মির্জা আজিজুল ইসলাম। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতির চলমান বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। অর্থনীতির নানা সম্ভাবনার পাশাপাশি অনিশ্চয়তার কথাও তুলে ধরেন। আলোচনায় গুরুত্ব পায় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংস্কারের বিষয়টিও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু ও শফিকুল ইসলাম।জাগো নিউজ : বিশেষ প্রেক্ষাপটে আপনারা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন অর্থনীতির অনেক জায়গায় সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্কও আছে। এই মুহূর্তে ওই সময়ের সংস্কারকে কীভাবে দেখছেন?মির্জা আজিজুল ইসলাম : যেকোনো কাজেই বিতর্ক থাকে। দেখতে হয় কাজের ফলাফল। অনেকেই আমাদের কাজের সমালোচনা করেছিল। কিন্তু আমি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় যে সংস্কারগুলো করেছিলাম, তার প্রায় প্রতিটিই বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে।জাগো নিউজ : যেমন?মির্জা আজিজুল ইসলাম : বাজেটের ওপর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপনের বিষয়টি সরকার আমলে নিয়েছে। বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা এবং বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় করে ডিবিবিএল করেছিলাম, সরকার এটিকে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে ফাইন্যান্সিং রিপোর্টিং কাউন্সিল করার যে অর্ডিন্যান্স করা হয়েছিল, তা বাতিল হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে সরকার আমার করা আইনের আদলেই আরেকটি আইন করেছে। সুতরাং সমালোচনা করলেও নীতিগত দিক থেকে সরকার আমাদের যে সংস্কার ছিল, তার অধিকাংশই বহাল রেখেছে।জাগো নিউজ : আপনারা যখন দায়িত্বে এসেছিলেন, তখন বিশ্বব্যাপী মন্দা। বাংলাদেশকে সেই অর্থে বিশ্বমন্দাকে মোকাবিলা করতে হয়নি, যে ধারা পরবর্তীতেও অব্যাহত রয়েছে। এর জন্য কী বলবেন?মির্জা আজিজুল ইসলাম : এর পেছনে আমাদের সংস্কারের উদ্যোগগুলো কিছুটা কাজ করেছে। কৃষি খাতে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছি। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ৩৫০ কোটি টাকার কৃষি গবেষণা ফান্ড করেছিলাম, বর্তমান সরকার এই ফান্ড আরও বাড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা একটি ফান্ড করেছিলাম, যা বর্তমান সরকার বাংলাদেশে ক্লাইমেট ট্রাস্ট ফান্ড নাম দিয়েছে। আমি লন্ডনে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর একটি কনফারেন্স করে ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা ফান্ড গঠন করেছিলাম, যেখানে উন্নত দেশগুলো সহায়তা করেছিল, যা সরকার পরবর্তীতে বাংলাদেশ ক্লাইমেট রেজিলিয়ান্স ফান্ড নাম দিয়ে বহাল রেখেছে।খাদ্য, সার, পেট্রোলিয়াম পণ্য আমরা বেশি আমদানি করে থাকি এবং বিশ্বমন্দার কারণে দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে দরিদ্র মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এর জন্য সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল। যেমন কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি।বলতেই পারেন সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা কিছু ভিত্তি তৈরি করেছিলাম, যার ওপর দাঁড়িয়ে সরকার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে।জাগো নিউজ : আপনাদের কিছু উদ্যোগকে রাজনীতিবিরোধীও বলা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?মির্জা আজিজুল ইসলাম : আমি সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলাম। রাজনীতির সংস্কার থেকে দূরে ছিলাম। মাইনাস টু ফর্মুলাই বলুন আর অন্য রাজনৈতিক সংস্কারের কথাই বলুন, এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।জাগো নিউজ : অনেকেই তো মনে করেন বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নেই আপনাদের সংস্কার ছিল?মির্জা আজিজুল ইসলাম : আমি অর্থনৈতিক সংস্কারে বাইরের কোনো চাপের কাছে মাথানত করিনি। অন্যরা কী করেছে, সেটা আমি বলতে পারব না। সংস্কার করতে গিয়ে অন্য উপদেষ্টাদের কাছ থেকেও আমি সহযোগিতা পেয়েছি। যেমন ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। এসময় আইএমএফ যে পরামর্শ দিয়েছিল, তাতে রফতানি এবং স্থানীয় বাজারের ওপর প্রভাব পড়ত। আমি তাদের পরামর্শ মানিনি। এ নিয়ে ঢাকা এবং ওয়াশিংটনে আইএমএফ-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। অবশেষে তারা আমার পক্ষেই মত দিয়েছেন। মূল্য সংযোজন কর নিয়ে আইএমএফ আইন সংস্কার করতে বলেছিল, আমি গ্রহণ করেনি। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শও মানা হয়নি।জাগো নিউজ : এর তো প্রভাব পড়েছিল?মির্জা আজিজুল ইসলাম : না, কোনো প্রভাব পড়েছিল আমি মনে করি না। কারণ বৈদেশিক সাহায্যের হার কমেনি। চাপ তো কিছুটা ছিলও বটে। আমি সেই চাপের কাছে মাথানত করেনি, কিন্তু বিদেশিদের সঙ্গে দরকষাকষি করেই সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলাম। অরাজনৈতিক সরকারের সুবিধা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাপ কম থাকে। রাজনৈতিক সরকারকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ব্যবসায়ী বা শ্রমিকদের পক্ষ থেকে চাপ আসে। আবার ভোটের হিসাবও করতে হয়।জাগো নিউজ : আপনারা দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকেই পুঁজিবাজার অস্থির হয়ে ওঠে, যার প্রভাব এখনও লক্ষণীয়। এ নিয়ে কী বলবেন?মির্জা আজিজুল ইসলাম : শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বগতি আমাদের সময় বেড়ে গেলেও পরবর্তীতে এর মাত্রা ছিল অত্যধিক। যে কারণে ২০১০ সালে ধস নামে। এর ৬ মাস আগে থেকেই বলে আসছিলাম যে, শেয়ারবাজারের লাগাম টেনে ধরা উচিত। বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে ওই সময় এক সেমিনারে বলেছিলাম, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে যে মাত্রায় বিনিয়োগ করছে, তা নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত। তখন আমার প্রস্তাব আমলে নেয়া হয়নি।জাগো নিউজ : অন্য খাত রেখে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে এভাবে বিনিয়োগ করার কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?মির্জা আজিজুল ইসলাম : স্বল্পসময়ের জন্য বিনিয়োগ করে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতা নিয়েই ব্যাংকগুলো এখানে বিনিয়োগ করেছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়ত এমন মুনাফা পেত না।জাগো নিউজ : এখন পুঁজিবাজারকে কীভাবে দেখছেন?মির্জা আজিজুল ইসলাম : অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরের ন্যায় পুঁজিবাজারও এখন স্থিতিশীল আছে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও ভালো।জাগো নিউজ : মানুষের আস্থার সংকট আছে কি না?মির্জা আজিজুল ইসলাম : আস্থার সংকট কিছুটা থাকতে পারে। তবে এখন যে অবস্থা তাতে পুঁজিবাজারে আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকার কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা আস্থা তৈরি হতে পারে।জাগো নিউজ : মধ্যম আয়ের পথে বাংলাদেশ। এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে তো বিতর্কও আছে?মির্জা আজিজুল ইসলাম : বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান মাথাপিছু আয় ১৩শ ১৪ ডলার। মধ্য আয়ের দেশের মাথাপিছু আয় হচ্ছে প্রায় ৪ হাজার ডলার। অনেক বড় ব্যবধান। ২০২১ সালের মধ্যে এই ব্যবধান দূর হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। মধ্যম আয়ের দেশ হলে ভাবমূর্তি বাড়বে। আর অসুবিধা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাবে। আবার আয় বাড়লেই সব মিটে যাবে তাও নয়। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের যে অধিকার, তা আরও কিছুদিন পাব বলে মনে করি।জাগো নিউজ : জিএসপি সুবিধা অনেকটাই অনিশ্চিত।মির্জা আজিজুল ইসলাম : জিএসপি সরাসরি অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে, আমি তা মনে করি না। এটি একটি দেশের ভাবমূর্তি নির্ধারণ করতে পারে মাত্র।জাগো নিউজ : সম্প্রতি পোশাক ফ্যাক্টরির মালিকেরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি চাইতে। এটি আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য কতটুকু সতর্ক বার্তা?মির্জা আজিজুল ইসলাম : এটি নিয়ে মতবিরোধ আছে। যেমন দেশের ভিতর বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই বলে অর্থ পাচার না করে দেশের বাইরে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে বিশেষ লাভবান হওয়া যাবে।নেতিবাচক হচ্ছে, পরিবেশ নেই বলে বাইরে বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য শুভকর হতে পারে না। এটি হলে দেশে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করি। অভ্যন্তরীণ পরিবেশের দিকে নজর দিয়েই আমাদের বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হবে।এএসএস/এসআই/এসকেডি/এআরএস/এমএস
Advertisement