জাতীয়

বয়স ৭২ বছর, আর কতো!

শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) আবার মুখরিত হয়ে উঠেছে। আবার জমে উঠেছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানের চা স্টলগুলো। গান-গল্প-আড্ডা আর তার ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস, সব মিলিয়ে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ।দেশের অন্যতম বৃহত্তম ও উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর, কাজলাসহ নগরীর প্রায় অধিকাংশ মানুষেরই বেঁচে থাকার মানদণ্ড হলো রাবির সার্বিক পরিস্থিতি। ক্যাম্পাস খুললেই যাদের মুখে ফোটে হাসি, আবার বন্ধ হলেই হাসিমুখটা হয়ে যায় মলিন। ব্যবসায়ীদের বড়ো একটা অংশের লভ্যাংশ নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের ওপর।শুধু ব্যবসায়ী নয় ক্যাম্পাসে প্রায়ই চোখে পড়ে নানা ধরনের পড়ে থাকা প্রতিভার সন্ধান। যারা ভিক্ষা নয় বরং সামন্যতম প্রতিভাকেই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ভিক্ষার হাত পাতেননি কারো কাছে। কেউ গান শোনান, কেউ সাপের খেলা, আবার কেউবা জাদুখেলা, আল্পনা আঁকিয়ে মন জোগান শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীরাও খুশি হয়ে তাদের বকশিস দেন। এই বকশিসেই চলেই তাদের সংসার।এমনই একজন লোকমান হাকিম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঘুরে বেড়ান নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। কখনো রুমালে ছবি এঁকে, কখনো খাতা বা অন্য কোনো কাগজে আল্পনা এঁকে বকশিস নিয়ে চলে তার সংসার। বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নন্দাপুর গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলেকে চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন তিনি।এদিকে নিজের এক বড়ো অসুখের পর এখন অবশ ডান পা আর বাম হাত নিয়েই ঘুরে চলেছেন জীবিকার নেশায়। বিভিন্ন স্থানে আল্পনা-নকশা আর হালকা কবিরাজি করেই দিন কাটে তার।ছেলের কী হয়েছে জানতে চাইলে লোকমান হাকিম চোখের জল ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে শুধু অঝরে চোখের জল ঝরালেন। কিছুক্ষণ পরে চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমি আর কতো বোঝা বয়ে বেড়াবো। বয়স এখন আমার ৭২ বছর, আর কতো?’প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে ১০০ থেকে১৫০ টাকা করে উপার্জন হয় তার। ৬ জনের সংসার চালাতে আর পেরে উঠছেন না তিনি। ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না শরীরের অক্ষমতা ও বয়সের ভারে। সামান্য জ্ঞানের কবিরাজি আর এইসব আল্পনার উপার্জনেই চলে তার সংসার।এতো সংগ্রামের পর মাথা নোয়াননি তিনি সমাজের কাছে। হাত পাতেননি ভিক্ষার। লোকমান হাকিমের ভাষায়, ‘আমি এতো অভাবের মধ্যে কারো কাছে ভিক্ষার জন হাত পাতিনি। আমি আল্পনা আঁকি, ওরা আমাকে বকশিস দেয়।’কী কী ধরনের কাজ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার তো কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তাই বড়ো কোনো কাজে কেউ আমাকে নেয় না। তবে আমার মহল্লার বাড়িঘর ও বাসর ঘরের বা পোশাকের নানা ধরনের নকশা আমাকে দিয়ে করিয়ে নেয়। এতে তারা খুশি হয়ে আমাকে যা বকশিস দেয়, তা-ই নিই। এই দিয়েই কোনো মতে চলে আমার সংসার।’বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সামনে মিডিয়া চত্বরে দেখা মেলে লোকমান হাকিমের। মাত্র এক হাত দিয়ে নানা রঙ-পেন্সিল দিয়েই এঁকে চলেছেন নানা আল্পনা। আঁকা শেষেই কথা হয় লোকমান হাকিমের সঙ্গে। অতি দুঃখের সাথেই এইসব শোনাচ্ছিলেন তিনি।বয়সের এই ভারের মধ্যেও আর কতোদিন পরিবারের ভার বয়ে বেড়াতে পারবেন এ নিয়ে শঙ্কিত তিনি। তারপর একুট আশার কথা জানালেন তিনি। বললেন, ‘আমাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যদি কোনো সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করে দিতেন, তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও এ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতাম।’রাশেদ রিন্টু/বিএ

Advertisement