বেসিক ব্যাংক নীতি বহির্ভূতভাবে নজিরবিহীন দুর্নীতি করেছে বলে মন্তব্য করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। আর এসব দুর্নীতি বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার জন্য স্থায়ী কমিটি তলব করলেও বৃহস্পতিবারের বৈঠকে আসেনি দুদক। এনিয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের যতসব দুর্নীতি তা একত্রিত করে তাদের কাছে জবাব চাওয়ায় জন্য কমিটি আগামী বৈঠকে বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের তলব করা হয়েছে বলে কমিটি সূত্রে জানা গেছে।বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর উপস্থিতি ছিলেন। কমিটির সভাপতি ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, মো. আব্দুল ওয়াদুদ, ফরহাদ হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, মো. শওকত চৌধুরী এবং আখতার জাহান বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে বেসিক ব্যাংক, মন্ত্রণালয় এবং সংসদ সচিবালয় মিলে একটি সার-সংক্ষেপ প্রস্তুত করা হবে বলে জানা গেছে। বৈঠকের কার্যপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। কার্যপত্রে উল্লেখিত বেসিক ব্যাংক সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলো হল- প্রকৃত যাচাই বাছাই ছাড়া ভূয়ো দলিলে প্রচুর পরিমান ঋণ মঞ্জুরী করা হয়, ক্রেডিট কমিটির নেতিবাচক ভূমিকা উপেক্ষা করে জাল দলিলে ভুয়া কোম্পানিকে ঋণ বিতরণ করা হয়, অনিয়মিত ঋণ বিতরণের লক্ষ্যে চড়া সুদে আমানত গ্রহণ করা হয়, কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়া ঘুষের মাধ্যমে অযোগ্য ও স্বজনরদের উচ্চপদে নিয়োগ করা, এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের না নিয়ে ৩০ উর্ধ্ব বয়সের আত্মীয় পরিজনদের চাকরি দেয়া হয়েছে। এছাড়া কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ব্যাংকের নীতিমালা অমান্য করে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করা হয়েছে, এসব ক্ষেত্রে স্বজনদের নিয়োগ দেয়ার জন্য বেআইনিভাবে পদ সৃষ্টিও করা হয়।কার্যপত্র অনুযায়ী- বর্তমানে দেশের ৬৮টি শাখায় মোট জনবল ২১৯৭ জন। সেক্ষেত্রে শাখা প্রতি ৩২.৩ জন, যা মাত্রাতিরিক্ত। এছাড়া শাখা স্থাপনের জন্য কোন বাণিজ্যিক সক্ষমতা যাচাই না করে ইচ্ছে অনুযায়ী কোনো কোনো স্থানে শাখা খোলা হয়েছে। নীতি বহির্ভূতভাবে অত্যাধিক অগ্রিম প্রদান করে আদায় করা হয়নি, অফিসভাড়ার ক্ষেত্রেও মাত্রাতিরিক্ত ভাড়ায় অফিস নেয়া হয়। এছাড়া প্রয়োজনাতিরিক্ত নতুন গাড়ি ক্রয় করা হয় বলে জানা গেছে।কার্যপত্রে অভিযোগ করা হয়, জমির মালিকানা নিশ্চিত না হয়ে ভুয়া জমির দলিল জামানত হিসেবে নিয়ে জমা টাওয়ারকে ৭৬ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়, যা পরে ডিফল্টার হলে আসল দলিল আদায় করা যায়নি বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।ব্যাংকটির হিসাব বিবরণী থেকে দেখা যায়, এসব কারণে ২০০৯ সালের পর থেকে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। ২০১০-২০১৪ সালের হিসেব বিরবরণীতে দেখা যায় ২০১৫ সালের শেষে ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় মোট ঋণের ৬৭.৯২ শতাংশ। যদিও ২০১৫ সালের পর থেকে তা হ্রাস পেয়ে দাড়ায় ৬৪৫৬.৩৮ কোটি অর্থাৎ ৫০.১২ শতাংশ। তবে শুধু ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির ক্ষতি বা লোকসান হয় ৩১ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৪ সালে বেসিক ব্যাংকের মোট ৬৮টি শাখার মধ্যে লোকসানে ছিল মোট ৩৭টি শাখা। ২০১৫ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ২৫ এ। সভার বিবরনীতে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক নীতিবহির্ভূতভাবে নজিরবিহীন দুর্নীতি করেছে। যার ফলে ব্যাংকটির আর্থিক সূচকের সবগুলোতে ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এ কারণে আগামী বৈঠকে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে।বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম তদন্তকারী সংস্থা দুদককে কমিটিতে তলব করেও শেষ পর্যন্ত হাজির করাতে পারেনি কমিটি। এর আগের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছিলেন, বেসিক ব্যাংকের ফাংশনাল অডিটে অনিয়ম ধরা পড়েছে। একই সঙ্গে দুদক কেন এসব অনিয়ম পেল না সেটা নিয়েও কমিটিতে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন গভর্নর। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদককে বৈঠকের থাকার জন্য চিঠি দিয়েছিল সংসদীয় কমিটি।উল্লেখ্য, বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় গত বছরের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশান, মতিঝিল ও পল্টন থানায় ৫৬টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় মোট আসামি ১২০ জন। এদের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ২৬ জন। এ ছাড়া ঋণগ্রহীতা ৫৪ প্রতিষ্ঠানের ৮৪ জন এবং সার্ভে প্রতিষ্ঠানের ১০ জনকে আসামি করা হয়। তবে কোনো মামলায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বা পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি।এছাড়া বৈঠকে দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ব্যাংক ঋণের সুদের হার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির পর্যবেক্ষণে সুদের হার এক অঙ্কে (সিঙ্গেল ডিজিট) নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদের হার কমাতে পরামর্শ দিলেও, তা না কমানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করে কমিটি।এইচএস/এসএইচএস/পিআর
Advertisement