মতামত

‘শিশু’র বয়স কমানোই কি সমাধান?

সম্প্রতি শিশুর বয়সসীমা ১৮ বছর থেকে কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। গত রোববার ওই কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ কথা জানান।

Advertisement

বিদ্যমান শিশু আইন ২০১৩ এর ৪ ধারা অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। শিশুরা অপরাধ করলে শিশু আইন অনুযায়ীই তার বিচার হবে। শিশু আইনের পঞ্চম অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আইন।

আইনে নির্ধারিত বয়স (১৮) কমানোর যুক্তি হিসেবে সরকার বলছে বর্তমানে শিশুরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। ১৮ বছরের কম বয়সীরাও বড়দের মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাসী, দলবদ্ধ ধর্ষণ ইত্যাদি সব অপরাধেই ১৮ বছরের কম বয়স্করাও জড়িয়ে পড়ছে। তাই আইন সংশোধন করে শিশুদের বয়স কমিয়ে আনতে হবে। যাতে এই সব অপরাধীদের প্রচলিত আইনেই বিচার করা যায়, বিশেষ আইনে (শিশু আইনে) নয়।

শিশুরা যে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এ কথা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সম্প্রতি আশুলিয়ায় এক শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষকের মৃত্যু হওয়ায় বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। অভিযুক্ত শিশুর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তার বয়স ১৫ আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছে অভিযুক্তের বয়স ১৯।

Advertisement

তদন্তেই বেরিয়ে আসবে অভিযুক্তের আসল বয়স কত। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে-বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কত বছর পর্যন্ত একজনকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা যাবে? এত বছর তো আঠারই ছিল। নতুন করে আইন সংশোধনের প্রস্তাবের কারণেই প্রশ্নটি আবার নতুন করে সামনে চলে এসেছে।

সাধারণভাবে, কত বছর পর্যন্ত একজনকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা যায় তার সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। এটি নির্ধারণ করা হয় একটি দেশের আর্থসামাজিক বিষয় বিবেচনা করে। আসলে কত বছর বয়স না হলে শিশুরা আইনের চোখে অপরাধ করতে পারে না- এর সর্বজন গৃহীত কোনো বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড নেই। ফলে, বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করে নিয়েছে।

তবে, শিশুদের আইনগত বয়স নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড না থাকলেও এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক আইন বা সনদ রয়েছে (১৯৮৯ সালের শিশু সনদ)। ১৯৮৯ সালের শিশু সনদের আগেও লীগ অব নেশনসের অধীনে ১৯২৪ সালে আরেকটি সনদ সাক্ষরিত হয়েছিল। এছাড়া ১৯৫৯ সালেও একটি সনদ সাক্ষরিত হয়।

১৯৮৯ সালের শিশু সনদটি জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রই গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশও এটি সাক্ষর করেছে। এই সনদ (অনুচ্ছেদ ১) অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু।

Advertisement

আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২০১৩ সালে শিশু আইন করা হয়েছে। ২০১১ সালে শিশু নীতিও করা হয়েছে। এখন দেশীয় আইন সংশোধন করলে সংশ্লিষ্ট অপরাপর আইন ও নীতিও সংশোধন করতে হবে। সেটি করা যে খুব জটিল তা নয়। তবে, আইনগত বয়স কমানোর সঙ্গে যে আর্থসামাজিক বিষয়গুলো জড়িত থাকে সেগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। তা না করে শুধু আইনগত বয়স কমিয়ে বা বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না।

শিশু আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম একটি আর্থসামাজিক সমস্যা-বাল্যবিবাহের সম্পর্ক রয়েছে। এমনিতে দেশে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি। অশিক্ষা ও দারিদ্র্যকেই সাধারণভাবে বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী করা হয়। করোনাকালে দুই বছরে বাল্যবিবাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। এখন আইন সংশোধন করে শিশুদের বয়স যদি ১৮ থেকে নামিয়ে ১৪ করা হয় তবে বাল্যবিবাহ আরও বেড়ে যাবে। এখন অনেকেই হয়তো আইনের ভয়ে বাল্যবিবাহ এড়িয়ে চলে। বয়স কম হলে আর কম বয়সে বিয়ে দিতে কোনো বাধা থাকবে না।

এছাড়া বাংলাদেশের শ্রম আইনানুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সীরা শিশু এবং তাদেরকে কোনো শ্রমে নিয়োগ করা যায় না। বয়স ১৪ থেকে ১৮-এর মধ্যে হলে তারা কিশোর। এক্ষেত্রে কিশোরদের শর্তসাপেক্ষে সীমিতভাবে কাজে শ্রমে নিয়োগ করা যায়। কাজেই, শিশু আইনের সংশোধনের পাশাপাশি শ্রম আইনের শিশু ও কিশোরদের বয়স সংক্রান্ত ধারাগুলোরও সংশোধন করতে হবে। কিন্তু শিশু আইন ও শ্রম আইন দুটোই করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। শিশুর বয়স সংশোধন করতে হলে বিদ্যমান শিশু নীতিরও (২০১১) সংশোধন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক শিশু সনদ অনুযায়ী শিশুর বয়স ১৮ বছর বিবেচনা করেই সব দেশ এতে সাক্ষর করেছে। সে অনুযায়ী রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ আইন প্রণয়ন করেছে। সংসদীয় কমিটি শিশু অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় আইন সংশোধনের কথা প্রস্তাব করছে। এটি তারা করতেই পারেন। কিন্তু আইন সংশোধন করে বয়স কমানোর আগে কী বিবেচনায় বয়স কমাতে চান সেটা পরিষ্কার করা জরুরি। শিশুরা কি এমন যে তাদের বয়স ১৮ হয়নি তাই আইনি মারপ্যাচে মুক্তি পাবে- এটা ভেবে অপরাধ করছে? নিশ্চয়ই না। কাজেই, সমস্যাটি আমাদের বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থার।

বয়স কমিয়ে আনারা আগে ১৮ বছরের নিচে কতজন শিশু অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারও একটি খতিয়ান লাগবে। কারণ, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনার জন্য বা কয়েকটি শিশুর জন্য দেশের অসংখ্য শিশুদের আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা কোনো কাজের কথা নয়। এছাড়া, শিশু আইন শুধু শিশুদের আইনগত সুরক্ষার কথাই বলে না, এর সঙ্গে শিশু সংশোধন, শিশু উন্নয়ন, শিশু কল্যাণ, শিশু পরিচর্যা, সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের যত্ন- ইত্যাদি নানা বিষয় সম্পৃক্ত। কতিপয় অপরাধীর জন্য সব শিশুদের ওই আইনের অপরাপর সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা অযৌক্তিক।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিশুর বয়স ১৮ই ধরা হয়। তার মানে এই নয় ওইসব দেশে কিশোর অপরাধী নেই, শিশুরা অপরাধ করে না। কিন্তু ওই সব দেশ শিশুর বিচারের চেয়ে তাদের সংশোধনের প্রতিই বেশি গুরুত্ব দেয়। আমাদের দেশে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে কেবল শাস্তির মাধ্যমেই অপরাধ নির্মূল করা যায়। এটি সঠিক নয়। এর মাধ্যমে আসলে মূল সমস্যাকে আড়াল করা হয়। সে জন্য দেখা যায় আমরা তড়িঘড়ি করে আইন করে রাতারাতিই আবার সে আইন পরিবর্তন করে ফেলি। সব দোষ যেন আইনের। আইনের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়মুক্তি খুঁজি।

ভালো-মন্দ ঠিকভাবে বোঝার জন্য একটা বয়স লাগে। ১৮ এর আগে শিশুদের সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় না। তারা প্রকৃত ভালোমন্দ বুঝতে শেখে না। আন্তর্জাতিক আইনেও এই বিষয়টি বিবেচনা করেই শিশুর বয়স ধরা হয়েছে ১৮।

যদিও আমাদের হাতে কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কিশোর গ্যাং সম্প্রতি এক নাগরিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এর পেছনেও রয়েছে নানা সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্য। বড় শহরগুলোর নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু-কিশোররা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানহীন হয়ে কোনো রকম দিন যাপন করে। তারা হয় বস্তি এলাকার কিশোর গ্যাং। আর ধনীর দুলালরা সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের অভাবে হয়ে ওঠে উচ্চবিত্ত কিশোর গ্যাং।

কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের বিচারব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে এটি ঠিক। কিন্তু বিচারের চেয়ে সংশোধনের ওপর গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। কিশোর শোধনাগারগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। শোধনাগারগুলোর চরম অব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। শিশু কিশোররা কোনো অপরাধ করলে তা বিচারের জন্য আমাদের শিশু আইন যথেষ্ট সংবেদনশীল। এই আইনানুযায়ী বিচার করলে শিশু কিশোরের অপরাধেরও বিচার হবে ও একইসঙ্গে তারা নতুন জীবনও ফিরে পাবে।

সাভারে এক শিক্ষার্থী শিক্ষককে হত্যা করেছে। নড়াইলে আরেক শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়েছে। এগুলো জঘন্য অপরাধ। অভিযুক্তদের ইতোমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বিদ্যমান শিশু আইনেই তাদের বিচার হোক। বয়স বেশি দেখানোরও প্রয়োজন নেই আবার আইন সংশোধন করে বিচার করারও প্রয়োজন নেই। বিচারের জন্য বিদ্যমান আইনই যথেষ্ট।

এছাড়া শিশুদের বিচারের জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডও। ১৯৮৯ সালের সনদের ৩৭ (খ) ধারা বলছে, শিশুদের গ্রেফতার ও বিচার হবে সবশেষ পদক্ষেপ। তার আগে চাই তাদের সংশোধনের চেষ্টা। কিন্তু আমরা আগে চাই বিচার। এছাড়া সনদের ৪০ ধারায় শিশুদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আমাদের শিশু আইনেও এ বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়েছে।

আমরা আইন সংশোধনের কথা বলছি। কিন্তু আইনের পাশাপাশি শিশুদের দিকেও একটু নজর দিতে হবে। তারা কীভাবে বেড়ে উঠছে। তাদের বাব-মায়েরা কী করছে তাদের জন্য। সন্তানের জন্য তাদের সময় কোথায়? নির্মল বিশ্রাম-বিনোদনের জায়গা ও সময় কোথায়? খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ কোথায়? কাজেই, আমরা শুধু শিশুদেরই অবহেলা করছি না, আদতে আমরা আমাদের ভবিষ্যত নিয়েই ছিনিমিনি খেলছি।

শিশুদের জন্য আমরা একটি মানবিক সমাজ গঠন করতে পারিনি। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতাবোধের উপস্থিতি নেই। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা মানবিক হয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে কোথায়? আইন সংশোধনের আগে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম