শরীরের বাড়তি ওজন নিয়ে কমবেশি সবাই চিন্তিত থাকেন। সেই ওজন কমাতে কঠোর ডায়েট-শারীরিক কসরত কিছু বাদ দেন না। জিমে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাম ঝরাচ্ছেন। যেভাবেই হোক ওজন কমাতেই হবে। তবে আপনি সুস্থ থাকতে কিংবা সৌন্দর্যের জন্য ওজন কমালেও জাপানে এই চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
Advertisement
জাপানের মানুষ ওজন কমান জরিমানার ভয়ে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ২০০৮ সালে জাপানে ‘মেটাবো আইন’ চালু হয়। ‘মেটাবলিক সিন্ড্রোম’ থেকেই এর উৎপত্তি। এই আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের কোমরের মাপ নেওয়া হবে।
তবে এই আইন শুধু ৪৫ বছর থেকে ৭৪ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি পুরুষ ও নারীদের ওজন কত হওয়া উচিত, তাও পূর্বনির্ধারিত। পুরুষ কর্মীদের ওজন ৬২.৫ কিলোগ্রাম এবং নারী কর্মীদের ওজন ৫২.৯ কিলোগ্রামের মধ্যে থাকতে হবে। প্রতি বছর অন্তত ৬৫ শতাংশ কর্মীর ওজন মাপাতেই হবে, এমনই নির্দেশ দেওয়া রয়েছে।
কোমরের পরিমাপও নির্দিষ্ট। পুরুষ ও নারী বিশেষে এর মান যথাক্রমে ৩৩.৫ ইঞ্চি এবং ৩৫.৪ ইঞ্চি। জাপান সরকারের এক মাত্র লক্ষ্য, ২০১৫ সাল অবধি নাগরিকদের স্থূলতার হার ২৫ শতাংশ হ্রাস করা। যদি এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য পূরণ না হয়, তা হলে সেই সংস্থাগুলোর উপর জরিমানা ধার্য করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
Advertisement
মেটাবো আইন চালু হওয়ায় ‘মাটসুশিটা’ নামের একটি সংস্থা তাদের কর্মী, কর্মীদের পরিবারের সদস্য এমনকি তাদের প্রাক্তন কর্মীদেরও এই প্রকল্পের আওতায় রেখেছে। আবার কম্পিউটার উৎপাদনকারী এক সংস্থাকে নির্দেশ না মানার কারণে ১ কোটি ৯ লাখ ডলার জরিমানাও দিতে হয়েছে।
জাপানিরা তাদের খাদ্য তালিকায় খুব একটা জাঙ্ক ফুড রাখে না। মাছ-মাংস, শাকসবজি এবং ভাত তাদের প্রধান খাদ্য। তবে আমাদের দেশের চালের সঙ্গে জাপানিদের চালের অনেক পার্থক্য। সেই চাল গুলোর ভাত হয় কিছুটা আঠালো এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণও অনেক কম। তাই ওজন বাড়ার ভয় থাকে না।
জাপানের অনেক স্থানেই ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা নেই। অনেকেই ভাবতে পারেন এত উন্নত দেশে ট্রান্সপোর্টের সুব্যবস্থা নেই কেন। আসলে জাপানিরা স্বাস্থ্য ভালো রাখতে দিনে বেশ কিছুটা সময় হাঁটেন। যেহেতু কর্মব্যস্ত জীবনে হাঁটার জন্য আলাদা সময় বের করা মুশকিল। তাই সেই সব স্থানে হাঁটাকেই গন্তব্যে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় রেখেছে।
এই কঠোর আইন চালু হওয়ার ফলে জাপানের সবাই স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমেরিকাতে এ রকম আইন চালু করা বেশি প্রয়োজন। কারণ বিশ্ব জুড়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগেই বেশি মানুষ ভোগে। এই রোগগুলোর মূল উৎস অধিক ফ্যাট যুক্ত খাবার। এই ধরনের খাবার খেলে ওজন যেমন অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়তে থাকে, তেমন শরীরে ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
Advertisement
আমেরিকা ও কানাডায় এসব রোগের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সেদেশের সরকার এই রোগগুলোর প্রকোপ কমাতে নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করার কথা ভেবেছে। তামাক এবং মদের ক্রয়মূল্যের উপর অতিরিক্ত কর চাপানোর ফলে উপভোক্তার সংখ্যা কিছুটা কমে আসে।
যদি অপুষ্টিকর খাদ্যের উপর কর বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে গ্রাহকরা স্বাভাবিক ভাবেই স্বল্প মূল্যের স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে ঝুঁকতে শুরু করবেন। এমনকি বার্গার, পিজ্জার মতো ফ্যাটযুক্ত খাবারের প্যাকেটের গায়ে যদি ‘এই খাবার শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়’, ‘এই খাবার স্থূলতা বৃদ্ধির কারণ’ ইত্যাদি সতর্কবার্তা উল্লেখ করা থাকে, তা নজরে পড়লে অনেকেই এই খাবার আর কিনবে না।
এতে হিতে বিপরীতই হয়েছে। লোকে তবুও বেশি দাম দিয়ে ‘জাঙ্ক ফুড’ কিনতে থাকে। কিন্তু আমেরিকা এবং কানাডাকে পিছনে ফেলে জাপান একটি অভিনব পদ্ধতি চালু করে। এর স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শতবর্ষী মানুষ দেখা যায় জাপানে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে শতবছর যেমন হাতে গোনা, সেখানে জাপানে একশোর মাইলস্টোন সাধারণ ব্যাপার। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় একদম আলাদা। পরিসংখ্যান বলছে জাপানিদের গড় আয়ু প্রায় ৮৪ বছর। এতো বছর বাঁচার রহস্য হিসেবে বিভিন্ন মহলে একাধিক তত্ত্ব শুনতে পাওয়া যায়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, জাপানিদের মধ্যে হাঁটার বেশ প্রচলন রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ওয়াকিং রুট, পার্ক ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ কিলোমিটার হাঁটেন জাপানিরা। শুধু তাই নয় এই রুট বয়ে গেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্থাপত্যের মধ্যে দিয়ে। কোথাও পাহাড়, কোথাও নদী আবার কোথাও জঙ্গল।
এই দেশের নাগরিকরা দারুন স্বাস্থ্য সচেতন। তেল মসলা জাত খাবার একপ্রকার নিষিদ্ধ বলতে গেলে। এছাড়া তাদের মধ্যে তিনবেলা বিভিন্ন শাকসবজি দিয়ে তৈরি স্যুপ খাওয়ার বিশেষ প্রচলন রয়েছে। জাপানিদের ডায়েট মূলত ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর মাছ দ্বারা গঠিত। খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে তোফু, সামুদ্রিক শৈবাল ইত্যাদি। জাপানিরা বলেন ‘ইকিগাই’, ‘ইকি’ মানে বেঁচে থাকা ‘গাই’ মানে কারণ।
জাপানিদের যাতায়াতের অন্যতম ভরসা গণপরিবহন। তাদের মধ্যে নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করার সেইরকম চল নেই। গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য হাঁটাতেই ভরসা রাখেন। তবে প্রয়োজনে সাইকেল ব্যবহার করেন তারা।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নাগরিকদের চিকিৎসায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বহন করে জাপান সরকার। জাপানের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোও অন্য দেশের তুলনায় অনেক আলাদা। করোনার অনেক আগে থেকেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে মাস্ক পড়ার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রচলন রয়েছে। যার ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় সেই অর্থে সংক্রমণের ঢেউ এই দেশে দেখা যায়নি।
বর্তমানে নিজেদের সুস্থ রাখতে নানারকম স্বাস্থ্য সচেতন ক্যাম্পেইন চালায় সেখানকার লোকেরা। যা গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে কোনটা খাওয়া উচিত কোনটা নয়, সব বলে আসে। যার ফলে এই এলাকার লোকজনদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তুমুলভাবে বৃদ্ধি পায়। এমনকি এখানকার বাসিন্দারা অবসর সময়েও নানারকম কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। পরিবার, প্রিয়জনদের সঙ্গে গল্পের আসর বসান। ফলে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে মানসিক ক্রিয়াকলাপও বজায় থাকে। সূত্র: মিডিয়াম, জাপান জুনকি
কেএসকে/জিকেএস