দেশবাসীকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একইসাথে লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি চান, কখন কোথায় লোডশেডিং হবে- সেই সময় নির্ধারণ করে দেয়া হোক।
Advertisement
খোদ সরকারপ্রধান যখন এমনটা বলেন তখন বিষয়টার গভীরতা নিয়ে চিন্তিত হতে হয়। বুঝতে বাকি থাকে না যে, রাজধানীসহ সারাদেশের শহরে বন্দরে, গ্রামে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট আবার ফিরেছে। সরকার লোডশেডিং করছে বাধ্য হয়ে, কারণ প্রয়োজনীয় গ্যাস নেই।
সরবরাহ–সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম চড়া, তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আপাতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার।
দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। শিল্পকারখানায়ও বিপুল পরিমাণ গ্যাস লাগে। লাইনে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় শিল্পকারখানায়ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। একজন কনজ্যুমার পণ্য উৎপাদনকারী আমাকে বলেছেন, গ্যাসের অভাবে তিনি এই ঈদের সময়ে চাহিদার বিপরীতে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পেরেছেন মাত্র ২৫ ভাগ।
Advertisement
সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের মানুষ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলে লোড শেডিং ভুলতে বসেছিল। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ার পর লোডশেডিং মোটামুটি বিদায় নিয়েছিল। সেটা আকস্মিকভাবে ফিরে আসায় মানুষের মধ্যে একটা ভয় সৃষ্টি হয়েছে।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৭০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা যেত। এর মধ্যে দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত হয় ২২০ থেকে ২৩০ কোটি ঘনফুট। বাকি ৭০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট আমদানি করা হয়। দুই দিন ধরে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট।
বিদেশ থেকে জাহাজে তরল অবস্থায় গ্যাস আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালে। তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেলে সংকট তৈরি হবে। এখন সেটাই ঘটল। ২০২০ সালে যে গ্যাস প্রতি ইউনিট ৪ মার্কিন ডলারে নেমে গিয়েছিল, তা এখন বেড়ে ৩৮ ডলার ছাড়িয়েছে।
গত এক বছর ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ওঠানামার মধ্যে ছিল। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানির দাম আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাড়ছে এলএনজির দামও। এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন গত কয়েকদিনে এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
Advertisement
অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দামও বাড়তি। এতে দিনে ১০৮ কোটি টাকা লোকসান গুনছে বিপিসি। তাই তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। লোডশেডিংয়ের প্রভাব গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পড়েছে।
এই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন এমন এক জায়গায় নিআয়ে গিয়েছিল যে, আমরা ভেবেছিলাম কখনও বিদ্যুতের অপচয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না। এখন হঠাৎ করে বলা হচ্ছে, চাহিদা-জোগানে ভারসাম্যের অভাবেই সঙ্কট থেকে রেহাই মিলবে না সহসা।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একদিকে করোনা একটা অভিঘাত; তার ওপরে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। যার ফলে সমগ্র বিশ্বেই যেমন তেলের দাম বেড়েছে, অনেক দেশেই এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার।
সমস্যা হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত জমানায় যে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতো সেটা অনেক পুরোনো গল্প। যে মানুষটার বয়স এখন ২০, ১৩ বছর আগে তার বয়স ছিল ৭। সুতরাং সেই আমলের গল্প দিয়ে তারে কোনকিছু বোঝানো যাবেনা। তার কাছে সত্যটা হলো দিনে কয়েকবার করে বিদ্যুৎ যাচ্ছে।
একটা বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। কিন্তু আমরা পড়ে আছি নিজস্ব কাঠামোগত সংকটেও। সরকারি অফিসে যা হয় সেটা এখানেও আছে আর তা হলো দুর্নীতি। তরল গ্যাসের আমদানি খরচ বেড়েছে আমরা বলছি। কিন্তু নিজস্ব উৎপাদিত মিথেন গ্যাসের সরবারাহ ও বিপননে সিস্টেম লসের নামে দুর্নীতি চলছে অবাধে। সাড়ে ৮ শতাংশ গ্যাস সরবরাহে সিস্টেম লস আছে এবং সেটা বন্ধ করার কোন উদ্যোগ কোথাও নেই।
গত দুই বছর ধরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি না করে দেশীয় উৎপাদন ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আনা এলএনজি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও সিস্টেম লস কমিয়ে দুই শতাংশের মধ্যে আনা যায় তাহলে উচ্চমূল্যের গ্যাস আমদানি করতে হবে না।
একটা কথা মানতে হবে যে, কেবল ইউক্রেনের যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে বিদ্যুৎ ঘাটতির সব দায় এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে জরুরি সেবা খাতেও বড় সংকট দেখা দেবে। যেখানে বাংলাদেশের প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস আছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে, সেখানে জ্বালানি খাতে এই বিপর্যয় হলো কেন, তা এক বিরাট প্রশ্ন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, পরনির্ভর জ্বালানি নীতি দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থাকলেও অনুসন্ধান কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
আমাদের সাগর এলাকায়ও গ্যাস অনুসন্ধানে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করা হলে আশা করা যায় এ প্রতিষ্ঠান দেশবাসীকে গ্যাস খাতে বড় ধরনের সুখবর দিতে সক্ষম হবে। ভোলায় যে গ্যাস পাওয়া গেছে সেটাও পাইপলাইনের মাধ্যমে কেন্কেন্দ্রের দিকে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে।
এর মধ্যে শোনা যাচ্ছে আবারও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটি একটি বাজে ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল, তখন সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করেছে।
এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি এই অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়ানো হলে, অন্যায় হবে। আমদানি কমিয়ে দেওয়া হলেও তা সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেবে। সরকারকে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়াতেই হবে এবং একই সঙ্গে জ্বালানি খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস