মতামত

হলি আর্টিজান হামলা ও এদেশের জঙ্গিবাদ

‘জঙ্গিরা রেস্টুরেন্টে ঢোকার সাথে সাথেই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। যারা নিহত হয়েছিলেন তাঁরা সবাই রেস্টুরেন্টে নৈশভোজে এসেছিলেন। যে যেখানে ছিলেন তাঁকে সেখানেই হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডে তারা আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এরপর তারা আইএসআইয়ের কালো পোশাক পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছিল। খুব দ্রুত অপারেশন শেষ হলে আস্তে আস্তে ভিতরে গিয়ে তল্লাশি করে মৃতদেহগুলো পাওয়া গেল। পাঁচ জন জঙ্গির মৃতদেহ বাইরে পড়ে ছিল। সেনাদল চলে যাওয়ার পর পর পুলিশ ঘটনাস্থল বুঝে নেয়।

Advertisement

সিআইডির ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেশন দল আসে। প্রাথমিক তদন্ত, আলামত জব্দ, মৃতদেহের সুরতহাল তৈরি করে হাসপাতালের মর্গে পোস্ট মর্টেমের জন্য প্রেরণ করা হয়।বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনায় জঙ্গিরা দেশি-বিদেশি ২৪ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে দুজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানি এবং একজন ভারতীয় ছিলেন। আহত হয়েছিলেন প্রায় ৪০ জন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পুলিশ।ঐ ঘটনার পর জঙ্গিদের বিষয়টি আমার একান্ত এখতিয়ারে নিয়ে এসে দেশব্যাপী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করি।’’(এ কে এম শহীদুল হক, পুলিশ জীবনের স্মৃতি,২০২২,পৃ ২৮৫-২৮৬)

আজ থেকে সাত বছর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। কারণ সেদিন ১৭ জন বিদেশিকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা। ওই দিন হামলাকারীদের গুলি ও বোমাবর্ষণের ফলে চার পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। তবে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, র্যাব এবং যৌথবাহিনীর সফল অভিযানের ফলে ছয় জন বন্দুকধারী সন্ত্রাসী মারা যায় এবং একজনকে গ্রেফতার করা হয়।

রাত ০৯:২০ মিনিটে, নয়জন জঙ্গি সদস্য ঢাকার গুলশান এলাকায় অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারিতে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করে এবং কয়েক ডজন মানুষকে জিম্মি করে। ওই ঘটনায় মোট আটাশ জন মানুষ নিহত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে। রাত থেকেই সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করে।

Advertisement

সেনাবাহিনীর ১ নং প্যারাকমান্ডো ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্বে ঘটনা শুরুর পরদিন, শনিবার, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অপারেশন চালায়। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর স্পেশাল ফোর্স ১নং প্যারা কমান্ডো (চিতা) মাত্র ১২-১৩ মিনিটেই ঘটনাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। অপারেশন থান্ডারবোল্ট সফল হয়। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১ নং প্যারা কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের অপারেশন, পেশাদারিত্ব প্রশংসা পায়। ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত ৪টি পিস্তল, একটি ফোল্ডেডবাট একে-২২, ৪টি অবিস্ফোরিত আইআইডি, একটি ওয়াকিটকি সেট ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

আসলে ১ জুলাই (২০১৬) জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী এদেশের জন্য হামলার নতুন কৌশল শুরু করে। অন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সারা বিশ্বজুড়ে জিম্মি নাটকের অনেক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল প্রথম। এদেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা কিংবা গাড়ি বোমার ব্যাপক প্রচলন এখনো শুরু হয়নি। ২০২২ সালে তারা সেই চিন্তা করছে কিনা তা আমাদের ধারণার মধ্যে নেই। ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করার ঘটনায় সেসময় দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট)।

জঙ্গিদের দাবি অনুযায়ী, গুলশানের ওই রেস্তোরাঁয় তাদের হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরো ৪০ জন। একই তারিখে সকাল ১১টা ২ মিনিটে গুলশানে কূটনৈতিকপাড়ায় হামলার হুমকি দিয়ে টুইট করেছিল ‘আনসার আল ইসলাম’। অন্যদিকে কূটনৈতিক পাড়ার ক্যাফেতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের হামলা ও জিম্মি সঙ্কটের মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ভবসিন্ধু বর নামে পঞ্চাশোর্ধ হিন্দু পুরোহিতকে কুপিয়ে জখম করা হয় ২ জুলাই ভোরে। তার আগেরদিন (১ জুলাই ) সকালে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাষ্ঠসাগরা গ্রামের শ্রী শ্রী রাধামদন গোপাল বিগ্রহের (মঠ) সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে (৫০)।

এ ঘটনায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) দায় স্বীকার করে বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ দাবি করে। ৩০ জুন রাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে একই কায়দায় হত্যার ঘটনায় আইএসের দায় স্বীকারের খবর দিয়েছিল সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। শেখ হাসিনা সরকার ভোটে নির্বাচিত হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই (২০১৬ সালের আগে) যে পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস চলছিল তার জায়গায় ধর্মীয় উগ্রবাদিতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তখন লেখক-প্রকাশক, ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, সমকামী অধিকার কর্মী, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধভিক্ষু এবং ভিন্ন মতের মুসলিম ধর্মগুরুসহ বেশ কয়েকজন হিন্দু পুরোহিতকে একই কায়দায় কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।

Advertisement

ওই ঘটনার সময়কালটি স্মরণ করা যেতে পারে। তখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া একটি বিশেষ পর্যায়ে এসেছে। বেশ কয়েকজন কুখ্যাত অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হওয়া এবং বাকি অপরাধীদের বিচার নিষ্পন্ন করার মধ্য দিয়ে দেশ কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে বলে আমরা প্রত্যাশা করছিলাম। কিন্তু দেশের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী তথা জঙ্গিবাদের কবল থেকে দেশকে নিরাপদ করা তখন মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করেছে। অর্থাৎ জঙ্গিবাদ দমনে এই সরকারের কোনো দুর্বলতা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের চেয়ে আরও সতর্ক এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কেবল আইন কিংবা শক্তি প্রয়োগ নয়, গণসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তখন বেশ কিছু জঙ্গিদের অর্থায়নকারীদের খুঁজে বের করা হয়। তার সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে সম্পৃক্ত করা দরকার বলে সরকার ভাবতে শুরু করে। মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা উপকরণ ও পাঠ্যসূচিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা জরুরি বলে মনে করা হয়। গণমাধ্যমে জঙ্গিবাদের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থাও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত। এজন্য দিনটি এলে জঙ্গিবাদ দমনে শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যগুলোও সামনে আসে মিডিয়াতে।

যে কোনো ‘যুদ্ধবাজ’ সংগঠনকে ‘জঙ্গি’ এবং তাদের মতবাদকে ‘জঙ্গিবাদ’ বলা হয়ে থাকে। জঙ্গিবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘যুদ্ধকেই’ তারা একটি আদর্শ বলে গ্রহণ করে। সহিংসতা তাদের মোক্ষম হাতিয়ার। জঙ্গিবাদীরা আক্রমণাত্মক আদর্শের অনুসারী এবং নিজেদের মতাদর্শকে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ মতাদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে। এদেশের জঙ্গিবাদীরা তাদের মতাদর্শের ধর্মীয়করণ ঘটিয়েছে। যেমন ইসলামী জঙ্গিবাদ। আর সেই বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় চেতনা ও মতাদর্শের আধিপত্য কায়েমের জন্য সেই মতাদর্শের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র নিষ্ঠুর ক্ষমাহীন সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে উদার মানবতাবাদ ও গণতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফ্যাসিবাদী হিটলারের মতোই সব জঙ্গিবাদীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- আক্রমণ, বলপ্রয়োগ এবং যুদ্ধ করে নিজের মতবাদ ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। মূলত ধর্মীয় জঙ্গিবাদীরা নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। যেমন আইএস বা ইসলামী জঙ্গিরা সব বিধর্মীর বিরুদ্ধে জিহাদ, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের আহ্বান জানায়। কেবল ব্যক্তি নয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুসলমান শাসক তাদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে থাকলে সহিংস কর্মকাণ্ড ও অপপ্রচারের মাধ্যমে সেই ক্ষমতাবানদেরও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় জঙ্গিরা। বিশ্বের নানা দেশের মতো বাংলাদেশেও একাধিক জঙ্গিবাদী সংগঠনের অপতৎপরতা রয়েছে।

২০১৬ সালের আগে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর প্যারিসে হামলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল জঙ্গিবাদী সংগঠনের অপতৎপরতার সমস্যাটি বৈশ্বিক এবং সম্মিলিতভাবেই এর মোকাবিলা করা দরকার। উল্লেখ্য, ওইদিন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের যে এলাকায় প্রগতিশীল তরুণ ও মধ্যবিত্তের সমাবেশ হয় সে জায়গায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়- এটা মনে রাখা দরকার। কারণ একইভাবে আমাদের দেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চার ওপর আঘাত এসেছে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যার মধ্য দিয়ে। বাগদাদ কিংবা বৈরুতের রাস্তায় যে হামলা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেই হামলা প্রত্যক্ষ করেছে প্যারিস। এর আগে শার্লি এবডোতে হামলার পর দশ লক্ষ মানুষ প্যারিসের রাস্তায় মিছিল করে এর প্রতিবাদ জানায় এবং শার্লি এবডোর কার্টুনিস্টদের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু যখন প্রতিটি মানুষই হামলার সম্ভাব্য টার্গেট, তখন কে কার সঙ্গে সংহতি জানাবে? তবু মানবতার খাতিরে সামাজিক সংহতির বিকল্প নেই।

২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সন্ত্রাসী আক্রমণে সারা বিশ্বে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। ছোট-বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০ হাজারের মতো। এসময় বাংলাদেশে গ্রেনেড হামলা (২০০৪) হয়েছে এবং সিরিজ বোমায় (২০০৫) কেঁপে উঠেছিল সমগ্র দেশ। ভারতের ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাই হামলা পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। সেদিন ওই শহরের তাজ হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে ১০টিরও বেশি ধারাবাহিক গুলি ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৪ জন নিহত ও কমপক্ষে ৩০৮ জন আহত হন। হামলাকারী জঙ্গিরা ছিল পাকিস্তানি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবার সদস্য। মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা এশিয়া জুড়ে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সক্ষমতার একটি চিত্র তুলে আনে। ২০০৫ সালের ৭ জুলাইয়ে মধ্য লন্ডনের তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ও একটি বাসে আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় নিহত হন ৫২ জন। আহত হন ৭ শতাধিক মানুষ। ব্রিটেনের মাটিতে এটাই ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। লন্ডনে বোমা হামলাকারী চার জঙ্গির সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ ছিল। ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় তালেবান জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় ১৩০-এর বেশি শিক্ষার্থী। নিহত শিক্ষার্থীদের বয়স ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল। জঙ্গি হামলায় একই বয়সী আরও অন্তত ১২০ জনের বেশি স্কুলশিশু আহত হয়। বিশ্বব্যাপী চলা সন্ত্রাসবাদের মধ্যে এটি ছিল ভয়ঙ্করতম। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান ওই হামলার দায় স্বীকার করে।

হলি আর্টিজানের আগে-পরের মাসগুলোতে লেবাননের বৈরুতে বেশকিছু সন্ত্রাসী হামলা চালায় আল- কায়েদা সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। ওই সব ঘটনায় অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। একসময় লেবানন জুড়েই আইএসের তাণ্ডব চলেছে। তখন বৈরুতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪৩ জন নিহত হন। দক্ষিণ বৈরুতের শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ৪৩ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হন। লেবাননে ওই ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট। শিয়া হওয়ার কারণেই ওই এলাকার মানুষ আইএসের টার্গেট হয়। বিশ্ব গত এক দশকে বিভিন্ন নামের জঙ্গি গোষ্ঠীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এ যাবত চিহ্নিত জঙ্গি দল, গ্রুপ বা শক্তির সংখ্যা অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের হিসাব অনুসারে মোট ১২৫টি। তাঁর মতে এদের মধ্যে কোনটি হয়তো শুধু একটি ইউনিয়নের মধ্যেই কাজ করছে। কোনটি হয়তো একটি অঞ্চলে কাজ চালায়, কোনটি সারাদেশে কাজ করে আবার কোনটির নেটওয়ার্ক হয়তো আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিস্তৃত রয়েছে। এদের মধ্যে জামায়াত, হিযবুত তাহরির ও অন্যান্য মৌলবাদী দল একত্রিত হয়ে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থানের কারণে জঙ্গিগোষ্ঠী পিছু হটতে বাধ্য হয়।

তবে বিভিন্ন সময়ে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যাকাণ্ড এবং জঙ্গি দমন নিয়ে হতাশার কথা ব্যক্ত করা হলেও সেই হতাশা অনেকটাই অমূলক। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আবহমান বাংলা সবসময়ই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। একজন বাঙালি ও শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড সমর্থন করা আর আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা একই কথা। দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছে। উপরন্তু উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ করতে সমাজের সর্বস্তরের লোকদের এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় উগ্রবাদিতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য মসজিদ-মাদ্রাসায় ইমামদের দ্বারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।

আসলে ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে অস্ত্রধারীদের নজিরবিহীন হামলার ঘটনা জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের নির্মূলে আমাদের নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন করেছিল। হামলাকারীরা লোকজনকে জিম্মি করে। তাদের মধ্যে বিদেশি নাগরিক ছিল। আগেই বলা হয়েছে, ওই হামলায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়। ইতালির দুজন নাগরিক ও জাপানি একজন নাগরিকের গাড়িচালক নিহত হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছিল।

দেশে কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে লোকজনকে জিম্মি করার মতো এমন ভয়াবহ ঘটনা আর ঘটেনি। এধরনের হামলার সঙ্গে দেশের জামায়াত-বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা তদন্ত করা দরকার হয়েছিল। কারণ দলীয় স্বার্থে কোনো কোনো দল জঙ্গি সংগঠনগুলোকে ব্যবহার, অধিক প্রশ্রয় এবং সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করে থাকে- এই ধরনের হীন কার্যকলাপ থেকে তাদের বিরত রাখার জন্য জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। মানুষের মঙ্গলের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের সতর্ক করবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সকলের ভিতরে সুপ্ত দেশপ্রেম ও শুভবোধ উদয় করার দায়িত্ব শিক্ষকদের একার নয় মসজিদের ইমামের কিংবা মাদ্রাসার মৌলভীরও। তবে একথা সত্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত বিভক্ত ও রক্ষণশীল হওয়ায় সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি, যা দুঃখজনক। দেশের স্বার্থে এবং জঙ্গিবাদ নির্মূলে জাতিকে দলীয় বিভাজন আগে ত্যাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সকলকে দেশ ও জাতির স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে, যা হবে অধিক মঙ্গলময়।

মূলত দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি সকল রাজনৈতিক দল, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যদি দেশে সকলের সার্বিক প্রচেষ্টায় এই ধরনের ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয় তবে ভালো ফল পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত ধর্মনিরপেক্ষ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশের মানুষ কখনোই জঙ্গিবাদদের হীনষড়যন্ত্রকে এদেশের মাটিতে কার্যকর হতে দেবে না। তারপরও জঙ্গিদের নানা ধরনের অপতৎপরতা দেশের গণতন্ত্র, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করা হয়। তাই দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অধিক জরুরি। সেই কাজটিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে হচ্ছে। কারণ সাত বছর আগে সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করে তিনি বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

লেখক : বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।drmiltonbiswas1971@gmail.com

এইচআর/জিকেএস