মতামত

সম্প্রীতি আর ঐক্যের ছোঁয়ায় ঈদুল আজহা

আজ ১০ জিলহজ, পবিত্র ঈদুল আজহার দিন। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ অত্যন্ত ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করছেন। বিশ্ববাসীর মাঝে যে আনন্দ বার বার ফিরে আসে তাকেই ঈদ বলা হয়।

Advertisement

মুসলিম জাহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে অতীতের ভুল-ভ্রান্তির ক্ষমা চেয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলার অঙ্গীকারে প্রত্যয়ী হওয়ার এক সফল অনুষ্ঠান এ পবিত্র ঈদ। বর্তমান ঈদকে কেবল ধর্মীয় কিংবা সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বরং ঈদ আজ সার্বজনীন আনন্দের নাম। সামাজিক উৎসবগুলোয় আমরা যেমন আনন্দে মাতি, তেমনি প্রত্যেক ধর্মেই রয়েছে বিশেষ কিছু উৎসবমুখর দিন। সেই উৎসবগুলোও আমাদের আনন্দে ভাসায়।

ব্যবধান ঘুচিয়ে এক করে। ঈদের আনন্দে দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের সাথে ভাগ করার মাঝেই সর্বাঙ্গীন কল্যাণ। ঈদুল আজহা মুসলিম উম্মাহকে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য এবং ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দেয়। এভাবে ঈদুল আজহার উৎসব ইসলামি জীবন পদ্ধতির ভিত্তিতে একটি বিশ্বজনীন নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। এ আনন্দের দিনে প্রতিটি মুসলিম তার সামাজিক অবস্থান ভুলে যায় এবং ভ্রাতৃত্ববোধের পর তৃপ্তিতে একে অপরকে আলিঙ্গন করে। পার্থক্য থাকে না ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সবল-দুর্বল, বংশ গৌরব, কৌলিন্য ও মান-মর্যাদা। ঈদগাহে সারিবদ্ধভাবে জামাতের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের দু’ই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষেই সাম্যের অতুলনীয় বাস্তব দৃশ্যের চিত্র ফুটে ওঠে।

মুসলমানের জন্য ঈদ একটি মহা ইবাদতও। ঈদের ইবাদতে শরীয়ত নির্দেশিত কিছু বিধি-বিধান রয়েছে, যা পালনে সামাজিক জীবনে পারস্পরিক আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও বন্ধন সুসংহত হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.)এর কুরবানির অনুসরণে মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ১০ই যিলহাজ তারিখে পশু কুরবানি করে থাকে।

Advertisement

ইসলামে এই যে কুরবানির শিক্ষা তা কি কেবল একটি পশু কুরবানির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়ে যায়? আসলে পশু কুরবানি করাটা হচ্ছে একটা প্রতিকি মাত্র। আল্লাহতায়ালা চান মানুষ যেন তার পশুসূলভ হৃদয়কে কুরবানি করে, তার আমিত্বকে কুরবানি করে আর সেই সাথে তার নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়াকে আল্লাহর খাতিরে কুরবানি করে দেয়।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের কুরবানি এমনই ছিল। তারা ব্যক্তি স্বার্থকে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছিলেন।

আল্লাহর সাথে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি কোরবানি চান আর এ কুরবানির অর্থ কেবল পশু জবেহ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ কুরবানি কারো জন্য নিজ প্রাণের কুরবানিও হতে পারে আবার কারো নিজ পশুত্বের কুরবানিও হতে পারে। আমরা যদি মনের পশুকে কুরবানি করতে পারি তাহলেই আমরা আল্লাহতায়ালার প্রিয়দের অন্তর্ভূক্ত হতে পারব।

এছাড়া বাহ্যিকভাবে যত বড় পশুই কুরবানি করি না কেন তা তার কাছে মূল্য রাখে না। যেভাবে পবিত্র কুুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘এগুলোর মাংস বা এদের রক্ত কখনো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তার কাছে তোমাদের পক্ষ থেকে তাকওয়া পৌঁছে’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৭)।

Advertisement

সুতরাং হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত অনুযায়ী নবি করিম (সা.)-এর নির্দেশে কুরবানি পালনের মাধ্যমে প্রতি বছর একজন মুসলমান নিজের মাঝে তাকওয়াকে আরেকবার ঝালিয়ে নেন যেন প্রয়োজনের দিনে আল্লাহর পথে কুরবানির পশুর মতো নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন। কবি নজরুল কত চমতকারই না বলেছেন, ‘মনের পশুরে কর জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।’

ঈদুল আজহার শরিয়ত দিক হলো, ঈদ গাহে দু’ রাকাত নামাজ আদায় করা, খুতবা শুনা এবং উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করা। ঈদের নামাজের আগে কিছু না খাওয়া মোস্তাহাব। নবী করিম (সা.) ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজ আদায় পর্যন্ত কিছুই খেতেন না। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)। এছাড়া ঈদগাহে একপথ দিয়ে যাওয়া ও অন্যপথ দিয়ে ফেরা সুন্নত। (বোখারি) ঈদের নামাজ শেষে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কুরবানি করাই হচ্ছে মুসলমানদের মূল কাজ।

ঈদে আমাদের দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটে আর পরস্পরের মাঝে ঈমানী ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের মাঝে হিংসা বিদ্বেষ দূর হয়ে এক স্বগীর্য় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যদি এমনটা হয় তাহলেই আমাদের এ ঈদ পালন ইবাদতে গণ্য হবে।

সুনানে ইব্ন মাজাহ গ্রন্থে ঈদের ফজিলত সম্পর্কে এসেছে, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ইবাদত করবে তার অন্তরকে আল্লাহতায়ালা রহমত ও বরকতের বারিধারা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ)

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ঈদের দিন আল্লাহ তা’লা ফেরেশতাদের বলেন, তারা আমার ফরজ আদায় করে প্রার্থনার জন্য বের হয়েছে। আমার মর্যাদা বড়ত্ব ও সম্মানের কসম! আমি অবশ্যই তাদের প্রার্থনা কবুল করবো।

তারপর আল্লাহ বান্দাদের উদ্দেশ করে বলেন, ফিরে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমাদের পাপগুলোকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছি। এরপর সবাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। (বায়হাকির সূত্রে মেশকাত, অধ্যায়: হায়াতুল মুসলিমিন, পৃ: ২৪৯)।

ঈদের উৎসবে একটু আনন্দের মধ্যে থাকা, খেলাধুলা করা বা উপভোগ করার শিক্ষা আমরা নবীজির জীবন থেকে পাই। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এক ঈদের দিন হজরত আবু বকর (রা.) আমার ঘরে এলেন। সেখানে তখন দু’জন মেয়ে বুআস যুদ্ধের গান গাইছিল। তারা গায়িকা ছিল না।

হজরত আবু বকর (রা.) ওই মেয়ে দুটোকে শক্ত ধমক দিয়ে বললেন, শয়তানি বাদ্য! তাও রাসুলের ঘরে! রাসুল (সা.) বললেন, আবু বকর! ওদের ছেড়ে দাও। প্রতিটি জাতিরই ঈদ ও খুশির দিন থাকে। আজ আমাদের ঈদের দিন। (সহিহ বুখারি)।

ঈদ উদযাপন মূলত আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আর কৃতজ্ঞতার সর্বোত্তম পন্থা হলো, ধনী-গরীব সবাই একত্রিত হয়ে ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করা। ঈদ কেবল ভাল খাওয়ার বা ভাল পরার আর বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় আনন্দ ভ্রমণ করার নাম নয় বরং কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য একটা বিশেষ সুযোগ হিসেবে আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে ঈদ দান করেছেন।

আমরা ঈদ উদযাপন করছি, আমাদেরকে সর্বদা এটিও স্মরণ রাখতে হবে, শুধু আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে না থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ের প্রতিও যেন দৃষ্টি থাকে। আমরা যখন পুরোপুরি স্থায়ীভাবে আমাদের গরীব ভাইদের অভাব দূরীকরণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো তখনই এটা আমাদের প্রকৃত ঈদ উদযাপন হবে।

কার ধর্ম কী, এটা দেখার বিষয় নয়, মানব সেবাই হল পরম ধর্ম। এছাড়া একই উৎস থেকে আমাদের সবার সৃষ্টি। ঈদের এই আনন্দ তখনই সার্বজনীন রূপ লাভ করতে পারে যখন সমাজ ও দেশের সবাই একত্রে আনন্দের ভাগী হব। আমাদের সন্তানদেরকেও ঈদের এ মাহেন্দ্রক্ষণে গরীবদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের শিক্ষা দিতে হবে।

ঈদের যে উপহার তাদেরকে দেয়া হয়, তা থেকে যেন তারা একটা অংশ গরীবদের জন্য পৃথক করে নেয়। তারা যেন শুধু নিজেদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতিই খেয়াল না রাখে, নিজেরাই যেন ভাল খাবার ইত্যাদি না খায় বরং গরীব, অসহায় যারা রয়েছে তাদের প্রতিও যেন খেয়াল রাখে। এ শিক্ষা আমাদের প্রত্যেক অভিভাবককে দিতে হবে।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে যেমন ইসলামি ঐতিহ্যের জয়গান গেয়েছেন, অপর দিকে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। আবার ঈদের আনন্দকে সার্বজনীন হিসেবে তুলে ধরার জন্য লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা।

‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় তিনি তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন এভাবে- শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো/কত বালুচরে কত আঁখি ধারা ঝরায়ে গো/বরষের পর আসিলে ঈদ!/ভুখারির দ্বারে সওগাত বয়ে রিজওয়ানের/কন্টক-বনে আশ্বাস এনে গুলবাগের.../আজি ইসলামের ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান/নাই বড় ছোট-সকল মানুষ এক সমান/রাজা প্রজা নয় কারো কেহ-

তিনি ইসলামী সাম্যবাদী চেতনাকে সর্বজনীন রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন তার বিভিন্ন কবিতায়। তার ‘নতুন চাঁদ’ কবিতায়ও বিষয়টি এভাবে ব্যক্ত করেছেন- সাম্যের রাহে আল্লাহর/মুয়াজ্জিনেরা ডাকিবে ফের.../রবে না ধর্ম জাতির ভেদ/রবে না আত্ম-কলহ ক্লেদ। এরপর ‘কৃষকের ঈদ’ পঙক্তিতে তিনি লিখেছেন- জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

ঈদকে নিয়ে কবি কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’ নামে একটি কবিতায় তার ঈদ অভিব্যক্তি এভাবে তুলে ধরেছেন- ‘এই ঈদ বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান, হয় সিদ্ধ, বুঝে না তা স্বার্থপর মানব সন্তান। এ ত নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধুলা খেলা। এ শুধু জাতীয় পূণ্যমিলনের এক মহামেলা।’

ঈদের দিন যেভাবে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে যায়, এক কাতারে সবাই নামাজ আদায় করি, সবার সাথে হাসি মুখে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করি, ঠিক তেমনিভাবে সারাবছর একই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে আর বিভেদের সকল দেয়ালকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে।

বিশ্বময় সর্বপ্রকারের হিংসা বিদ্বেষ ও হানাহানি মুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন দৃঢ়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক হাসিখুশি ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। ঈদুল আজহা উদযাপনের মাধ্যমে সবার মাঝে ভ্রাতৃত্বের মেল বন্ধন রচিত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সবাইকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।

এইচআর/জেআইএম