অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু
Advertisement
সময়টা ১৯৯৬ সাল। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো নাটোর সদর আসনের নির্বাচিত এমপি। বিরোধীয়দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে বসি, এলাকায় যাই। নাটোরসহ উত্তরাঞ্চলে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। ১৯৯৪ সালে যমুনা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে তখনও শেষ হয়নি। এলাকার মানুষ তারুণ্য আর সততায় বিশ্বাস করে বুক ভরা প্রত্যাশা নিয়ে আমাকে দুই-দুইবার ভোট দিয়েছে।
শুধু ভাবি নাটোরের মানুষের জন্য কি করা যায়? মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়, পাঁয়চারী করি। হঠাৎ একদিন মনে পড়লো প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরীর জন্ম নাটোরের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে। এ বিষয়ে গল্পটা অনেকবারই শুনেছি। তখন প্রাণ-আরএফএল দেশের উঠতি শিল্প-গোষ্ঠী।
কাকতালীয়ভাবে কয়েকদিনের মধ্যে আমার এলাকার এক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এসে বলে আমাদের এলাকায় যদি প্রাণ গ্রুপের জেনারেল চৌধুরী সাহেব একটা ইন্ডাস্ট্রি করতেন তাহলে তো এলাকাটা উন্নত হয়ে যেতো। আমার মাথায় বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেলো, ঢাকায় আসার সময় ওই চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে এলাম।
Advertisement
আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ছাত্রনেতা থেকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে দুবার এমপি। তখনো প্রটোকল, সেন্স, ড্রেস কোড এত সব বুঝে উঠিনি। তখনকার সময়ে তরুণদের ফ্যাশন, পরনে জিন্সের প্যান্ট, পায়ে কেডস্, গায়ে টি-শার্ট।
এ অবস্থায় একদিন সকালে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন রোডে প্রাণ-আরএফএল-এর হেড অফিসে জেনারেল আমজাদ সাহেবের সাথে সাক্ষাতের জন্য পৌঁছে গেলাম। সেখানে দেখা হয়ে গেলো আমার এলাকা নলডাঙ্গার সন্তান শহীদুল ইসলাম বাচ্চুর সাথে। সদ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে যোগদান করেছেন তরুণ টগবগে অফিসার। সেই সময়ের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম বাচ্চু এখন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। তিনি আমাদের দেখা সাক্ষাতের সব ব্যবস্থা করলেন। জেনারেলের সামনে বসে আছে এক তরুণ এবং সে এমপি। তিনি কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন আপনি আমাদের নাটোরের এমপি? নাটোর সদরের এমপি? এত কম বয়সে এমপি হওয়া যায়? যেন তাঁর বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না।
এবার আমি বললাম সংবিধান অনুযায়ী ২৫ বছর বয়সের বেশি যে কেউ এমপি হতে পারে। তখন তিনি রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে কিছু আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলেন। আমি তাকে জানালাম দেশের উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আম, লিচু ও ধান হয়। কৃষির পণ্যের ভান্ডার হওয়ার পরও উত্তরাঞ্চলের মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আমি এমপি হিসেবে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি আপনি নাটোরের সন্তান হিসেবে যদি নাটোরে একটি এগ্রো বেইজড্ ইন্ডাস্ট্রি করেন, তাহলে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের কষ্ট লাঘব হবে। আমি সততা, নিষ্ঠার সাথে সহযোগিতা করবো।
মুহূর্তের মধ্যে তিনি কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। হতাশ হতে যাবো, ঠিক তখন তিনি প্রশান্তির হাসি হেসে বললেন এখন আর কথা বলবো না! আজ সন্ধ্যায় সোনারগাঁও হোটেলে আসেন, ডিনার করবো। খেতে খেতে কথা বলবো। মনে হলো তিনি হয়তো এমন একটি প্রস্তাব কোন সঠিক মানুষের নিকট থেকে পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। সন্ধ্যায় সোনারগাঁওয়ে ডিনারের টেবিলে জেনারেল তাঁর জীবনের স্মৃতি-অভিজ্ঞতার সম্ভারে পূর্ণ গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন। আমি যেন তার বহুদিনের পরিচিত একজন শ্রোতা। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার টালমাটাল বছরে তার জন্ম। সেই থেকে ’৪৭ সাল, ’৫২, ’৫৪-এর নির্বাচন, ’৫৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান, পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়ান সামরিক একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন কোনো কিছুই বাদ যায়নি।
Advertisement
মাত্র ৪২ বছর বয়সে ১৯৮১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদ থেকে অবসর নিয়ে ব্যবসায়ী হওয়ার দুর্দান্ত জীবন সংগ্রামের কাহিনি এক এক করে বলছিলেন। সাথে উপদেশ। বললেন, ব্যবসায় সফল হওয়ার পেছনে তাঁর সহধর্মিণী সাবিহা চৌধুরীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও প্রেরণার কথা। সবশেষে ওঠার আগে তিনি জানালেন নাটোরেই হবে প্রাণের সবচেয়ে বড় এগ্রোবেইজ ইন্ডাস্ট্রি।
কিছুদিন পর প্রাণের তৎকালীন জিএম স্বপন বাবু জমি কেনার জন্য নাটোরে যান। আমি কথা রাখতে পেরেছিলাম। এলাকার মানুষকে বুঝিয়ে বলেছি নাটোরে ইন্ডাস্ট্রি হলে তারা উপকৃত হবে। এলাকার জনগণ সমর্থন দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে, প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিকে নাটোরের মানুষ প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছে।
২০০১ সালের অক্টোবরে আমি তৃতীয়বারের মতো এমপি হলাম। জেলা মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলাম। গ্যাস, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার সরকারি সেবা-সহযোগিতা নির্মাণাধীন প্রাণ ইন্ডাস্ট্রির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। দ্রুত প্রাণের ইন্ডাস্ট্রির কাজ সমাপ্ত হলো। ২০০৩ সালে প্রাণের ইন্ডাস্ট্রি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গেলেন তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, বিদ্যুৎ মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন। কিন্তু আমি সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি।
কারণ সেদিন নাটোর জেলা বিএনপি’র তৃণমূল কর্মী সম্মেলন চলছিল, প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি’র তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম- মহাসচিব জনাব তারেক রহমান। আমি ছিলাম দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সভাপতি। নাটোর এগ্রোবেইজড্ ইন্ডাস্ট্রি উদ্বোধনের পর এর নাম হয় নাটোর এগ্রো লিমিটেড। সেখানে প্রায় ১২ হাজার কর্মী কাজ করে, পরিবহন, জোগানদার, কৃষক, ব্যবসায়ী সব মিলিয়ে উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা লক্ষাধিক।
সেই থেকে যোগাযোগের সূত্রটি কখনো ছিন্ন হয়নি। আলাপচারিতায় উঠে আসতো তাঁর জীবনদর্শন। সফলতার জন্য তিনি পারস্পরিক একতাকে ভীষণ গুরুত্ব দিতেন। পরনিন্দা, পরচর্চা করতে কখনো শুনিনি। তিনি কর্মক্ষেত্রের জন্য চারটি বিষয়কে অনুসরণ করতে বলতেন শৃঙ্খলা বা ডিসিপ্লিন। তাঁর কাছে ছিল সকাল ১০টা মানে ১০টা, ১০টা ১ মিনিট নয়। ট্রেনিং এবং কোচিং এটা সর্বত্র অব্যাহত রেখেছিলেন।
ডেলিগেশন এবং সুপারভিশন, কাজের দায়িত্ব বণ্টনে তিনি ছিলেন পারদর্শী। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিনি প্রতিষ্ঠানের সর্বক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করতেন। যেন পরবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সহজে কাজ করতে পারে। হয়তো এটার জন্য প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ যুগ যুগ দাপটের সাথে টিকে থাকবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে খেলাপি ব্যাংক ঋণের প্রশ্নে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কঠোর। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় একদিনের জন্যও ঋণ খেলাপি হননি। ২০১৫ সালে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল হাসপাতালে। সেখানে আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। তারপর চিকিৎসার জন্য চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। আর দেখা হয়নি।
মাত্র ৭৬ বছর বয়সে চলে গেলেন। শেষ বিদায় জানানোর জন্য সামরিক জাদুঘর মাঠে জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। তিনি চলে গেলেও তাঁর সঠিক মতাদর্শকে সামনে রেখে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ আরও এগিয়ে যাচ্ছে। ১ লাখ ১০ হাজার কর্মীর হাতে সচল প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, তাদের পরিবার-পরিজন মিলিয়ে উপকারভোগীর জনসংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ।
১৪১টি দেশে প্রাণ-আরএফএল-এর পণ্য রপ্তানি হয়। যেখানে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই, পতাকা উড়ে না সেখানে প্রাণ-আরএফএল-এর পণ্য বাংলাদেশের অস্তিত্বের জানান দেয়। আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় ছেলে আহসান খান চৌধুরী ২০১৬ সালে প্রাণ-আরএফএল-এর চেয়ারম্যান ও সিইও হন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আজার চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়ী, তৃতীয় সন্তান বড় মেয়ে সেরা হক চৌধুরী কানাডায় চিকিৎসক এবং ছোট মেয়ে উজমা চৌধুরী প্রাণ-আরএফএল-এর পরিচালক।
আমজাদ খান চৌধুরী এবং আহসান খান চৌধুরীর পথ অনুসরণ করে তৃতীয় প্রজন্ম প্রাণ-আরএফএল-এর নেতৃত্ব দিতে আসছেন। ১৯৯২ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করে যেমনি আহসান খান চৌধুরী পিতার পাশে দাঁড়িয়ে যোগ্যতার হাত প্রসারিত করেছিলেন, তেমনি তারও দুই কন্যা সামিয়া চৌধুরী ও সামিন চৌধুরী কানাডা থেকে পড়াশোনা শেষ করে ইতিমধ্যে যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে পিতার পাশে প্রাণ-আরএফএল-এর নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন।
শুধু ব্যবসা নয়, সামাজিক দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে নেই আমজাদ খান চৌধুরীর উত্তরাধিকারীরা। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নাটোরে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আমজাদ খান মেডিকেল কলেজ, জেনারেল আমজাদ খান মেমোরিয়াল হাসপাতাল, নার্সিং কলেজ ও হাইস্কুল। সমাজের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমজাদ খান চৌধুরী আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন শত শত বছর।
আমজাদ খান চৌধুরীর ধন্য জীবন, এক জীবনে শত জীবনের সফলতা। তাঁর দ্বিতীয় প্রজন্ম সফল। তৃতীয় প্রজন্মও দেশের টানে, প্রাণের টানে বিদেশের রঙিন জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে দেশের শিল্প-বাণিজ্যের হাল ধরতে শুরু করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা আমজাদ খান চৌধুরীর উত্তরাধিকারীরা তার দেখানো পথে একজন দেশপ্রেমিক শিল্পপতির স্বপ্নকে সার্থক করবেন। যিনি শিল্প-বাণিজ্যে সফলতায় কিংবদন্তিসম ইতিহাস রচনা করে গেছেন।
আমজাদ খান চৌধুরীর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক: রাজনীতিক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস