স্বাস্থ্য

একটু সুখবরের আশায় স্বজনদের ক্লান্তিহীন অপেক্ষা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)। ২০ শয্যার আইসিইউর প্রতিটিতে সবসময় মুমূর্ষু রোগী চিকিৎসাধীন থাকেন। প্রতিনিয়ত যমে-মানুষে টানাটানি চলে এ ওয়ার্ডটিতে।সরেজমিনে দেখা গেছে, আইসিইউতে প্রবেশ গেটের বাইরে প্রতিদিন অসংখ্য রোগীর স্বজন নাওয়া-খাওয়া ভুলে একটু সুখবরের আশায় চাতক পাখির মতো ক্লান্তিহীনভাবে অপেক্ষা করতে থাকেন। মাঝে মাঝে নিরাপত্তারক্ষী বেড নম্বর উল্লেখ করে উঁচু গলায় হাঁকছেড়ে ডাকলেই কাছে ছুটে যান।রোগীকে দেখাতে কখনো তাদের ভিতরে ডেকে নেয়া হয়। তড়িঘড়ি করে অ্যাপ্রোন পরে ভেতরে একজন ছুটে যান। সে না ফিরে আসা পর্যন্ত বাইরে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করেন অন্যান্য স্বজন। আবার কখনো সাদা কাগজের একটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ-ইনজেকশন কিনে আনতে বলা হলে দ্রুতবেগে ছুটে যান স্বজনরা।এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে একাধিক রোগীর স্বজন জানান, ভেতর থেকে ডাক আসলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রথমেই মনে হয়, কোনো খারাপ খবর নাতো, আবার পরমুহূর্তেই মনের কোণে সামান্য আশার আলো উঁকি দেয়। তবে বেশিরভাগ সময়েই ভেতর থেকে খারাপ খবরই আসে।তারা বলেন, আইসিইউতে রোগী থাকা মানেই জলের স্রোতের মতো টাকা-পয়সা খরচ হয়ে যাওয়া। প্রতিটি ওষুধ-ইনজেকশনের দাম অনেক বেশি। আইসিইউতে চিকিৎসা করাতে এসে অনেক রোগীর স্বজনরা সঞ্চিত অর্থ, হালের গরু, বসতভিটা ও জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান।ফেনীর লালপুরের ট্রাক ড্রাইভার নেকবর খান গত তিন মাসেরও বেশি সময় যাবত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে বর্তমানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। অপর এক ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে আহত হলে তাকে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও পরে ঢামেক আইসিইউতে আনা হয়।বৃহস্পতিবার আইসিইউর গেটের বাইরে অপেক্ষমান তার স্ত্রী জানান, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাদের সংসার বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা সংসারটাকে তছনছ করে দিয়েছে। প্রথম কয়েকদিন প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা করাতে লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এরপর ঢামেক হাসপাতালে আনা হলে খরচ কিছুটা কমলেও থেমে নেই। তবুও স্বামীর সুস্থতা কামনায় জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাচ্ছেন তিনি।নাজমুন নাহার তুলি নামের এক কিশোরী গত একমাসেরও বেশি সময় যাবত আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। সড়ক দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেলে তাকে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তার মা জানান, আইসিইউর গেটের বাইরে তারা পর্যায়ক্রমে অপেক্ষা করেন। ভেতরে ঢুকলেই নাকে-মুখে নল লাগানো মুমূর্ষু রোগী ও আইসিইউ মেশিনের শব্দগুলো শুনলে তার ভয় লাগে। তবুও সুখবর শোনার অপেক্ষায় সর্বক্ষণ থাকেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।ঢামেক হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুর রহমান বলেন, ঢামেক হাসপাতালে কম খরচে আইসিইউ চিকিৎসা পাওয়া যায় বিধায় এখানে একটি বেড পেতে রোগীদের লম্বা লাইন লেগে থাকে। তিনি জানান, আইসিইউতে ভর্তি সকল রোগীই মুমূর্ষু থাকেন। আইসিইউ থেকে রোগী হয় ভালো হয়ে বের হন নতুন লাশ হয়ে বের হন। ফলে ইচ্ছে করলেই এখানে কাউকে বেড দেয়া সম্ভব হয় না।তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ মানুষ প্রাইভেট হাসপাতালে সর্বস্ব খুইয়ে শেষ পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালে ছুটে আসেন। আইসিইউর চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল ফলে সরকারিভাবে সব ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। তবুও সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারা যায় ততটুকু বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়।যখন কোনো রোগী জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে প্রাণে বেঁচে আইসিইউ থেকে সুস্থ হয়ে বিদায় নেন তখন স্বজনদের মতো তাদেরও ভালো লাগে বলে মন্তব্য করেন এই অভিজ্ঞ প্রবীণ চিকিৎসক।এমইউ/বিএ

Advertisement