২০১৯ সালে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক বিশ্বনাথ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তার মাঝে বেড়ে ওঠা জগতভাবনা নিয়ে “The physics of Tagore: Promoting the scientist in the poet” শিরোনামে নাতিদীর্ঘ এক নিবন্ধে লেখেন, “কবিতা আর পদার্থবিজ্ঞান দু’মেরুর বাসিন্দা—কবিতা যেখানে কল্পলোকের গভীরে বিচরণ করে পদার্থবিজ্ঞান সেখানে খোঁজ করে সেই কল্পলোকের ওপর ভেসে ওঠা ঘটনার পরিব্যাপ্তি” (দ্য হিন্দু, কলকাতা, ৮ নভেম্বর, ২০১৯)। অর্থাৎ একটা ছড়িয়ে দেয় ‘ভাব’; অন্যটা ছেঁকে তোলে ভাবের অন্তর্বাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘ঘটনা’ তথা ‘তথ্য’। এ কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই নানাভাবে বলেছেন। বিজ্ঞান যেখানে তথ্যের বাড়াবাড়ি নিয়ে সত্যকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলে, সাহিত্য বা কবিতা সেখানে সেই সত্যের কঙ্কালের ওপর চাপায় রসের প্রলেপ। ভাবের নান্দনিক সম্মিলনে রসের যে ধারা প্রবাহিত হয় সেটা গণ্ডূষ ভরে পান করেন সাহিত্য-রসিক। এ প্রসঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অব্যক্ত’ থেকে একটা উদ্ধৃতি না দিলেই নয়, ‘কবি এই বিশ্বজগতে তাঁহার হৃদয়ের দৃষ্টি দিয়া একটি অরূপকে দেখিতে পান, তাহাকেই তিনি রূপের মধ্যে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করেন। অন্যের দেখা যেখানে ফুরাইয়া যায় সেখানেও তাঁহার ভাবের দৃষ্টি অবরুদ্ধ হয় না। সেই অপরূপ ভাবনার বার্তা তাঁহার কাব্যের ছন্দে ছন্দে নানা আভাষে অনুরণিত হইতে থাকে। বৈজ্ঞানিকের পন্থা স্বতন্ত্র হইতে পারে, তবুও কবিত্ব সাধনার সহিত তাঁহার সাধনার ঐক্য আছে। দৃষ্টির আলোক যেখানে শেষ হইয়া যায়, সেখানেও তিনি আলোকের অনুসরণ করিতে থাকেন, শ্রুতির শক্তি যেখানে সুরের শেষ সীমায় পৌঁছায় সেখান হইতেও তিনি কম্পমান বাণী আহরণ করিয়া আনেন’। ( অব্যক্ত, ‘কবিতা ও বিজ্ঞান’, পৃ. ৯২, ১৯২১)
Advertisement
তবে মানব চৈতন্যের এ দু’টি দিকই যদিও সত্য অনুসন্ধান করে তবুও এদের পার্থক্য যে সুস্পষ্ট সেটা বোধকরি সবাই মানবেন। বিজ্ঞান আর সাহিত্য-কলার মাঝে একটা অবধারিত দূরত্ব আছেই, এটা সর্বজনবিদিত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এর ওপর বিস্তর লিখেছেন, বোঝাতে চেয়েছেন বিজ্ঞান যেখানে সত্যকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে জানতে চেয়েছে সাহিত্য সেখানে চেতনার কর্ষণে সত্যকে নিজের ভুবনে আপন রসে জারিত করে এর মর্ম প্রসারিত করেছে। তবে সারাজীবন সাহিত্য সাধনার শেষ প্রান্তে এসে মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে বিজ্ঞানের গভীর তত্ত্বের মাঝে তিনি নিজেকে একটু ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কেন তা চেয়েছেন কিছুটা বোধগম্যতার বাইরে হলেও তাঁর নিজের কথায় এর জট খোলেঃ “আজ বয়সের শেষ পর্বে মন অভিভূত নব্য প্রাকৃতিকতত্বে—বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ। …বিজ্ঞান থেকে যারা চিত্তের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন তাঁরা তপস্বী।—মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ, আমি রস পাই মাত্র। সেটা গর্ব করার মতো কিছু নয়, কিন্তু মন খুশি হয়ে বলে যথালাভ”। (বিশ্বপরিচয়, ভূমিকা)। এখানে অনুমান করা যায় বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ বলতে তিনি শংকরাচার্যের মায়াবাদ বোঝাননি কিম্বা রজ্জু-সর্প অধ্যাসকেও ইঙ্গিত করেননি। যা বলতে চেয়েছেন, তাহলো জগতের বিচিত্র গূঢ় রহস্যের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ। ১৯৩৭ সালে বিশ্বপরিচয় লেখার আগেই বিজ্ঞানের ইতিহাসে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। বিশেষ করে আপেক্ষতত্ত্ব আর কণাবাদী বলবিদ্যার মতো পদার্থবিজ্ঞানের অতি সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্বের ধুন্ধুমার কাণ্ড! সম্ভবত কণাবাদী বলবিদ্যার মধ্যে ইলেকট্রনের অস্বাভাবিক আচরণ তাঁকে বিস্মিত করেছিল। এটাকে তিনি নব্যপ্রাকৃতিকতত্ত্ব নাম দিয়ে থাকতে পারেন। সত্যি সত্যি অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মধ্যে মহাবিশ্বের যে হেঁয়ালি লুকিয়ে আছে, তা কিন্তু মায়াবাদের মতই এক দুরাতিক্রম্য সায়েন্টিফিক এনিগমা। রবীন্দ্রনাথের এ নিয়ে বিস্তর কৌতূহল ছিল। বিশেষ করে আইনস্টাইনের সাথে কথোপথনে বোঝা যায়, তিনি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বিষয় কী চমৎকার করে আয়ত্ত করেছিলেন। এ ধারণা পোক্ত হয় এই কথাগুলো পড়লে যে, “এখন মত দাঁড়িয়েছে, ইলেকট্রনের ডিম্বাকার চলার পথ একটি নয়, একাধিক। কেন্দ্র থেকে কক্ষপথগুলির দূরত্ব নির্দিষ্ট। কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছের যে পথ, কোন ইলেকট্রন তা পেরিয়ে যেতে পারে না। ইলেকট্রন বাইরের পথ থেকে ভিতরের পথে দর্শন দেয়। কেন দেয় এবং হঠাৎ কখন দেখা দেবে তার কোন বাঁধা নিয়ম পাওয়া যায় না। তেজ শোষণ করে ইলেকট্রন ভিতরের পথ থেকে বাইরের পথে লাফিয়ে যায়, এই লাফের মাত্রা নির্ভর করে শোষিত তেজের পরিমাণের উপর”। (১৩ খণ্ড, ৫৫৬)। জার্মান দার্শনিক হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা তত্ত্বে জানিয়েছিলেন, ইলেকট্রনের চরিত্র বড্ড বেশি অনিশ্চয়তায় ভরা। একই সাথে তার ভর ও অবস্থান নির্ণয় করা অসম্ভব। একটা করতে গেলে অন্যটা পাওয়া যায় না। এই অনিশ্চয়তার দোলাচলে বিশ্বজগত তরঙ্গের ন্যায় নেচে নেচে সামনে এগিয়ে চলেছে। এ যেন, গৌড়ের কবির মুখে উচ্চারিত সেই বাণী, “এসো ভাই, তোলো হাই, শুয়ে পড় চিত/ অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত—/ জগতের সকলি মিথ্যা, সব মায়াময়,/ স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়”। তবে মূল আলোচনায় প্রবেশের একটু আগে বলে রাখি, আইনস্টাইন কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানকে মেনে নিতে পারেননি যদিও তিনিই এর গোড়াপত্তনে বেশি ভূমিকা রেখেছেন বিশেষ করে নিলস বোরের সাথে তর্কযুদ্ধে আইনস্টাইন জগতের অনিশ্চয়তা গ্রহণ করেননি। তিনি মনে করতেন ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’। এর অর্থ মহাবিশ্বটা অত্যন্ত সুস্থিত ও নিশ্চিতভাবে মানুষের বোধের সীমানায় আটকানো। এর প্রেক্ষিতে বলা চলে, রবীন্দ্রনাথের উপনিষদিক দর্শনের ভাববস্তু সেই একই সুস্থিত মহাশক্তির অনন্য প্রকাশ। রাবিন্দ্রিক চিন্তায় এভাবেই ধরা দিয়েছে, “বিশজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি/ সেই তো স্বর্গভূমি।/ সবার নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছো তুমি/ সেই তো আমার তুমি”। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন একটা অভিন্ন সত্য খুঁজে ফিরেছেন। এটা সুস্পষ্ট যে, এই সত্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি ও প্রথম। দর্শনের ভাষায় যাকে আমরা ‘আল্টিমেট স্টাফ’ বলি। তবে সে সত্যের আকার কী হবে তা নিয়ে দ্বিধা থাকলেও জগতের অন্তরালে অপ্রকাশিত গতির অব্যাহত এক নির্গমন যে সদা ক্রিয়াশীল সে ব্যাপারে দ্বিধার অবকাশ কোথায়? তিনি অতি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন একটা সত্য নিয়ত মহাবিশ্বের অন্তরালে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, কী জীব কী জড়—সবকিছুই এই সত্যের অন্তর্গত। তাঁর নিজের কথায়, “প্রথম আদি তব শক্তি—/ আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে/ গগনে গগনে॥/ তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ,/ জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে”। এখানেই বোঝা যাচ্ছে, আদি শক্তি বা আল্টিমেট স্টাফ বলতে তিনি কী ইঙ্গিত করেছেন। এবার দেখে নেওয়া যাক বিজ্ঞান চেতনার শুরুটা কীভাবে।
বিজ্ঞানের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ সেই বাল্যকাল থেকে। বলা যায়, আশৈশব এই আগ্রহের কারণ পারিবারিক পরিবেশ। উপনিষদ ও বিজ্ঞান—এ দুটি বিষয়ই ছিল তাঁদের পারিবারিক পাঠ্যবস্তুর অন্তর্গত। এ ছাড়া তিনি গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছিলেন বিজ্ঞানের নানা বিষয়। প্রতি রোববার সীতানাথ দত্ত এসে প্রকৃতিবিজ্ঞান শিখিয়ে যেতেন। অক্ষয় দত্তের ‘চারুপাঠ’, ‘পদার্থবিদ্যা’ সাতকড়ি দত্তের ‘প্রাণীবৃত্তান্ত’ ইত্যাদি ছিল তাঁর পাঠ্যসূচির অন্তর্গত। মানবদেহ সম্পর্কে সম্যক পাঠ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগেও তাঁকে যেতে হতো। বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটা মৌলিক ধারণা, প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর শিখেছেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছ থেকে। ঠাকুর পরিবারে বিজ্ঞানচর্চার আবহ কেমন ছিল সেটা পাওয়া যায় একটা বর্ণনায়ঃ বিভিন্ন ও বিচিত্র বিষয়ের প্রতি আগ্রহ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ আগ্রহ ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূতত্ত্ব চর্চায়। মহর্ষির পুত্রদের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চর্চা করতেন ফ্রেনোলজি বা শিরোমিতিবিদ্যা। চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহী হেমেন্দ্রনাথ কিছুদিন মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেন। বীরেন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন নিভৃতে গণিত চর্চা। সোমেন্দ্রনাথের ঝোঁক ছিল দর্শনে। দেবেন্দ্রনাথের ভূবিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিদ্যার আগ্রহ প্রবাহিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ন-দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মধ্যে। বাড়িতে ব্রাহ্মধর্ম চর্চার পরিমণ্ডলে বড় হয়েও সত্যেন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে। রবীন্দ্রনাথ যেমন হোমিওপ্যাথি চর্চা করতে ভালোবাসতেন, সে রকম তাঁর একসময় বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল প্ল্যানচেটে। আর দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল আরও বিচিত্র ও বহুমাত্রিক। দর্শন ও সাহিত্য ছাড়াও জ্যামিতি ও বাক্সমিতি বা বক্সোমেট্রিতে ছিল তাঁর বিশেষ দক্ষতা। পশুপাখির প্রতি ছিল গভীর প্রেম ও মমত্ববোধ। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য, বাংলায় শর্টহ্যান্ড বর্ণমালার অন্যতম উদ্ভাবক তিনিই। ব্রহ্মসংগীতের স্বরলিপি প্রবর্তনও দ্বিজেন্দ্রনাথের হাত ধরেই। বিচিত্র প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটির জন্মদিন ১৮৪০ সালের ১১ মার্চ। তাঁর পরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল। (অতনুকুমার বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাক্সমিতির অঙ্কে তুখোড় ছিলেন কবির বড়দাদা, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ মার্চ ২০২২)।
অন্য এক গবেষকের কাছ থেকেও তাঁর বিজ্ঞান ধারণার কিছুটা আভাষ মেলেঃ রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সে অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সেই পত্রিকায় ছোটদের উপযোগী করে জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ভূ-বিদ্যা, প্রাকৃতিক ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার ভার ছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর। একুশ বছর বয়সে সদর স্ট্রিটের বাড়িতে থাকার সময় বিজ্ঞান পড়ার জন্য কবির সবিশেষ উৎসাহ জাগরিত হয়েছিল। তখন তিনি হাক্সলির রচনা থেকে জীবতত্ত্ব এবং লকইয়ার, নিউকোম্বের মতো লেখকের গ্রন্থ থেকে জ্যোতির্বিদ্যা নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করতেন। ফলস্বরূপ বিজ্ঞানের বিস্ময়কর রহস্য অনুসন্ধানের অদম্য আগ্রহ তাঁর সৃজনশীলতাকে দিয়েছে এক দুর্লভ প্রাণশক্তি, বিজ্ঞানের আবহে সম্পৃক্ত হয়েছে তাঁর রচনাসম্ভার। কবি অনুভব করেছিলেন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও গতিশীলতার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন, তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। অসীম শূন্যে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র, সূর্য-তারার সমাবেশ কালে কালান্তরে আবর্তিত হয়ে চলেছে নীরবে এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায়। তাঁর অন্তরে এই বোধ ক্রমে দৃঢ় হতে লাগল যেন কোনো অনন্ত তেজোময় পুরুষ আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে পরিচালিত করে চলেছেন। সেই অনুভূতি বিকশিত হয় কবিতায়, তিনি লেখেন, ‘দেখিলাম চাহি, শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্য প্রাঙ্গণে—নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।’ কবির কল্পনাজগতের সেই অশেষ শক্তির অধিকারী নটরাজ, বিজ্ঞানের পরিভাষায় মধ্যাকর্ষণ বল হিসেবে আখ্যায়িত হয়। সেই বলের প্রভাব গ্রহ-তারা, সৌরজগৎ এমনকি নীহারিকাগুলোকেও নিজ নিজ স্থানে আবর্তিত হতে বাধ্য করে। (নিশীথ কুমার দাশ, বিজ্ঞানচেতনার আলোকে রবীন্দ্রনাথ, দ্য ওয়াল, কলাকাতা, ৮ মে ২০২০)
Advertisement
রবীন্দ্র পরিবারের এই সবিশেষ বর্ণনায় উঠে আসে তাঁর পরিবারের বহুমাত্রিক জ্ঞান অনুসন্ধানের খুঁটিনাটি। তিনি বাল্যকাল থেকে একটা ধারণা পোষণ করে আসছিলেন, জীবজগতের সাথে জড়জগতের একটা অভিন্ন যোগসূত্র আছে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু একবার যান্ত্রিক ও বৈদুত্যিক তাড়নায় জড়পদার্থের সাড়া (The Response of Inorganic Matter to Mechanical and Electrical Stimulus) শীর্ষক বক্তৃতা দিয়েছিলেন ১৯০১ সালের মে মাসে জগদীশ রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে। ওই বক্তৃতা ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর আর ভীষণ কৌতূহলে ঠাসা। ভৌতবিজ্ঞানের অত্যন্ত মৌলিক বিষয় নিয়ে ইংরেজি ওই বক্তৃতায় উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “বিজ্ঞানশাস্ত্রে জীব ও অজীবের মধ্যে যে-সকল ভেদ-নিরূপক-সংজ্ঞা ছিল, তাহা মাকড়সার জালের মতো ঝাড়িয়া ফেলিলেন” (বঙ্গদর্শন, আষাঢ়, ১৩০৮, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৭, পৃ. ৮৭০)। জগদীশচন্দ্র বসু ওই অনুষ্ঠানে যা বলেন রবীন্দ্রনাথ হয়তো সেটাই বিশ্বাস করতেন। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সেই বক্তব্য থেকে বারবার উদ্ধৃতি দেন। সেটা এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক।
জড় ও জীবনের মাঝে ফারাক আকাশ আর পাতাল। একটা বিশ্বভূমি অন্যটা ভূমা। কিন্তু তাই বলে এর মাঝে কি কোনো যোগের সূত্র নেই? এই যোগসূত্র তখনই উপলব্ধি করা সম্ভব; যখন দুয়ের মাঝে প্রভেদটা আমরা তুলে ফেলে দেখি। একই তরঙ্গ বয়ে চলেছে উভয়ের অন্তরে। একই ইলেকট্রনের নাচন, একই ভঙ্গিমায় পদার্থরেনুগুলো অদৃষ্টের টানে ভেসে যাচ্ছে আপন ভেলায়। জগদীশ বসুর বক্তৃতার কিছু অংশ তাই তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক হবে।
“I have shown you this evening the autographic records of the history of stress and strain in both the living and non-living. How similar are the two sets of writings, so similar indeed that you can not tell them one for the other! They show you the waxing and waning pulsation of life—the climax due to stimulants, the gradual declince of fatigue, the rapid setting in of death-rigor from the toxic effect of poision. It was when I came on this mute witness of life and saw an all-pervading unity that binds together all things—the mote that thrills on ripples of light, the teeming life on earth and the radiant suns that shine on it. it was then that for the first time I understood the message proclaimed by my ancestors on the banks of the Ganges thirty century ago.—‘ They who behold the One, in allthe chnaging manifoldness of the universe, unto them belongs eternal truth, unto none else, unto none else”।
চলবে...
Advertisement
এসইউ/এমএস