কোথায় কখন কিভাবে শুরু? বলা যায় শুরুটা ফেসবুকেই। প্রবাস জীবনে ষড়ভুজা হয়ে কাজ করতে হয়। আর আমি যেন প্রবাস জীবনেই প্রথম নিজের জন্য একান্ত কিছু অবসর পেয়ে গেলাম। নিজের জীবন, আর দশটা মানুষের জীবন তৃতীয় চোখ দিয়ে দেখার একাগ্রতা পেয়ে বসলো। নিরাপদ জীবনটা দেশের অনিশ্চিত জীবনে নিজেকে নিয়ে ভাবার ক্ষুদ্রতাটা দূর করে মনে অনেকটা শুভ্র ফাঁকা জায়গা তৈরি করে দিল। অনেক কিছু পাখির চোখে পর্যবেক্ষণ করতে জানলাম, এর গুরু অর্থ, উত্তরণের উপায় গোটাবিশ্বের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণে উন্মোচিত হল। সামাজিক যোগাযোগে রোজ এমন অনেক উপলব্ধিই লিখতাম। তাতে অনেকে উদ্দীপনা যোগাতো। “বিনম্র উদ্দীপনা! রোজ অনেকেই এমন অনেককেই দেয়”- তাই আমলে আনিনি।শ্রদ্ধেয় এক ভাইয়ের একগুঁয়ে লেগে থাকা আমার লেখনিতে বের করলো প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে জাপানের পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা নিয়ে আমার কলাম। এরপর বহুদিন গড়িয়ে গেছে। এক আধটা কলাম লিখেছি। ‘বই লিখবো’ কোনোদিন কল্পনাতেও ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার পদার্থ বিভাগের এক ছোট ভাইয়ের লেখা পড়ে ভালো লাগতো। তাকে বই প্রকাশে উদ্দীপনা দিতে নিজেই প্রকাশক খুঁজতে নামলাম। ফেসবুকে সন্তরণ করে আমার ছেলেবেলার স্কুল উদয়নের বড় ভাইয়ের সুপরিচিত প্রকাশনী “জাগৃতি”কে আমার বন্ধু তালিকায় পেয়ে রীতিমাফিক বার্তা পাঠালাম। মুহূর্তেই খুব গুছিয়ে আন্তরিক উত্তর এলো। আমি একবাক্যে ‘মুগ্ধ হয়ে গেলাম’! এমন সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ প্রকাশনীর প্রকাশকের নিয়ম-কানুন গুছিয়ে লেখা সম্যক উপদেশে এতো দ্রুত আন্তরিক উত্তর- তাও পুরোপুরি অচেনা, প্রবাসী একজনকে! শুরু থেকেই মুগ্ধ করেছিল জাগৃতির দীপন ভাইয়ের পরিশীলিত পরিমিতি বোধ, শিষ্টতা, নিঃস্বার্থ আন্তরিকতা। কারণ, অকাট্য সত্য, আমাদের দেশে এই সবকয়টি গুণই একেবারে বিরল। সংস্কারবদ্ধ পরিবারে বেড়ে ওঠা আমার জন্য সম্পূর্ণ অজানা জগতে প্রবেশের অভিপ্রায় তিনি এককভাবে জাগ্রত করেছিলেন তাঁর অসাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলী দিয়েই।মূলত উদয়ন স্কুলে তাঁর অনুজ ছিলাম জেনে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট পড়ে তিনি আমাকেই লেখা পাঠাতে বললেন। রক্ষণশীল পরিবারের ঘরকুনো আমার মধ্যে অন্য এক সত্ত্বা বাস করে। সেই সত্ত্বা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনো বয়সে, যে কোনো পেশাজীবী হয়ে বিশ্বের প্রতিটি আনাচে কানাচে যখন খুশি ঘুরে বেড়ায়। অজস্র প্লটে সে অভিনয় করে যায়। কত বিচিত্র প্লট চোখের সামনে অদৃশ্য পর্দার মতো দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে- গোটা চলচ্চিত্রই তৈরি হয়ে যায়। ৭ দিনে এমনই একটি প্লটের ৪ পাতা লিখে পাঠালাম।দীপন ভাইয়ের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। আমার প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি “তোরসা”র ৪ পাতা পড়ে কিছু প্রশ্ন করে তিনি পরম বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন যে এটি আগাগোড়া কাল্পনিক কাহিনী- বাস্তবে এমন কাহিনী বা চরিত্রের সাথে আমার কোনো পরিচয় নেই, এমনকি সেনাবাহিনীতে আমার পরিবারের বা ঘনিষ্ট পরিচিত কেউই নেই। ব্যস, তিনি আদাজল খেয়ে লেগে গেলেন সুপ্ত চারা গাছকে জল-আলো-বায়ু সম্যক প্রভাবক দিয়ে মহীরুহ করে তুলতে। কোনোদিন তাঁর কাছ থেকে জানা হয়নি আমার লেখা তাঁর কাছে কেমন লাগতো। অন্য সতীর্থ লেখক, এডিটর, চিত্রশিল্পী- যাঁদের তিনি আমার সম্পর্কে বলেছেন তাঁদের কাছে আমাকে নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়েছি। ২০শে ফেব্রুয়ারী, যেদিন আমার মতো অচেনা লেখকের প্রথম বই জাগৃতির অন্য তিনজন সেলিব্রেটি লেখকদের সাথে ২য় মুদ্রণে গেল, সেদিন অনেকেই বলেছিল দীপন ভাই প্রকাশনা জগতে ২৩ বছর আছেন বলে তিনি জানতেন এই বই আলোড়িত হবে, তাই তিনি অজানা লেখকের বই এমন বিনা শর্তে ছাপার ঝুঁকি নিয়েছিলেন । আমার উত্তর ছিল, ফেসবুক বা ক’পাতার কলাম লেখা আর গোটা উপন্যাসে যোজন-যোজন ফারাক। ২০১৫ বইমেলায় আমার লেখক সত্ত্বার প্রথম প্রকাশককে করুণাময়ের অসীম মমতা যে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছিল তাতে শুধুই মনে হয়েছে “এই মনিহার আমায় নাহি সাজে- “সত্যিই!!ভালোবাসার মান রাখতে বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে ১০৮টা নীল পদ্ম খুঁজে আনবার মতই টানা ৫ মাস আনাচ কানাচ সেচে তুলে আনা সম্যক তথ্য ভাণ্ডার দিয়ে কল্পনার তাজমহল গড়েছি। ২য় বইয়ের প্লট আমার বর্তমান আবাসস্থল জাপান এবং আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ। ইতিহাস আশ্রিত বর্তমান পটভূমির এক থ্রিলার কাহিনী। ‘সামুরাই যোদ্ধা শ্রেণি’ জাপানের হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাপানকে জানার পরপরই সামুরাইদের প্রতি চাপা আগ্রহ আরও অদম্য হয়ে ওঠে আলোচিত " The last Samurai" ছবিটি দেখে। ২য় বইয়ের প্লট কী হতে পারে ভাবতেই হঠাৎ করেই তাঁদের নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলো। সামুরাই শ্রেণি অবলুপ্ত হয়েছে আজ প্রায় দেড়শ বছর। তাঁদের নিয়ে কোনো ইতিহাস ইংরেজিতে লেখা কোনো বইয়ে মেলে না। যাও মেলে তার সনাতন ইংরেজিতে দাঁত ফোটানো দায়। ইন্টারনেটেও অনেক পড়লাম। সামুরাইদের অনেকটা জানার পর সত্যিকারের এমন কোনো সামুরাই ক্যাসেলকে কাছ থেকে দেখার এবং সেই পরিবারের গল্প জানার জন্য অনেক খোঁজ লাগিয়ে অসংখ্যবার যোগাযোগ করে সন্ধান পেলাম "ইয়ানাগাওয়া" শহরের লর্ড সামুরাই তাচিবানা পরিবারের বাসভবন "ওহানা ক্যাসেল"। কিন্তু তাঁদের উত্তরপুরুষেরা কারো সাথে দেখা করবেন না, সামুরাই জীবনশৈলী নিয়ে সাক্ষাৎকার দেবেন না। তাঁদের আশংকা, তাঁরা আদৌ কতটা রক্ষা করতে পেরেছেন সেই আচার! ত্রুটিপূর্ণ কিছু বলে ফেললে পূর্বপুরুষদের প্রতি চরম অসন্মান হয়ে যাবে! অগত্যা, লব্ধ জ্ঞানই সম্বল। দেশের পটভুমিটা লিখতে হাজারগুণ ঝক্কি! প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তা, রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় তথ্যপ্রকাশে নাজুকতা। প্রবাসে বসে দেশের এতোসব প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে এইসব তথ্য সংগ্রহ করে এরপর হাফ ছেড়ে লিখতে বসা। তবে, প্লট মাথায় থাকলে তথ্য সংগ্রহের পর লেখা নামতে সময় নেয় না। অফিস, সংসার সামলে রাত এগারোটা, বারোটায় লিখতে বসি- রাত ২টা আড়াইটায় উঠি। ছুটির দিন লেগে থাকে সাপ্তাহিক বাজার, ঘড় গোছানো, স্তুপাকৃতি কাজ আর ছোট্ট গণ্ডিতে থাকা বাঙালি পরিবারের এর-তাঁর বাড়ি দাওয়াত পর্ব। এছাড়াও জড়িয়ে আছি বিভিন্ন সামাজিক কাজে জাপানে, দেশে। তাও পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে মাস দেড়েকের বেশি লাগেনি। পরিবারের সহায়তা বড় কারণ। শেষ সেপ্টেম্বরে পাণ্ডুলিপি দাঁড়িয়ে গেল। উপন্যাস, “সিবতু”। ফার্সী “সিবত্” শব্দ থেকে নেয়া নাম, অর্থ “নাতি” grandson, দুই দেশের দুই নাতিকে নিয়ে কাহিনী রচনা। অকস্মাৎ এক অন্ধ প্রলয় কেড়ে নিল আমার লেখক সত্ত্বার জনক, প্রকাশক দীপন ভাইকে। লেখা থমকে গেল। পাণ্ডুলিপি অবরুদ্ধ হয়ে গেল। উদীয়মান প্রতিশ্রুতিশীল “আদর্শ প্রকাশন” অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার লেখা, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং সিদ্ধান্তের প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধা জানিয়েই আমার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা, ‘জাগৃতির’ বর্তমান কাণ্ডারীদের পূর্ণ অনাপত্তি নিয়ে পাণ্ডুলিপি পুনর্মূল্যায়ন করে তাঁদের হাতে ডিসেম্বরের শেষে তুলে দেয়া অবধি নিঃশর্ত অপেক্ষায় থেকে গেছেন। কেন লিখি? এর উত্তরে বলতে পারি, নিজের উপলব্ধিগুলো অন্যদের জানাতে লিখি, ধরায় একটা পদচিহ্ন রেখে যেতে চাই বলে লিখি, “কি জানি কিসেরও লাগি প্রাণ করে হায় হায়”- প্রাণের এই হাঁপিয়ে ওঠাটুকু জুড়োতেই লিখি। কি লিখি? - যেমন লেখা আমার পড়তে ভালো লাগবে, আমি যেমন কোন লেখা খুঁজবো, কোন লেখাতে যা খুঁজবো তেমনটাই লিখি। পাঠকের ভালো লাগাটা অনেক উপরি পাওয়া! জানি না পাঠক প্রত্যাশার দাবি এবং প্রকাশকের অকৃত্তিম আগ্রহের মান কতটুকু রক্ষা করতে পারবো। যদি পারি, জীবনে শতসহস্র বারের মতো আবারও প্রতিপালকের প্রতি নত মস্তকে বিনম্র উচ্চারণ হবে, “ আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি, যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েওতো কিছু নাও নি।” লেখক: কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।এইচআর/এমএস
Advertisement