‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে পবিত্র মক্কা নগরীর আরাফাতের আকাশ-বাতাস। ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ একটি। সাম্য-মৈত্রী, ঐক্যবোধ প্রতিষ্ঠায় হজের রয়েছে সীমাহীন গুরুত্ব। ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সংস্কৃতি ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের লাখ লাখ মুসলিম প্রতি বছর এক গন্তব্য পানে উপস্থিত হয়।
Advertisement
হজ বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম মানবতার মহামিলনের এক অনন্য ব্যবস্থা, যা আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত একটি ব্যবস্থা। কাবাকেন্দ্রিক এই ব্যবস্থা সর্বপ্রাচীন। মূলত আল্লাহপাকের সাথে প্রেমময় এক গভীর সম্পর্ক সৃষ্টির নামই হজ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে ভালোবাসার উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্র কাবা এবং আরও কয়েকটি বিশেষ স্থানে আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) নির্দেশ অনুযায়ী জিয়ারত, তাওয়াফ, অবস্থান এবং নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করার নাম হজ।
হজের গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজব্রত পালন করে আর কোনো ধরনের অশালীন কথাবার্তা ও পাপ কাজে লিপ্ত না থাকে, সে যেন নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ অবস্থায় হজ থেকে ফিরে এলো’ (বুখারি ও মুসলিম)।
হজ ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মানবতার শিক্ষা দেয়। হজ শুধুই গতানুগতিক ধারার একটি ইবাদত নয়। মানবজাতিকে বর্ণ-গোত্র ও বৈষম্যের ঊর্ধ্বে ওঠার শিক্ষা দেয় হজ। হজের অন্যতম তাৎপর্য হচ্ছে, এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। আমাদের প্রিয়নবি ও বিশ্বনবি (সা.) মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বিদায় হজের ভাষণেও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আজ তারই উম্মত হয়ে আমরা মানবতাবিরোধী যত সব অপরাধ করে যাচ্ছি।
Advertisement
হিজরি নবম বর্ষে মহানবি (সা.) হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলেন। মুজদালেফা থেকে ফেরার পরে হজের রীতি অনুযায়ী তিনি মিনাতে থামেন এবং ১১ জিলহজ তারিখে তিনি (সা.) সমবেত সব মুসলমানের সামনে দাঁড়িয়ে এক ভাষণদান করেন। এই ভাষণে তিনি (সা.) বলেন : ‘হে লোক সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। কেননা আমি জানি না যে, এই বৎসরের পর আর কখনো আমি এই ময়দানে তোমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আর কোনো বক্তৃতা দিতে পারব কি না।’
‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের জীবন ও তোমাদের সম্পদ একে অপরের হামলা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত পবিত্র ও নিরাপদ করে দিয়েছেন। ‘আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক ব্যক্তির উত্তরাধিকারের অংশ নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এ ধরনের কোনো অসিয়ত বৈধ হবে না, যা কোনো বৈধ উত্তরাধিকারীর ক্ষতির কারণ হয়। ‘যার ঘরে যে সন্তান পয়দা হবে, সে তারই সন্তান হবে এবং কেউ যদি এই সন্তানের পিতৃত্বের ওপরে দাবি উত্থাপন করে, তাহলে সে শরিয়ত মোতাবেক প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে। ‘যে ব্যক্তি অন্য কাউকে নিজের পিতা বলে দাবি করবে কিংবা কাউকে নিজের মালিক বলে মিথ্যা দাবি করবে, তার ওপরে খোদার এবং ফেরেশতাদের এবং সব মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হবে।’
‘হে লোক সকল! তোমাদের হাতে এখনো কিছু যুদ্ধবন্দি রয়ে গেছে। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, তোমরা তাদের তা-ই খাওয়াবে যা তোমরা নিজেরা খাও এবং তাদের তা-ই পরতে দেবে, যা তোমরা নিজেরা পরো। যদি তারা এমন কোনো অপরাধ করে ফেলে, যা তোমরা ক্ষমা করতে পারো না, তাহলে তাদের অন্যের কাছে দিয়ে দেবে। কেননা, তারা খোদারই বান্দা। তাই কোনো অবস্থাতেই তাদের কোনোরূপ কষ্ট দেওয়া বৈধ হবে না।
‘হে লোক সকল! আমি তোমাদের যা বলছি, তা শোনো এবং ভালোভাবে মনে রেখো। প্রত্যেক মুসলমান প্রত্যেক মুসলমানের ভাই। তোমরা সবাই সমান। সব মানুষ, তা তারা যে কোনো জাতিরই হোক আর যে ধর্মেরই হোক, মানুষ হওয়ার কারণে, পরস্পর সমান। (এই কথা বলার সময় তিনি (সা.) তার উভয় হাত ওপরে তুললেন এবং এক হাতের আঙুলগুলোকে অপর হাতের আঙুলগুলোর সঙ্গে মিলালেন এবং বললেন) যেভাবে দুই হাতের আঙুলগুলো পরস্পর সমান, সেভাবেই সব মানুষ পরস্পর সমান।’
Advertisement
‘তোমাদের কোনো অধিকার নেই যে, তোমরা একে অন্যের ওপরে কোনো শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করো। তোমরা পরস্পর ভাই।’ ‘তোমরা কি জান, এখন কোন মাস? এই এলাকা কোন এলাকা? তোমাদের কি জানা আছে, আজকের দিন কোন্ দিন?’
লোকেরা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, এই মাস পবিত্র মাস। এই এলাকা পবিত্র এলাকা। আজকের দিন হজের দিন।’ তাদের সবারই উত্তর শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতে থাকলেন, ‘যেভাবে এই মাস পবিত্র মাস, যেভাবে এই এলাকা পবিত্র এলাকা, যেভাবে এই দিন পবিত্র দিন, তেমনিভাবে আল্লাহতাআলা প্রতিটি মানুষের জান, মাল ও সম্মান পবিত্র করে দিয়েছেন। এবং কারও জানের ওপরে কিংবা মাল ও সম্মানের ওপরে হামলা করা ঠিক তেমনি অবৈধ যেমন অবৈধ এই মাসের এই এলাকায় এই দিনের অমর্যাদা করা। এই হুকুম শুধু আজকের জন্যই নয়, শুধু কালকের জন্যই নয়, বরং সেই দিন পর্যন্ত প্রত্যেক দিনের জন্য যেদিন তোমরা খোদার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হবে।’
তিনি (সা.) আরও বললেন, ‘এসব কথা যা আমি আজ তোমাদের বলছি তা তোমরা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দিও। কেননা এমনও হতে পারে যে, যারা আজ আমার কথা আমার কাছ থেকে শুনছে, তাদের চাইতে যারা আমার কাছ থেকে আমার এই কথা শুনছে না, তারা এসব কথার ওপরে বেশি আমল করবে, বেশি বেশি পালন করবে।’এই সংক্ষিপ্ত ভাষণ বলে দিচ্ছে যে, মানুষের মঙ্গল এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য রাসুল করিম (সা.) কত বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং নারীজাতি ও দুর্বলের অধিকার রক্ষার প্রতি কত বেশি আন্তরিক ছিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) জানতেন যে, তার ইহজীবনের দিন শেষ হয়ে আসছে। হয়তো বা আল্লাহতাআলা তাকে জানিয়েছিলেন যে, তার জীবনের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাই, তিনি চাননি যে, যে নারীদের মানব জন্মের আদি থেকেই পুরুষদের দাসি বানিয়ে রাখা হয়েছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আদেশ-নির্দেশ দেওয়ার আগেই তিনি জগৎ ছেড়ে চলে যান।
তিনি চেয়েছিলেন, ওইসব যুদ্ধবন্দি যাদের মানুষরা ক্রীতদাস বলে আখ্যায়িত করে এবং যাদের ওপরে নানা প্রকার অত্যাচার চালাতে থাকে, তাদের অধিকার সুরক্ষিত করার পরই তিনি যেন দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। তিনি চাননি যে, মানুষে মানুষে যে প্রকাশ্য পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে, কাউকে পাতালে নিক্ষেপ করা হয়েছে, তা ঘুচিয়ে দেওয়ার আগে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি চাননি যেসব কারণে, জাতিতে, জাতিতে দেশে দেশে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং যুদ্ধবিগ্রহের সৃষ্টি হয়, তা সব সাকল্যে দূরীভূত করার আগে তিনি এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।
একে অপরের হক আত্মসাৎ করা বা অধিকার খর্ব করা সব সময়ই বর্বর যুগের এক অভিশাপ বলে গণ্য করা হয়, তার অশুভ বাসনাকে যতক্ষণ না হত্যা করা হয়, ততক্ষণ তিনি পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাননি। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের জান ও মালকে সেই পবিত্রতা, সেই নিরাপত্তা দান না করা হয়, যা খোদাতাআলার পবিত্র মাসগুলোকে খোদাতাআলার পবিত্র ও কল্যাণমণ্ডিত স্থানগুলোকে দান করা হয়েছে, ততক্ষণ তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাননি। সব জাতির জন্য নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপনকরণ, মানবজাতির মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠাকরণ ইত্যাদির জন্য এত বেশি গভীর উদ্বেগ ও আন্তরিকতা পৃথিবীর আর কোনো মানুষের মাঝে কেউ কি কখনো দেখেছে?
হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানবজাতির জন্য এত ভালোবাসা, এত আকুলতা, এত উদারতা আর কোনো মানুষের মধ্যে কি কখনো দেখা গেছে? স্বাধীনতা ও সাম্যের শিক্ষা ও আদর্শ কেবল ইসলাম, হ্যাঁ, কেবল ইসলামই কায়েম করেছে পৃথিবীতে। আর ইসলাম তা এমনভাবে কায়েম করেছে যে, আজ পর্যন্ত দুনিয়ার আর কোনো জাতি তা করতে পারেনি।
আজ যদি মহানবির (সা.) এই ভাষণের ওপর বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আমল করে তাহলে হয়তো আর কখনোই কোনো দেশে নিষ্পাপ শিশুর লাশ সমুদ্রে পড়ে থাকতে হয়তো দেখা যাবে না। মুসলিম উম্মাহকে ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার আর বিশ্বনবির (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস