জাতীয়

বিএম ডিপো: অক্ষত কনটেইনার নিয়ে যাচ্ছেন আমদানি-রপ্তানিকারকরা

# ডিপো সংস্কারের কাজ শুরু# ১২ কনটেইনার রপ্তানি পণ্য ফেরত# বেতন-বোনাস পরিশোধ হতাহত কর্মীদের

Advertisement

এক মাস হলো সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর বিস্ফোরণের ঘটনা। এ বিস্ফোরণ কেড়ে নিয়েছে ৪৯টি প্রাণ। আর ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার। এসব ক্ষতির ভয়াবহতা এখনো মুছেনি। তারপরও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বিএম ডিপো।

কাস্টমস, ডিপো কর্তৃপক্ষ ও আমদানি-রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে ডিপোটিতে। এরই মধ্যে ডিপোতে থাকা অক্ষত আমদানি-রপ্তানির পণ্য ভরা কনটেইনার নিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সবশেষ ৩ জুন ১২ কনটেইনার রপ্তানি পণ্য ফেরত নেওয়া হয়।

এদিকে ডিপো সংস্কারের কাজ শুরু করেছে মালিকানা প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপ। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জুন মাসের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করা হয়েছে। পরিশোধ করা হয়েছে ঈদুল আজহার বোনাসও। হতাহতদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বেতন-বোনাসের অর্থ।

Advertisement

বিএম কনটেইনার ডিপোর জেনারেল ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অব.) মাইনুল আহসান খান সোমবার সকালে জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ডিপো সাময়িক রি-ওপেন করেছি। যেসব প্রতিষ্ঠান কাস্টমসের অনুমোদন নিয়ে আসছে তাদের অক্ষত পণ্যগুলো দিয়ে দিচ্ছি। ৩ জুন ডেলিভারি হয়েছে ১২টি এক্সপোর্ট কনটেইনার। তারা শাট আউট করে নিয়ে যাচ্ছে পণ্য। অন্য ডিপোর মাধ্যমে এগুলো শিপমেন্ট করবে। আজকেও রপ্তানি ছাড়া আমদানির কিছু কন্টেইনার ডেলিভারি হবে। কাস্টমস থেকে ৫০টির মতো কনটেইনার ছাড়ের অনুমতি পেয়েছি।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বিএম কনটেইনার ডিপোতে রপ্তানি পোশাক ছাড়াও ছিল প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডসহ আরও নানা পণ্য।

ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পণ্যও। ৪ জুন রাতে আগুনের আগে বিভিন্ন দেশে রপ্তানির জন্য ৩৫ লাখ ১১ হাজার ৭৩৪ ডলার মূল্যের দুই লাখ ১৯ হাজার ২০৪ কার্টন পণ্য বিএম ডিপোতে পাঠিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণের আগে পোশাক রপ্তানিকারী ১৪১ প্রতিষ্ঠানের পণ্য ছিল বিএম কনটেইনার ডিপোতে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা পাঠিয়েছে বিজিএমইএকে।

Advertisement

সব মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের ৪৭ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৩৬ কোটি টাকার বেশি) মূল্যের পণ্য ছিল বলে জানা গেছে। এসব পোশাক যাওয়ার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কে।

এর মধ্যে বেশির ভাগ পণ্যের ক্রেতা সুইডেনভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ব্রান্ড এইচএন্ডএম। এছাড়া টার্গেট, ওয়ালমাট, টপ গ্রেড, গ্যাস্টন, ওলওর্থস, ফিলিপস ভ্যান হিউসেন, পিভিএইচ, এমবিএইচ, চ্যাপ্টার ওয়ান স্পোর্টস ওয়্যার, সিএন্ডএ বায়িং, নিউ ফ্রন্টেয়ার, রচি ট্রেডার্স ইনকরপো. ও বিএএসএসের কেনা পণ্যও পুড়েছে আগুনে।

বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) তথ্যমতে, দুর্ঘটনার দিন ডিপোতে চার হাজার ৩১৮টি কনটেইনার ছিল। এরমধ্যে খালি ছিল দুই হাজার ৮৯৭টি কনটেইনার। এক হাজার ২১টি কনটেইনারে আমদানি-রপ্তানির পণ্য ছিল। এরমধ্যে কমবেশি ৯০০ কনটেইনারে আমদানি-রপ্তানির প্রায় সাড়ে ১৫শ’ টিইইউ’র পণ্য অক্ষত রয়েছে।

৪ জুন রাত ৯টায় অগ্নিকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকে ডিপোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন ৫ জুন চিঠি দিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ও পণ্য সংরক্ষণে বিল অব এন্ট্রি বা বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল না করার জন্য নির্দেশ দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

পরবর্তীতে ডিপো কর্তৃপক্ষ, বিকডা, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আবেদনে ডিপোতে থাকা অক্ষত পণ্য ছাড়করণে পদক্ষেপ নেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস।

এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমদানি-রপ্তানিকারকদের পণ্যভর্তি কনটেইনারগুলো খালাসের জন্য কাস্টমসের কাছে আবেদন করেছিলাম। কিছু কিছু কনটেইনার ছাড়ের অনুমতি দিয়েছে কাস্টমস। রপ্তানিকারকরা তাদের কারখানায় এসব পণ্য নিয়ে চেক করবে এগুলো রপ্তানিযোগ্য আছে কিনা। তারপর তারা শিপমেন্ট করবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএম ডিপোর দায়িত্বে থাকা কাস্টমসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা বলেন, ডিপোতে আমরা কাজ শুরু করেছি। আমি নিজেও আছি ডিপোতে। কর্তৃপক্ষ আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। যেসব কনটেইনার অক্ষত আছে সেগুলো নিয়ে মূলত কাজ হচ্ছে। যে কনটেইনারের পণ্য ভালো এবং দুর্ঘটনার আগে কাস্টমসের কার্যক্রম শেষ হয়েছিল সেগুলো ডিপো থেকেই সরাসরি জাহাজীকরণের সুযোগ রয়েছে। তবে যে কনটেইনারে কাস্টমসের কার্যক্রম হয়নি সেগুলো রপ্তানিকারকরা ফেরত নিয়ে অন্য ডিপোর মাধ্যমে জাহাজীকরণ করবে। আবার প্রয়োজনে কনটেইনারের পণ্য রি-চেক করার কারখানায় নিয়ে পরবর্তীতে শিপমেন্টের জন্য পাঠাবে।

এ কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, যেসব কনটেইনারের পণ্য পুড়েছে, সেগুলো ফায়ার সার্ভিসের রিপোর্টসহ সার্ভে করার পর ছাড়করণের জন্য আবেদন করতে বলেছি। আমরা ৩০ জুন সাতটি কনসাইনমেন্টের অনুমতি দিয়েছি। ৪ জুলাই পর্যন্ত ১৬টি কনসাইনমেন্টের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেখানে রয়েছে আমদানি-রপ্তানি পণ্য।

এদিকে আগুন ও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ডিপো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি সহায়তার প্রতিশ্রুত অর্থও দেওয়া শুরু হয়েছে।

২০ জুন প্রথম ধাপে হতাহত ৬৯ জনের পরিবারকে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ টাকা দিয়েছে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এসব অর্থ প্রদান করা হয়।

এর মধ্যে ছিল ফায়ার সার্ভিসের ৩০ সদস্যের পরিবার। যার মধ্যে নিহত এবং নিখোঁজ ১৩ জনের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে, আর আহত নয়জনকে ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। এছাড়া সাধারণ আহত পাঁচজনকে দেওয়া হয় ছয় লাখ টাকা করে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়া তিনজনকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে ডিপোর নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নিহত নয়জনের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। আর অঙ্গ হারানো তিনজনের পরিবারকে দেওয়া হয় ছয় লাখ টাকা করে। সাধারণ আহত ১৯ জনকে চার লাখ টাকা করে দেওয়া হয়।

এছাড়া ডিপোর বাইরে থেকে আসা লোকজনের মধ্যে নিহত চারজনের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে, আর আহত চারজনকে দেওয়া হয় চার লাখ টাকা করে।

ইকবাল হোসেন/জেডএইচ/জেআইএম