মতামত

হিন্দু শিক্ষকের গলায় জুতা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, ষড়যন্ত্রের অংশ

নড়াইলের একটি কলেজের নিরপরাধ হিন্দু শিক্ষককে পুলিশের উপস্থিতিতেই গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে। কিন্তু এতোদিন এটি প্রকাশ পায়নি। অবশেষে জনদ্রোহের কারণে এটি আর গোপন রাখা যায়নি, খবরটি এখন শিরোনামে স্থান পেয়েছে।

Advertisement

সংক্ষেপে ঘটনাটি হলো এই যে, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক হিন্দু ছাত্র তার ফেসবুকে ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিক নূপুর শর্মার সমর্থনে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর কিছু ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়ালে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস পুলিশের সাহায্য চেয়ে ফোন করেন। এরপর কিছু ধর্মান্ধ লোক, যাদের বেশির ভাগই বহিরাগত, শুধু সেই ছাত্রকেই নয়, শিক্ষক স্বপন বাবুকেও জুতার মালা পরিয়ে কিছু এলাকা প্রদক্ষিণ করে।

ভিডিওতে ধারণ করা ছবিতে দেখা যায়, সে সময় ওই শিক্ষকের পাশেই বহু পুলিশ সদস্য ছিলেন। খবরটি তাৎক্ষণিকভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ না পেলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অপ্রতিরোধ্য সৈনিক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ভাই সেদিনই আমাকে এটি পাঠিয়েছিলেন। এর বেশ কদিন পরে অধ্যাপক মামুন ‘জাগো নিউজে’ যে প্রশংসনীয় সাহস প্রদর্শন করে, শঙ্কাপূর্ণ এবং স্পষ্ট কথাগুলো লিখেছেন, সে ধরনের লেখা গত বহু বছর কেউ লিখে উঠতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই।

তার বীরত্বপূর্ণ লেখা অসাম্প্রদায়িক চেতনার লোকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছে। এই লেখার কারণেই সম্ভবত কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে এবং কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে সবার ধারণা। শেষ খবর অনুযায়ী অবশেষে পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেছে, কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। মামুন ভাইয়ের লেখা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই আজ লিখতে বসলাম।

Advertisement

ঘটনাটি বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমটি হলো ধর্মান্ধ অপশক্তি, কি এতোই ক্ষমতাবান হয়ে গেলো যে এরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্যে এ ধরনের অপরাধ করতে পারে, যার মধ্যে ছিল তিন অধ্যাপকের তিনটি বাইক পোড়ানোর মতো সাহস? এরা যে সংখ্যায় বেশি নয়, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের দাপট অবাক করার মতো।

ইউটিউবের ছবিগুলো সত্য হলে, পুরো ঘটনার সময় পুলিশ সদস্যরা পাশেই ছিল, অর্থাৎ তাদের উপস্থিতিতেই সব ঘটেছে। পরে জানা গেলো সে জেলার পুলিশ সুপার নিজেই একজন সনাতন ধর্মের লোক। তাছাড়া স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ধর্মও তাই। সেই অবস্থায় কি করে গুটিকয়েক ধর্মান্ধ মাস্তান একজন নিরপরাধ হিন্দু শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে একদিকে দেশের গোটা শিক্ষক সমাজকে অপমাণিত করলো এবং অন্যদিকে হিন্দু জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করলো এ দেশ তাদের নয়, তাদের এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।

তৃতীয় প্রশ্নটি হলো যে জেলার পুলিশ প্রধান একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী, সে জেলারই এক সাব-ইন্সপেক্টর কীভাবে বলতে পারলেন যে যেহেতু কেউ মামলা করেনি, তাই মামলা হয়নি। ওই সাব-ইন্সপেক্টরের অবশ্যই জানা উচিত যে ফৌজদারি কার্যবিধির আইন অনুযায়ী সে ব্যক্তিকেই মামলা করতে হয় যিনি কোন আমলযোগ্য অপরাধের কথা জানতে পেরেছেন। এ দায় থেকে পুলিশও মুক্ত নয় এবং তাই কেউ মামলা না করলেও স্থানীয় পুলিশেরই দায় ছিল মামলা করার, যে আইনি দায়িত্ব থেকে স্থানীয় পুলিশ ৯ (নয়) দিন পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় ছিল।

পরে জল অনেক ঘোলা হওয়ার পরে পুলিশই বাদী হয়ে মামলা করেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী তিনটি কর্তৃপক্ষ তদন্ত দল গঠন করেছে, যার একটি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে, অন্যটি জেলা পুলিশের পক্ষে এবং তৃতীয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। এটি ধরে নেওয়া অযৌক্তিক হবে না যে এসব সিদ্ধান্ত মামুন ভাইয়ের লেখার প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ফল নিশ্চয়ই। মামুন ভাইয়ের লেখার পরই গোটা দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার লোকেরা জেগে উঠেছেন, ঢাকাসহ বহু জায়গায় অগণিত মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করে প্রমাণ করেছেন দেশে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, ধর্মান্ধরা নয়। জয়তু মামুন ভাই।

Advertisement

এ ঘটনার পর অসাম্প্রদায়িক চেতনার জনগোষ্ঠীকে যে প্রশ্নটি বার বার শংকিত করছে তা হলো এই মৌলবাদী ধর্মান্ধ চক্র আর কত দূর যেতে পারবে, তাদের অপপ্রচেষ্টা থামাবার পথই বা কি? কিছু কিছু লোক, জেনে হোক বা না জেনে হোক, ঘটনাটি কিছু মাস্তান কর্তৃক একজন শিক্ষককে অপদস্ত করার একটি আঞ্চলিক বিষয় বলে হালকা করার চেষ্টা করছেন। এমন হালকা কথা বলে তারা মূল ইস্যুটিকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন। এটি যে গোটা দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পরিকল্পিত এবং ঐক্যবদ্ধ অপপ্রয়াসেরই অংশ, তা তারা উপলব্ধি করতে নারাজ।

এই অপশক্তির একটিই উদ্দেশ্য যা হলো দেশে তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা আর তাই তাদের যাত্রাপথ রুদ্ধ না করলে তারা যে সে পথেই এগোবে এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। সর্বশেষ খবরটি আরও ভয়ঙ্কর এই অর্থে যে কলেজ কর্তৃপক্ষ নাকি এই ভারপ্রাপ্ত হিন্দু অধ্যক্ষকে তার পদ থেকে অপসারণ করেছে, যা থেকে এটি আন্দাজ করা অযৌক্তিক হবে না যে তারাও মৌলবাদেরই ধারক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হটিয়ে তালেবানি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ হিসেবে তারা দেশকে হিন্দু শূন্য করার খেলায় মত্ত হয়েছে।

কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠনের খবর প্রশংসনীয় হলেও এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এ ধরনের একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য যে দুটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধেই যখন অভিযোগের তীর, সে অবস্থায় তাদের দ্বারা তদন্ত ন্যায়বিচারের তত্ত্বের পরিপন্থি হবে এবং তা গ্রহণযোগ্যতা নাও পেতে পারে।

ঘটনাটিকে শুধু স্থানীয় একটি ছোট বিচ্ছিন্ন বিষয় মনে করা হবে যৌক্তিকতার খেলাপ। এটিতে পরিলক্ষিত হয়েছে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানের কথা। মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মণ্ডল, ঢাকায় অধ্যাপক ড. লতা সামাদ্দার, শিক্ষিকা আমুদিনি পাল, সুনামগঞ্জের ঝুলন দাস, নাসিরনগরের মনোরঞ্জন দাস, নরসিংদী রেলস্টেশনে আধুনিক পোশাক পরিহিতা এক নারীকে যে কারণে, যে উদ্দেশ্যে যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হেনস্তা করেছে, সেই একই গোষ্ঠী অধ্যাপক স্বপন বিশ্বাসকেও লাঞ্ছনা করলো। তাদের কর্মকাণ্ড বিচ্ছিন্ন নয় বরং একই সূত্রে গাঁথা এবং সম্মিলিত অপচেষ্টার অংশ।

এলাকা ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে অপরাধ পরিকল্পনার জন্য অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ। তাই একে রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব দিয়েই দেখা উচিত যার জন্য দরকার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত। এই লেখাটি চলাকালে জানা গেল যে একজন অ্যাডভোকেট বিষয়টি মহামান্য হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চের নজরে আনলে মাননীয় বিচারপতিরা ওই অ্যাডভোকেটকে বলেছেন, তিনি রিট মামলা করলে তা শোনা হবে। একের পর এক এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটিয়ে ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের চেতনাকে পরাস্ত করে তালেবানি সংস্কৃতি এবং চেতনা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার যে নিশ্চয়তা দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, পাকিপ্রেমি জিয়াউর রহমান গোলা-বারুদের সাহায্যে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তা ধ্বংস করেছেস, যা পরে এরশাদ এবং খালেদা জিয়াও দুধ-কলা দিয়ে লালন করে এসব ধর্মান্ধের হাতকে শক্তিশালী করেছে আর্থিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করে। এ কারণেই আজ তারা এ ধরনের আস্ফালন করার সাহস পাচ্ছে।

২০০১ সালে নির্বাচনের পর শত শত হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ওপর বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রীয় মদতে যে নির্যাতন বিশ্ব বিবেককে প্রকম্পিত করেছিল, যার পর কয়েক হাজার হিন্দু দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, সে ধরনের পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে এই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, আর স্বপন বিশ্বাসের ওপর আক্রমণ তারই অবিচ্ছিন্ন একটি অংশ বটে। এই অপশক্তিকে বেশি দূর এগোতে দিলে এরা কি করবে তা না বোঝার কারণ নেই।

২০০১ সালে পাকিপ্রেমি বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু আজ যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সরকার ক্ষমতায়, তখন এ ধরনের ঘটনা কাম্য হতে পারে না। সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে একজন বিজ্ঞ লেখক স্বপন বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোকে জাতির গলায় জুতার মালা পরানোর শামিল বলে যথার্থই উল্লেখ করেছেন।

অধ্যাপক মামুন ভাইও একই ধরনের কথা বলেছেন। একটু হালকা করে আমি বলতে চাই অধ্যাপক স্বপন বাবুর গলায় জুতার মালা পরানো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গলায় জুতার মালা পরানোর শামিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের পরাজিত করে সৌভাগ্যবশত আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায়, যিনি নিশ্চিতভাবে তার পিতার মতোই অসাম্প্রদায়িক, যিনি সব সময় বলেন, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’, যিনি দেশের অর্থনীতিতে এনেছেন অভাবনীয় বিপ্লব।

সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে ধ্বংস করার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে ব্যক্তিগত বিবেচনার মাধ্যমে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে। মনে রাখতে হবে এসব ধর্ম ব্যবসায়ী-মৌলবাদী অপশক্তির মূল উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই সরকারকে উচ্ছেদ করা, যার জন্য তারা দেশে বিদেশে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

যারা মনে করেন আপস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই অপশক্তিকে হাত করতে পারলে তারা আওয়ামী লীগের বাক্সে ভোট দেবে, তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এদের মধ্যে যারা বা যাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তান ভেঙে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে মেনে নিতে পারেনি, তারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দলকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে, এ ধরনের চিন্তা বাতুলতা মাত্র।

তাছাড়া, বিশেষ করে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আজ আকাশচুম্বি হওয়ায়, এদের ভোটের প্রয়োজনও হবে না। এই অপশক্তিকে প্রতিহত করার জন্য জনসাধারণেরও অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। যাদের রক্তে সাম্প্রদায়িকতার বীজ অপ্রতিরোধ্যভাবে বিরাজ করছে, তাদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাণী প্রচার উলু বনে মুক্তো ছড়ানোর মতোই হবে কেননা তারা মজ্জাগতভাবেই সাম্প্রদায়িক। কিন্তু এমনও অনেকে আছেন যাদের সুপরামর্শ দিয়ে সম্প্রীতির তত্ত্বে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

অনেক বছর আগে বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন লেখক এলেক্স হ্যালির লেখা, ‘দ্য রুটস’ উপন্যাস অবলম্বনে যে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছিল, যেটিতে কয়েকশো বছর আগে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা ক্রীতদাসদের ওপর নির্যাতনের কথা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেটি দেখার পরে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর বৈষম্য এবং নির্যাতনের মাত্রা বহুলাংশে কমে গিয়েছিল।

আমরাও যদি সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের কথা, এসবের অমঙ্গলের দিকগুলো কিছু সংখ্যক বিপথগামী ব্যক্তিকে, যারা মজ্জাগতভাবে সাম্প্রদায়িক নয় অথচ ঘৃণার অপপ্রচার দ্বারা আকস্মিকভাবে প্রভাবিত হয়ে সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে, তাদের অনেককেই সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

এ ব্যাপারে কাজী নজরুল, লালন শাহ, শাহ আব্দুল করিমসহ অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক কবি/লেখক/বাউলের বাণী প্রচার করা হলে তাতে নিশ্চয়ই কিছুটা কাজ হবে, কেননা গোটা দেশেই এদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে তাদের যারা গ্রাম্য থিয়েটারসহ নাটক, যাত্রা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন। যে সব ধর্ম ব্যবসায়ী ওয়াজের মাধ্যমে ঘৃণার বীজ ছড়াচ্ছে, তাদের প্রচেষ্টা বন্ধ করে, সেই সব ধর্মীয় নেতাকে উৎসাহিত করতে হবে যারা ওয়াজের মাধ্যমে মঙ্গলের কথা, সম্প্রীতির কথা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা প্রচার করবেন। ঘৃণা ছড়ানো ফৌজদারি অপরাধ বিধায় যারা এই ঘৃণ্য কাজটি করছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে, যেটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বদ্ধপরিকর জনগোষ্ঠী যথার্থই মনে করেন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা জিইয়ে রাখার জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। একমাত্র তিনিই পারেন সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পরাস্ত করতে, যা আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মুনতাসীর মামুন ভাই দেশে হিজাব পরা নারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাধিক্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সপ্তাহ দুয়েক আগে অসাম্প্রদায়িকমনা জনৈক সংসদ সদস্য আমার সাথে আলাপকালে বলেছিলেন রাস্তায় বেরুলে ১০ জন নারীর মধ্যে ছয়জনকেই দেখা যায় হিজাব পরা।

হিজাব কখনো আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিল না। এমনকি এটি ইসলামিক বিধানেরও অংশ নয়, এটি দ্বারা পর্দাও হয় না। আরব বিশ্বে এর প্রচলন নেই। এর দ্বারা ইসলাম ধর্ম পালন করা হচ্ছে না, প্রচার করা হচ্ছে দেশে তালেবানি এবং পাকিস্তানি সংস্কৃতি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে হিজাব বলে কোনো কিছুই আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে হঠাৎ করেই এটি বিস্তার লাভ করেছে, যার পেছনে নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানপ্রেমিদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্ক তার দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নামাজের জন্য জায়গার কোনো অভাব নেই। তা সত্ত্বেও এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি টিএসসিতে নামাজের জায়গা নির্ধারণের জন্য অযৌক্তিক দাবি তুলেছেন, তার পেছনেও কোনো ধর্মীয় অনুভূতি কাজ করছে না, বরং দেশে তালেবানি মন্ত্র বিস্তারের জন্যই তাদের এই অযৌক্তিক অপপ্রয়াস।

কিছুদিন আগে হঠাৎ করে কাওয়ালি সঙ্গীতের আয়োজনের পেছনেও একই পাকিস্তানি/তালেবানি মনোভাবই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। এরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। আমরা যদি এখনই এই অপশক্তিকে রুদ্ধ করতে না পারি তাহলে এরাই আমাদের রুদ্ধ করে দেবে।

এরই মধ্যে সাভারে এক হিন্দু শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় সম্ভবত সাম্প্রদায়িকতা কাজ করেনি। এ ব্যাপারে দুজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে এবং রিমান্ডের ব্যবস্থা করে পুলিশ এবং র‌্যাব যা করেছে তার জন্য তারা অবশ্যই সাধুবাদের দাবিদার।

তারপরও একটি কথা উল্লেখ করতে হয়, যেটি হলো এজাহারে মূল আসামির বয়স ভুলক্রমে ১৬ বছর উল্লেখ করায় একজন এসআই বলেছিলেন এজাহারের যে বয়সের উল্লেখ আছে তাই গ্রহণ করতে হবে। এসআই সাহেব ভুল করেছেন। এজাহারের উল্লেখিত বয়সই চূড়ান্ত নয়। তদন্তকালে এবং/অথবা বিচারকালে পুলিশ, আদালতই নির্ধারিত করতে পারবে আসামির বয়স।

র‌্যাবকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এই জন্য যে, তারা প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে জেনেছেন মূল আসামির বয়স ১৬ নয় বরং ১৯। মুক্তিযুদ্ধের এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার সব মানুষকেই এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি, পাকিস্তানি এবং তালেবানি অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। এই অপশক্তিরা নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবারও তাই হচ্ছে। এদের আস্ফালন রুখে দেওয়ার এখনই সময়।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

এইচআর/এমএস/ফারুক