ছোট্ট নিষ্পাপ এক ক্রন্দনরত শিশুর ছবি। যে হয়তো মাকে দেখতে না পেয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। এমন অদ্ভুত এক মায়াভরা মুখের একটি ছবি যে কেউ পছন্দ করে কিনবেন। বাড়িতে এনে ড্রয়িং রুমে টানিয়েও রাখলেন। কিন্তু যদি জানতে পারেন আপনার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে এই ছবিই, তাহলে নিশ্চয়ই ঘরে টানানোর আগে দ্বিতীয়বার ভাববেন।
Advertisement
এমনই এক অভিশপ্ত ছবি নামে খ্যাত ‘দ্য ক্রাইং বয়’। ১৯৮৫ সালের নভেম্বর। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বিপুল পরিমাণে ‘দ্য ক্রাইং বয়’ নামের ছবি পোড়ানো শুরু হল সেদিন। যাকে বলে বন ফায়ার। এর পেছনে আছে ভয়ানক এক কাহিনি। আসলে ততদিনে ইউরোপ জুড়ে আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে ওই ছবিকে ঘিরে।
সেখানে বলা হচ্ছে, ওই ছবির কপি যদি আপনি শখ করে টাঙিয়ে ফেলেন ঘরের দেওয়ালে, তাহলে আর রক্ষা নেই। এর আগে যেই এই ছবি ঘরে টাঙিয়েছে, সেই বাড়িই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। অথচ দেওয়ালে টাঙানো ‘দ্য ক্রাইং বয়’ ছবিটির গায়ে আঁচও লাগেনি! যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, ওই পরিবারগুলোতে ছবির বালকের আগমন হয়েছিল ‘মৃত্যুদূত’ হয়েই।
সেসময় পুরো ইউরোপে এক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এই ছবিটিকে ঘিরে। যার রহস্য ছাড়িয়ে ছিল মিশরের পিরামিড কিংবা মমিকেও। এক ক্রন্দনরত বালকের মুখই ডেকে আনতে পারে অশনি সংকেত? ‘দ্য ক্রাইং বয়’ নামের একটি ছবিকে ঘিরে রয়েছে এমনই ছমছমে মিথ।
Advertisement
গত শতক থেকে হু হু করে বাজারে ছড়িয়ে পড়ে ইতালীয় শিল্পী জিওভানি ব্রাগোলিনের আঁকা ‘দ্য ক্রাইং বয়’। জিওভানি শুধু ওই বাচ্চা ছেলেই নয়, আরও নানা ক্রন্দনরত বালক-বালিকাদের ছবিও এঁকেছিলেন। ছবিটি ছিল একটি সিরিজের অন্তর্গত। কিন্তু সব ছবির মধ্যে থেকে আলাদা করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওই ছবিটিই। জানা যায়, পরবর্তী তিন দশকের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি বিক্রি হয়েছিল অভিশপ্ত বালকের পোট্রেট। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ছবিটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এর তিন দশক পরে এসেই শুরু হলো নতুন গুঞ্জন। ছবিটি নাকি অভিশপ্ত।
১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘দ্য সান’-এ প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ। তাতে এসেক্সের এক দমকলকর্মীকে দাবি করতে শোনা যায়, আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া কয়েকটি বাড়ির ভেতর তিনি দেখতে পেয়েছেন অবিকৃত ‘দ্য ক্রাইং বয়’ পেন্টিং। এই একটি প্রতিবেদনই যেন কাজ করল স্ফুলিঙ্গের। ‘ভুতুড়ে’ ছবি ঘিরে শোরগোল পড়ে গেল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, মাস দুয়েকে মধ্যেই বন ফায়ার করে পুড়িয়ে দেওয়া হল ছবিটির বহু কপি। অভিশাপের হাত থেকে বাঁচতে মরিয়া মানুষদের অসহায়তা ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ জুড়ে।
এই ধরনের গুঞ্জন একবার ছড়িয়ে পড়লে দাবানলের মতো তা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এর আগে ‘দ্য হ্যান্ডস রেসিস্ট হিম’ নামের এক ছবিকে ঘিরেও শুরু হয়েছিল এমন গুঞ্জন। ১৯৭২ সালে বিল স্টোনহ্যামের আঁকা এই ছবিতে এক ছোট্ট ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার পাশে আছে একটি মেয়ে পুতুল। আর পিছনে একটি দরজা। সেই দরজাটি বাস্তব দুনিয়া ও ফ্যান্টাসির জগতের মাঝের দরজা। পুতুলটি ওই ছেলেটিকে ওই জগতে নিয়ে যেতে এসেছে। এমন সুন্দর একটি ছবিকে ঘিরেও রয়েছে রহস্য। ২০০০ সালে মার্কিন বহুজাগতিক ই-কমার্স সংস্থা ‘ইবে’ নিলামে তোলে ছবিটিকে। দাবি করে, ছবিটি অভিশপ্ত। রাতের অন্ধকারে নাকি ছবি থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটতে শুরু করে ছেলেটি। ঘটতে থাকে নানা ভয়ংকর ঘটনা। নেমে আসে দুর্যোগের কালো মেঘ।
তবে এই ছবিটিকে ঘিরে জমে থাকা মিথও ‘দ্য ক্রাইং বয়’-এর কাছে নস্য়ি। ছবির বাচ্চা ছেলেটি আসলে কে ছিল তা অবশ্য জানা যায় না। তবে গুঞ্জন, ওই ছেলেটি নাকি স্পেনীয় জিপসি পরিবারের সন্তান। কারো মতে তার নাম ছিল ডন বনিলো, কেউ বলেন ডায়াব্লো। তার বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন আগুনে পুড়ে। এরপর যারাই ছোট্ট ছেলেটিকে আশ্রয় দিয়েছেন পরিবারে, আগুনে পুড়ে গিয়েছে তাদের ঘরবাড়িও! এমনকি ছেলেটির ছবি আঁকা হয়েছিল যে স্টুডিওতে, সেটিও নাকি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়!
Advertisement
জিওভানের বাচ্চাটির সঙ্গে ১৯৬৯ সালে মাদ্রিদে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইতালি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর যার বাবা-মা রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিল এবং তাই মানুষ তাকে ‘এল ডায়াবলো’ নামে ডাকতে শুরু করেছিল। এর মানে ছিল ‘শয়তান’। এজন্য কেউ তাকে দত্তক নিতে চায়নি। সে নাকি যেখানে যেত, সেখানেই আগুন লেগে যেত। ছেলেটিকে একজন পুরোহিতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জিওভান দত্তক নিয়েছিলেন এবং তার চিত্রকর্ম এঁকে তাকে অপব্যবহার করতে শুরু করেন। ছোট্ট দুঃখী অনাথের চিত্রগুলো তাকে ধনী করে তোলে।
একদিন হঠাৎই তার স্টুডিওটি রহস্যজনকভাবে পুড়ে যায় এবং জিওভান এই অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী করে সেই ছেলেটিকে এবং ছেলেটি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এর কয়েক বছর পর, বার্সেলোনায় একটি গাড়ি বিস্ফোরণে সেই ছেলেটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ড. ডেভিড ক্লার্ক নামের এক সাংবাদিক এই রহস্য সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন। তিনি বলেন, তিনি কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি যে জর্জ ম্যালরির জিওভানির সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছিল। হয়তো এগুলো তিনি বানিয়ে বলেছিলেন খবরে আসার জন্য। জিওভান হয়তো ২০-৩০ জন কান্নাকাটিকারী ছেলেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভেনিসে দেখার পর এঁকেছিলেন। যার প্রিন্ট ১৯৭৯-এর দশকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়েছিল।
তাহলে এই ছবিটিই কেন ‘অভিশপ্ত’? মূলত ‘দ্য সান’-এর করা প্রতিবেদন থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল অভিশপ্ত বালকের মিথ। ব্রিটিশ লেখক ও কৌতুকশিল্পী স্টিভ পান্ট একটি যুক্তি দিয়েছিলেন। বিবিসি রেডিওতে তিনি একটি শো করতেন যার নাম ‘পান্ট পিআই’। সেখানে একটি এপিসোডে তিনি আলোচনা করলেন ক্রন্দনরত বালকের মিথ নিয়ে। তিনি যুক্তি দিলেন, ওই ছবিগুলোর প্রিন্টে অগ্নিনির্বাপক পদার্থের সাহায্যে ভার্নিশ করা হয়েছিল। ফলে আগুনে এর কোনো ক্ষতি হয়নি।
এর পাশাপাশি আরও একটি যুক্তি হল, ছবিটি যে স্ট্রিংয়ের সাহায্যে দেওয়ালে লাগানো থাকত সম্ভবত আগুনের সংস্পর্শে এসেছিল সেটিই। ফলে সেটি আগুনে পুড়ে দেওয়াল থেকে খসে পড়ার সময় উলটো মুখ করে মাটিতে পড়ত। যার ফলে আগুনে সেটার কোনওরকম ক্ষতি হত না।
পান্টের এমন সব যুক্তিতেও অবশ্য পরিস্থিতি বদলায়নি। বরং ক্রমেই ওই ছবির শরীরে অভিশপ্ত চিত্রকর্মের জলছাপ আরও জোরাল হয়েছে। ইউরোপ থেকে পৃথিবীর সব মহাদেশেরই বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে ‘দ্য ক্রাইং বয়’কে ঘিরে জমতে থাকা অলৌকিকতার মেঘ। দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের মাঝে অক্ষত এক অসহায় বালকের মুখের ছবি মায়া নয় ছড়িয়েছে ভীতি।
কেএসকে/জেআইএম