চলে গেল ১ জুলাই। ছয় বছর আগে, ২০১৬ সালের আজকের দিনে ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সব থেকে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা। সেদিনের ওই ভয়াল রাতে গুলশান-২ এর হলি আর্টিসান ক্যাফে-তে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের আদর্শে প্রভাবিত এদেশীয় কিছু জঙ্গি। হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২২ জন।
Advertisement
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, বিচারবিভাগ, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সন্ত্রাসী খতমে কঠোর দমননীতি গ্রহণে উদ্যোগী হয়। এমন সমন্বিত জঙ্গি বিরোধী অবস্থান এর আগে দেখা যায়নি। তাই বলা হয় হলি আর্টিসান হামলার আগের ও পরের বাংলাদেশ একেবারেই ভিন্ন। ঢাকার পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, এই হামলার পর ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পসহ উন্নয়ন কাজগুলো করা যেত না।
তিনি বলছেন, “তখন হয়ত দেশের চিত্রটা অন্যরকম হত; নিরাপত্তাজনিত কারণে বিদেশি প্রকৌশলীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আসতে চাইত না”। কথাগুলো সত্য। কিন্তু একইসাথে এ কথা বলা যাবে না যে আমরা পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত আছি। সে কথা খোদ কমিশনারের কথাতেই আছে। তার ভাষায়, “এখনও কিন্তু তাদের তৎপরতা মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে”।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী হামলার বিচারপ্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আপিলের সুযোগ পাবেন এবং সে বিবেচনায় বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এ মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছিল, ২১ জন এ হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ওই দিন অভিযানে নিহত হন, পরে বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা অভিযানে নিহত হন আটজন; বাকি আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
Advertisement
এটি ছিল এমন এক ঘটনা যে ঘটনা বাংলাদেশে হবে এমনটা কেউ কোনদিন ভাবেনি। এসব ঘটে পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে, সিরিয়ায়, লিবিয়ায়, ইরাকে। অথচ ঘটেছিল বাংলাদেশে। যে বাংলাদেশ আমরা আবহমানকাল থেকে দেখে আসছি, যে বাংলাদেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি, ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, সেই বাংলাদেশে অনেক রক্ত ঝরেছে ঠিক, কিন্তু এই গুলশান হামলা ছিল সব ঘটনা থেকে আলাদা।
ঘটনার সময় থেকে সিএনএন, বিবিসিসহ পশ্চিমা গণমাধ্যম যেভাবে রিপোর্ট করছিল, মন্তব্য প্রচার করছিল তাতে মনে হচ্ছিল যেন বাংলাদেশ যেন আরেক সিরিয়া। কোনও প্রকার প্রমাণ ছাড়া, সাইট ইন্টেল গ্রুপের ডিরেক্টর রিতা কার্জ ছবিসহ প্রচার করলেন বাংলাদেশে ঢুকেছে আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট– আইএস।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর বীরত্বে নব্য জেএমবি-নামের এই জঙ্গিরা দেশব্যাপী এরপর অনেকগুলো অপারেশন চালাতে গিয়ে খতম হয়েছে।
বাংলাদেশকে বারবার সাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করেছে রাজনীতি, যার চূড়ান্ত আঘাত ছিল হলি আর্টিসানে হামলা। উদ্দেশ্য ছিল, এদেশকে জঙ্গিবাদে ছেয়ে ফেলা। হামলাকারীরা মারা গেছে, তারা সফল হতে পারেনি। এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সমাজকে আরও বিভক্ত, কলুষিত ও ধর্মীয় রাজনীতির বিষে আক্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল জঙ্গিরা। গুলশান হামলার পর জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমনে বড় সাফল্য দেখিয়েছে।
Advertisement
কিন্তু এরা দমে যায়নি। এদেরই প্রেতাত্মারা এখন একের পর সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিতরাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কয়েকটি জেলায় তাণ্ডব চালিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ঘটনায় এদের নানা অপতৎপরতা প্রকাশিত। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, 'নব্য-জেএমবি এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। তাদের কোনো সক্রিয় কর্মী বা নেতা নেই’।
তবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিযবুত তাহরির এখনো সক্রিয় রয়েছে। হিযবুত তাহরির এখনও বড় উদ্বেগের বিষয়, কারণ সংগঠনের শীর্ষ নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন এখনো পলাতক। এসব তথ্য আমাদের জন্য উদ্বেগের। কিছুদিন পরপর সন্দেহভাজন জঙ্গিদের গ্রেফতার এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার ইঙ্গিত দেয় যে জঙ্গিরা এখনও সক্রিয়।
এ কথা সত্য, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে সংঘাত ও হিংসা পুরোপুরি দূর করা যায় না। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, এসব নানাভাবে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এই জঙ্গি মতাদর্শের লোকেরা মানুষের মগজ ধোলাই করে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যায়। তাই তার বিপক্ষ রাজনীতিকে অনেক বেশি রাজনৈতিক চর্চা করতে হয়। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রকে খেয়াল রাখতে হবে কোনও গোষ্ঠী, ধর্মীয় বা অন্য কোনও সংখ্যাতত্ত্বের জোরে যেন নিরঙ্কুশ সুবিধা ভোগ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। মনে রাখা দরকার যারা বারবার ধর্মীয় সংখ্যার আধিক্য দিয়ে সব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর চাপাতে চায়, রাষ্ট্র থেকে আদায় করতে চায়, তাদের সেই মনোভাবের মধ্যেই আছে সহিংসতার সব থেকে বড় সম্ভাবনাময় উৎস।
কোনও সন্দেহ নেই সেই সন্ত্রাসীরা কারও না কারও মদতে এই কাজ করেছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক যে সহিংস রাজনীতি এই বাংলাদেশ অতীতে দেখেছে, তার সঙ্গে বর্তমানের পার্থক্য অনেক। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্রের রাজনীতি সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি মানুষের কাছে। তাই নতুন কৌশলে এগোতে চেয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। যারা স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে রাজনীতি করে, এখন তাদের ঘরে ঢুকে গেছে এরা। তাই নিজেদের মূল্যায়ন করা দরকার, নতুন এই শক্তির প্রতি রণনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানে প্রচলিত ধারার রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন কী করে সূচিত হবে তা নিয়ে।
উদার ও সহনশীল মনোভাবসম্পন্ন মানুষের আবাসভূমি হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম ও মর্যাদা ছিল, জঙ্গিদের অপতৎপরতার কারণে তার অনেকটাই ম্লান হয়েছে। ধ্বংস, খুন ও বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে যারা ধর্ম কায়েমের চেষ্টা করছে, সমাজকে কলুষিত করছে, সে পথ আদতে যে ইসলামের পথ নয়, সে কথাও জোরের সঙ্গে বলবার রাজনীতিটা করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া বাংলাদেশকে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
এইচআর/এমএস