। প্রতি বস্তায় আলুর ওজন ৮০-৯০ কেজি। ব্যক্তিগত হিমাগার থেকে চাষিদের আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করতে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু গাঁজা সোসাইটির হিমাগারটির বছর বছর ইজারাদার পরিবর্তন হওয়ায় কোনো ঋণের ব্যবস্থা করা হয় না। তাই দিনদিন এটির গুরুত্ব কমতে থাকে।
Advertisement
হিমাগারটির ভবন ও মেশিনারিজ সরঞ্জাম অনেক পুরোনো। কোনো সংস্কার না হওয়ায় মেশিনের ঠান্ডা ধরে রাখার ক্ষমতা কমে গেছে। এছাড়া মেশিনটি পুরোনো হওয়ায় বিদ্যুৎ বিলও বেশি আসে। একারণে হিমাগারটি ইজারা নিতে কেউ তেমন আগ্রহ দেখান না। এদিকে, হিমাগারটি বন্ধ থাকায় অনেক সরঞ্জাম মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গাঁজা সোসাইটির মূল্যবান সম্পদ এ হিমাগারটি এখন স্থায়ীভাবে বন্ধের পথে।
গাঁজা উৎপাদন বিষয়ে খানসাহেব মোহাম্মদ আফজলের লেখা ‘নওগাঁ মহকুমার ইতিহাস’ বই (সর্বশেষ প্রকাশ মে ২০০৭ সাল) থেকে জানা যায়, গাঁজা পাক-ভারতের প্রাচীন কৃষিজাত দ্রব্য। গাঁজার গাছ থেকে তিন রকম মাদকদ্রব্য যথা- চরশ, গাঁজা ও ভাঙ্গ পাওয়া যায়। গাঁজার মতো কৃষিজাত পণ্য পৃথিবীতে বেশি নেই। নওগাঁর উন্নয়নের মূলে রয়েছে গাঁজা। তবে কোথায় থেকে কতদিন আগে নওগাঁ মহকুমার প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয় তার কোনো সঠিক ইতিহাস নেই। জনশ্রুত আছে- যশোর থেকে গাঁজার বীজ নিয়ে এসে নওগাঁ ও পাঁচুপুর থানায় (বর্তমানে আত্রাই ও রানীনগর থানা) প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। আবহাওয়া ও জমি চাষে অনুকূল না হওয়ায় পাঁচুপুর থানায় গাঁজা চাষের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
আগে চাষিরা গাঁজা তৈরি করে নিজেরাই বিক্রি করতেন। তবে কী পরিমাণ জমিতে গাঁজার চাষ হতো তার সঠিক কোনো হিসাব বা তথ্য ছিল না। ১৮৭৬ সালে লাইসেন্স প্রথা চালু। এর আওতায় নির্দিষ্ট জমি ছাড়া অন্য কোনো জমিতে গাঁজা করা যেত না।
সাধারণত জুন-জুলাই মাসে গাঁজা চাষের জন্য চারা তৈরি করে ১ ফুট উঁচু আইলে প্রায় ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি দূরে দূরে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা হতো। ফেব্রুয়ারি মাসে গাঁজা পরিপক্ব হয়। এরপর গাঁজা জটাগুলো সশস্ত্র পুলিশ পাহারায় নওগাঁয় গাঁজা-গোলায় পাঠানো হতো।
Advertisement
১৯২১ সালে নওগাঁ গাঁজা কালটিভেটার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি স্থাপিত হয়। ওই সময় বাণিজ্যিকভাবে গাঁজা চাষের প্রচলন ছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও দেওয়া হতো। সাত হাজারের বেশি চাষি মিলে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে গাঁজা চাষ করতেন। নওগাঁর গাঁজা চাষিদের পুনর্বাসনের লক্ষে ১৯১৭ সালে গড়ে তোলা হয় নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পুনর্বাসন সমবায় সমিতি লিমিটেড। এ সমিতির সদস্য ছিল ৬ হাজার ৬০০ জন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকদ্রব্যবিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই সমবায় সমিতির সদস্যদের পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবে চরম বিপাকে পড়েন। পরে তারা ধান, সরিষা, সবজি চাষাবাদ শুরু করেন।
শহরের মুক্তির মোড়ে গাঁজা সমিতির প্রধান অফিস ভবন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আদলে তৈরি। নেপাল থেকে শালকাঠ এনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তাছাড়া এক্সাইজ সুপারিনটেনডেন্টের জন্য দোতলা বাসভবন ও ডেপুটি চেয়ারম্যানের জন্য দোতলা ভবন ব্রিটিশ আমলে নওগাঁর অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়ায়।
হিমাগারের প্রহরী (নাইটগার্ড) আব্দুল জলিল বলেন, গত দুইবছর থেকে হিমাগারটি বন্ধ রয়েছে। ভবনে হাওয়া-বাতাস প্রবেশের জন্য দিনে দরজাগুলো খুলে রাখা হয়। যেন ককশিট নষ্ট ও দুর্গন্ধ না হয়। পালা করে দুইজন প্রহরী দায়িত্ব পালন করতে হয়।
হিমাগারের ম্যানেজার আমিনুর রহমান বলেন, গাঁজা সোসাইটির যত সম্পদ রয়েছে তার মধ্যে হিমাগার ভালো একটা আয়ের উৎস ছিল। ইজারা দেওয়ার জন্য আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় তাই কেউ ইজারা নেননি। এখন ইজারাদাররা আগ্রহ প্রকাশ করছেন, তবে অর্ধবছরের জন্য তারা নিতে আগ্রহী না। বছরের শুরুতে তারা ইজারা নিতে চান। সে হিসেবে আগামী ২০২৩ সালে ইজারা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছি।
গাঁজা সমবায় হিমাগারের সাবেক ইজারাদার ও মেসার্স মোমিন ফল ভাণ্ডারের সত্ত্বাধিকারী মো. শেখ আল মামুন বলেন, আমার কাছে মনে হয়, হিমাগার ভবনটি অনেক পুরোনো হওয়ায় ড্যামেজ হয়েছে। এ কারণে ঠান্ডা ধরে রাখতে পারে না। এছাড়া মেশিনটি অনেক পুরোনো হওয়ায় বিদ্যুৎ খরচও বেশি হয়। প্রতিবছর প্রায় বিদ্যুৎ বিল আসে ২০-২২ লাখ টাকা। এ কারণে লোকসান না হলেও লাভের অঙ্কটা কম। তবে নতুন মেশিন স্থাপন করা হলে গ্যাসের উৎপাদন ভালো হবে এবং খরচও কমে আসবে। অন্য যেগুলো হিমাগার আছে সেখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসে আলু রাখার উপযোগী। তবে গাঁজা সোসাইটির এ হিমাগারটি ফল রাখার উপযোগী। আলু ও ফল রাখার কাজে হিমাগারটি ব্যবহার করতাম।
নওগাঁ গাঁজা সোসাইটির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, হিমাগারটি চালু করতে এরইমধ্যে আলোচনা হয়েছে। সংস্কারের জন্য একটি টেকনিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে, যেখানে সংস্কারে কী পরিমাণ ব্যয় হবে তা জানা যাবে। তারা প্রতিবেদন দিলে হিমাগারটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এমআরআর/এসআর/জেআইএম