‘শপথ ডুমুর, জয়তুন ও সিনাই প্রান্তরস্থ তুর পর্বতের এবং এই নিরাপদ নগরীর’। এভাবেই মহান আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা আত-ত্বীনে তুর পর্বতের শপথ করেছেন। এই পর্বতটি মিশরের পবিত্র ভূমি সিনাই উপদ্বীপের সেন্ট ক্যাথেরিন শহরে অবস্থিত।
Advertisement
বেদুইনদের কাছে এটি জাবালে মুসা (মুসার পর্বত) হিসেবেও পরিচিত। সিনাই পর্বতটির উচ্চতা ২২৮৫ মিটার। পর্বতের উপরে উঠার জন্য দুটি রাস্তা রয়েছে। পায়ে অথবা বেদুইনদের উটের সাহায্যে উপরে উঠা যায়। পায়ে হেঁটে উপরে উঠতে প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগে।
আমরা ফজরের নামাজ আদায় করেই পাহাড়টিতে উঠতে শুরু করলাম। নারী-পুরুষসহ আমাদের গ্রুপে পঁচিশ জন ছিল, তার মধ্যে তিনজন নারীসহ মাত্র কয়েকজন পাহাড়টির চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছিলাম।
পাহারের চূড়ায় রয়েছে একটি গুহা, যেখানে বসে হযরত মুসা (আঃ) মহান আল্লাহ্ পাকের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। আরও রয়েছে দুটি ইবাদত খানা। একটি মুসলমানদের অন্যটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইবাদত করার জন্য। আমরা মুসলমানদের ঘরটিতে ঢুকে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহ্ পাকের কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।
Advertisement
হয়রত মুসা (আঃ) তুর পাহাড়ের উপর অবস্থানকালে নবুয়াত লাভ করেন। এই তুর পাহাড়েই হযরত মুসাকে (আঃ) বাইবেলে বর্ণিত দশটি বিধান দেওয়া হয়। সেই কারণে এই পাহাড়কে মুসার পাহাড় বলা হয়। আল্লাহ বললেন, ‘হে মুসা, আমি আমার রিসালাত ও বাক্যালাপ দ্বারা মানুষের ওপর তোমাকে বিশিষ্টতা দান করেছি। সুতরাং আমি তোমাকে যা কিছু দিলাম, তা গ্রহণ করো এবং কৃতজ্ঞ থাকো।
মুসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে এসে উপস্থিত হলো এবং তার প্রতিপালক তার সঙ্গে কথা বললেন, তখন মুসা বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে দেখা দাও, যেন আমি তোমাকে দেখতে পাই।’
আল্লাহ বললেন, ‘(হে মুসা) তুমি আমাকে কখনোই দেখতে পাবে না। তুমি বরং পাহাড়ের দিকে তাকাও। (আমার তাজাল্লি নিক্ষেপের পর) তা যদি স্থির থাকে, তবে তুমি আমাকে দেখতে পারবে।’
অতঃপর যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে নিজ জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন, তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলল এবং মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলো। পরে যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো, তখন সে বলল, ‘মহিমাময় তুমি (পবিত্র তোমার সত্তা), আমি তওবা করছি এবং মুমিনদের মধ্যে আমিই প্রথম।’
Advertisement
সিনাই পর্বতের কথা পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায় মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّورَ خُذُواْ مَا آتَيْنَاكُم بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُواْ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘আর আমি যখন তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তুর পর্বতকে তোমাদের মাথার ওপর তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদিগকে যে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাকে ধরো সুদৃঢ়ভাবে এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা মনে রেখো যাতে তোমরা ভয় কর, (সুরা আল-বাকারাহঃ ৬৩)।
তুর পাহাড়ের কাছাকাছি আরও কয়েকটি পাহাড় আছে, একটি পাহাড়ের নাম ‘সেন্ট ক্যাথেরিন’। এই পাহাড়টি দক্ষিণ সিনাই রাজ্যে অবস্থিত এবং মিশরের সবচেয়ে উচু পাহাড়। এই পাহাড়টি তুর পাহাড়ের সঙ্গে একেবারে লাগানো। খ্রিস্টানরা এটাকে তাদের মহা পবিত্র স্থান মনে করে।
তাই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পাহাড় জিয়ারত করতে ছুটে আসে। পাহাড়টি মূলত খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের আবাসস্থল ছিল। বড় বড় ধর্মযাজকরা এখানে এসে বসবাস করত। যার ফলে খ্রিস্টানদের কাছে এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ মিটার। সোনালি রংয়ের এই পাহাড়টি দেখতে অনেক সুন্দর। তূর পাহাড়ের পাদদেশেই রয়েছে নবী হয়রত হারুন (আ.) এবং হযরত শোয়াইব (আ.) কবর।
তুর পাহাড়ের পবিত্র জ্বলন্ত ঝোপ গাছ (বার্নিং বুশ)!
সিনাই পর্বতের পাদদেশে রয়েছে এক পবিত্র গাছ, যার নাম জ্বলন্ত ঝোঁপ বা বার্নিং বুশ। সিনাই পর্বতের সমতল ভূমি থেকে কিছুটা উপরে, একটি গির্জার সামনে পাথর দিয়ে গোলাকারে বাঁধানো এই গাছটি তিন ধর্মের (ইহুদি, খৃষ্টান ও মুসলমান) মানুষের কাছেই পবিত্র। হাজার হাজার বছরের পুরোনো এই গাছটি দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের লতা জাতীয় গাছের মতো।
এই গাছটির কথা পবিত্র কোরআনে শরিফে ও উল্লেখ রয়েছে। গাছের দেওয়ালে লেখা রয়েছে পাতা ছেঁড়া নিষেধ, কিন্তু কে শোনে কার কথা? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আশা পর্যটকরা হাতের নাগালে পাওয়া সব পাতাই তুলে নিচ্ছেন। অনেকে তাদের মনোবাসনা কাগজে লিখে ছুড়ে ফেলছেন গাছের গোড়ায়।
হযরত মূসা (আ.) যখন মাদায়েন থেকে মিশরে স্বস্ত্রীক ফিরছিলেন, তখন এই গাছের মধ্যে আগুন দেখতে পেলেন। অত:পর তিনি সেই গাছের কাছে গেলেন, এমন সময় আল্লাহ বললেন: ‘হে মুসা! নিশ্চয় আমি তোমার পালনকর্তা, অতএব তুমি জুতা খুলে ফেল, তুমি পবিত্র উপত্যকা “তূআ’য় রয়েছ, এবং আমি তোমাকে নির্বাচন করেছি, অত এব যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা শুনতে থাক’ [সুরা ত্বা-হা: ১১-১৩]
তুর পাহার ও সুরমা!
অনেকেই মনে করেন, হযরত মুসা (আঃ) যখন তুর পাহাড়ে আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তখন আল্লাহর তাজাল্লীতে পাহাড় ভস্ম হয়ে গিয়েছিল। সেই ভস্মিভূত পাহাড় থেকেই সুরমার উৎপত্তি ও ব্যবহার। আসলে কি তাই? সুরমা কি তুর পাহাড় এর তাজাল্লী থেকে সৃষ্টি? এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
সুরমা একটি খনিজ দ্রব্য। এর সাথে তুর পাহাড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। মুসা আঃ-এর আল্লাহকে দেখার ইচ্ছা ও তুর পাহাড়ের মূল ঘটনাটি সত্য। পবিত্র কুরআন শরিফের পূর্ণ বিবরণ রয়েছে। (সূরা আ‘রাফ) কিন্তু কোথাও এই ঘটনার সঙ্গে সুরমাকে জড়িয়ে দেওয়ার কথাটির সামান্যতমও উল্লেখ নেই।
এই তূর পাহাড়েই হযরত মুসা (আঃ) কে বাইবেলে বর্ণিত দশটি বিধান দেওয়া হয়।
এমআরএম/জেআইএম