প্রভাত নাকি দিবসের পূর্বাভাষ দেয়? এই প্রবাদের সত্যতা বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা প্রমাণ করতে পারবে কি-না এর জন্য কয়েকটা দিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। তবে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকাকে একরকম ঘোষণা দিয়েই হারালো মেহেদি হাসান মিরাজ ও তার সহযোদ্ধারা। একতরফা ম্যাচে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় ৪৩ রানের ব্যবধানে। এটা আকস্মিক পাওয়া কোনো জয় নয়। ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবেই এই জয়। অনূর্ধ্ব-১৯ এর সর্বশেষ দ্বৈরথের দিকে তাকালেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চলতি বিশ্বকাপে উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হওয়ার আগে সর্বশেষ হোম এন্ড অ্যাওয়ে দুটো সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার ৩ জয়ের বিপরীতে বাংলাদেশের তরুণরা জিতেছে ১১টি ম্যাচে। অর্থাৎ এবারের বিশ্বকাপের ম্যাচটি প্রোটিয়াদের বিপক্ষে জুনিয়র টাইগারদের ১২তম জয়।এবারের আসরের আগে ইতিহাস-ঐতিহ্য-পরিসংখ্যান কোনো কিছুই পক্ষে নয় বাংলাদেশের। আইসিসির (সব ফর্ম্যাটের বিশ্বকাপ) আসরে কোয়ার্টার ফাইনালের চৌকাঠ মাড়ানো যেন বাংলাদেশে ক্রিকেটের জন্য ঔদ্ধত্যের সামিল। বড়দের বিশ্বকাপে একবার শেষ আটে আর গত আসরে প্রথমবারের মত কোয়ার্টার ফাইনাল ওঠা বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সুখস্মৃতি বলতে এটুকুই। ছোটদের বিশ্বকাপে (অনূর্ধ্ব-১৯) বাংলাদেশের অবস্থা তথৈবচ। নয়বারের অংশগ্রহণে কোয়ার্টার ফাইনালে দুবার। একটিবারের জন্যও সেমিফাইনালের নাগাল পায়নি জুনিয়র টাইগাররা। এর মধ্যে ২০০৪ সালে ঘরের মাঠে নবম স্থান নিয়ে সন্তোষ্ট থাকতে হয় স্বাগতিক বাংলাদেশকে।এই যখন অতীত, তখন বড় কিছুর স্বপ্ন দেখাটাও দুঃসাহস বৈ-কি। তবে বাস্তবতা ভুলে যাচ্ছে না ক্ষুদে টাইগাররা। লক্ষ্যপূরণে সংকল্পবদ্ধ হলেও প্রকাশে যথেষ্টই রক্ষাণাত্মক বাংলাদেশ শিবির। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজের ভাষ্য- ‘অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আমাদের অতীত পারফরম্যান্স মোটেও ভাল নয়। তবে যেহেতু ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ হচ্ছে, তাই দেশের মানুষ মনে রাখতে পারে, আমাদের এমন একটা কিছু করে দেখাতে হবে।’ চোখে সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বপ্ন কিন্তু প্রকাশে সতর্কতা। অতীতের কোনো সুখস্মৃতি নাই এটাই যে এই সতর্কতার কারণ তা বলাই বাহুল্য। লক্ষপূরণে এই দলটি কতটা সংকল্পবদ্ধ সেটা অনুধাবনের জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট।মঙ্গলবার অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচের আগের দিন স্বাগতিক অধিনায়ক মিরাজ বললেন- ‘এবারের আসরে আমি সেরা অলরাউন্ডার হতে চাই।’ ব্যাট হাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি মিরাজ। আউট হয়েছেন মাত্র ২৩ রানে। তবে বোলিং-ফিল্ডিং আর নেতৃত্ব দিয়ে ব্যাটিংয়ের ঘাটতি খুব ভালমতই পুষিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। প্রথা ভেঙ্গে নতুন বলে পেসারকে না এনে আক্রমণ শানিয়েছেন নিজেই। প্রথম শিকারও মিরাজেরই। প্রথম স্পেলে ৩ ওভারে ২ মেডেনসহ দিয়েছেন মোটে ২ রান। শুরুর এই ধাক্কা পুরো ম্যাচে আর কাটিয়ে উঠত পারেনি ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা। শেষ পর্যন্ত ১০ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে শিকার করেছেন ৩ উইকেট। ফিল্ডিং আর ক্যাপ্টেন্সিতে দেখিয়েছেন আরও মুন্সিয়ানা। ম্যাচের একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের জয়ের মাঝখানে দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন প্রোটিয়া ওপেনার লায়াম স্মিথ। সেঞ্চুরী পূর্ণ করে ম্যাচ জমিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন এই ওপেনার। ৪৫তম ওভারের চতুর্থ বলে ইতি ঘটে স্মিথের অসাধারণ ইনিংসটির। এসময় সালেহ আহমেদ শাওনের বলে বিগ হিট নিতে চেয়েছিলেন স্মিথ। তার জোরাল শট এক্সট্রা কভার অঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকা মিরাজ তালুবন্দী করেন চিতার ক্ষিপ্রতায়। এমন একটি ক্যাচ মুঠোবন্দী করার জন্য গর্ব অনুভব করতে পারেন বিশ্বের যে কোনো ফিল্ডার। ওই এক ক্যাচেই ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেল চ্যাম্পিয়নদের। জুনিয়র টাইগারদের জয়টা পরিণত হল সময়ের ব্যাপারে। আর অলরাউন্ড ভূমিকা কি সেটা প্রথম ম্যাচেই প্রমাণ করে দিলেন মিরাজ।বুধবারের ম্যাচে একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান প্রোটিয়া ওপেনার স্মিথ। ম্যাচ জিতলেও বাংলাদেশ ইনিংসে সেঞ্চুরির নাগাল পাননি কেউই। ৭৩ রান করে দলের জয়ে ভূমিকা রাখায় ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশ দলের সহঅধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। নিজের সেঞ্চুরি পাওয়ার চেয়ে দলের জয়কেই বড় করে দেখছেন শান্ত। ম্যাচ শেষে বলেন- ‘আমার সত্তরে দল জিতেছে এতই আমি খুশি। সেঞ্চুরী করতে পারিনি এটা আমার কাছে তেমন কিছু নয়। আমি সেঞ্চুরি করার পর যদি দল হারে তাতে তো কিছু লাভ নাই। আমি সবসময়্ দলের জয়ে ভূমিকা রাখতে চাই।’ ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে দলের জয়কে বড় করে দেখার মানসিকতা, এরচেয়ে ভাল কিছু আর হতে পারে না। এ্ই দল হয়ে ওঠার আকাঙ্খাটাই তরুণদের সবচেয়ে বড় শক্তি।স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে জুনিয়র টাইগাররা। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে জিম্বাবুয়ে , ইংল্যান্ডকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ারই সুযোগ দেয়নি মিরাজ বাহিনি। এর আগে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ওয়েস্টইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশের তরুণরা। চলতি আসরে উদ্বোধনী ম্যাচেই গতবারের চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শেষ আটের রাস্তাটা অনেকটাই পরিষ্কার করে ফেলেছে মিরাজ বাহিনি। বাংলাদেশের গ্রুপে বাকি দুদল স্কটল্যান্ড ও নামিবিয়া। শক্তি ও অভিজ্ঞতার বিচারে দুটো ম্যাচই খুব ভালভাবে জেতার কথা বাংলাদেশের। তবে নক আউট পর্বে আরও কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে মিরাজদের। এখানকার কন্ডিশনে দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও বিপজ্জনক উপমহাদেশের দলগুলো। অস্ট্রেলিয়া না থাকাায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশিবার (তিন বার) চ্যাম্পিয়ন হওয়া দল হিসাবে খেলছে ভারত। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের একমাত্র আসরটিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায় পাকিস্তান। এছাড়াও আছে ২০০০ সালে রানার্সআপ শ্রীলঙ্কা। তবে নতুন কিছু করার স্বপ্নে স্বাগতিক শিবির যে প্রস্তুত সেই ঝলকানি দেখা গেছে প্রথম ম্যাচেই।কবির কথায়,যাত্রা তব শুরু হোক হে নবীনকরো হানি দ্বারেনবযুগ ডাকিছে তোমারে।কবির কল্পনাকে বাস্তবে রুপ দেয়ার স্বপ্নরথে এখন বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা। সর্বোচ্চ সাফল্য বাংলাদেশকে মানায় না- এটাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল অনেকে। কিন্তু বদ্ধ দুয়ারকে নিয়তি মানতে নারাজ বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা। নবযুগ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে মেহেদি হাসান মিরাজ ও তার সহযোদ্ধাদের।এইচআর/আরআইপি
Advertisement