গত সপ্তাহে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কে (আইপিইএফ) বাংলাদেশের যোগ দেওয়া নিয়ে কথা উঠেছে। আমেরিকার উপ-সহকারী পররাষ্ট্র সচিব যে সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন, তিনি তখন এমন একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাতে অনেকে মনে করেছিলেন বাংলাদেশে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামে যোগ দেবে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই ফোরামের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে আমেরিকা বাংলাদেশকে সেভাবে বিষয়টি জানায়নি। তাই বাংলাদেশেরও যোগাযোগ করার প্রশ্ন আসেনি।
Advertisement
বাস্তবে এই ফোরাম গঠন করার আগে উদ্যোক্তা দেশ আমেরিকাকে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তারা খুবই গুরুত্ব দিয়ে যোগাযোগ করেছে। যেমন- আমেরিকার কর্মাস সেক্রেটারি জিনা রাইমন্ডো জাপান সফরের সময় জাপানের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এছাড়া আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাপান ও ভারত সফরের সময় এই দুই দেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। আমেরিকা- আসিয়ান বিজনেস কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট টিড ওসিয়াসও বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কথা বলেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন্সের সঙ্গে।
এসব দিক বিবেচনা করলে, এ বিষয়টি নিয়ে সত্যি আমেরিকা বা উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের সঙ্গে ওই অর্থে কোনো আলোচনা করেনি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যথেষ্ট আলোচনা করেনি বলেই কিন্তু বিষয়টি এখানে শেষ হয়ে যায়নি। কারণ, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, ইন্ডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন্স, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এই ১৩টি দেশকে নিয়ে প্রাথমিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক গঠিত হলেও, এই ফোরামের ঘোষণার ভাষণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মি. বাইডেন বলেছেন, এখানে ভবিষ্যতে আরও অনেকের যোগদানের সুযোগ আছে। এবং তারা এখানে ভবিষ্যতে আরও দেশকে চায়, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও একই কথা উঠে এসেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এ ফোরামে যোগ দেবে কি না? আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বিষয়টি এখনও বাংলাদেশের সামনে পরিষ্কার নয়। কারণ, এখনও আলোচনার কোন ফোরাম বা ব্যক্তি বাংলাদেশের সামনে আসেনি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন সাংবাদিক এই ফোরামকে, ‘এশিয়ার ন্যাটো’ বলে উল্লেখ করছিলেন। ফলে এই ফোরামকে বাংলাদেশের বেশ কয়েক জায়গায় ইতোমধ্যে ‘এশিয়ার ন্যাটো’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বিষয়টি নিয়ে একটা ভুল হচ্ছে। মূলত আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ইন্ডিয়াকে নিয়ে গঠিত সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট ‘কোয়াড’কেই ২৫ মে প্রথম চায়নার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘এশিয়ার ন্যাটো’ বলে উল্লেখ করেন।
Advertisement
অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে চায়নার বক্তব্য আর ড. মাহথির মুহাম্মদের বক্তব্য একই। তাদের বক্তব্য হলো, চায়নাকে বাদ দিয়ে এশিয়ায় কোনো অর্থনৈতিক ফোরামে সফল হওয়া যাবে না। মাহথির ও চায়নার বক্তব্যকে এখনই শেষ বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। বাস্তবে ভবিষ্যতে চায়নার সঙ্গে এই ফোরামের সুসম্পর্ক হবে না বা চায়নাকে একেবারে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য বা তার প্রতিদ্বন্দ্বী এই ফোরাম গড়ে তোলা হয়েছে, এমনভাবে যদি বিষয়টি দেখা হয়- তাহলে বিষয়টি সঠিক কূটনৈতিক দৃষ্টিতে দেখা হবে না।
বাস্তবে বাইডেনের এই এশিয়া সফরের ভেতর দিয়ে যে দুটি ফোরাম গড়ে উঠেছে অর্থাৎ কোয়াড ও ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক, এ দুই ফোরামের গঠনে দুটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। এক, ইন্দো- প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামে আসতে চেয়েছিল তাইওয়ান। বাইডেনের আপত্তিতে সেটা হয়নি। আমেরিকা তাইওয়ানকে সমর্থন করলেও তারা এ মুহূর্তে এ ফোরামে তাইওয়ানকে অন্তর্ভুক্ত করে চায়নার সঙ্গে সরাসরি এ ফোরামকে সংঘাতে নিয়ে যেতে চায়নি।
অর্থাৎ এ ফোরাম নিয়ে বাইডেন মূলত ‘সফট কূটনীতির’ পথই অবলম্বন করেছেন। ঠিকই একই কাজ করেছেন, কোয়াড গঠনের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট তার নির্বাচনী প্রচার থেকেই বলে আসছেন, তিনি নির্বাচিত হলে কোয়াডে যোগ দেবেন। এ নিয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার নির্বাচনের পরপরই আলোচনাও হয়। তারপরও বাইডেন দক্ষিণ কোরিয়াকে এ মুহূর্তে কোয়াডে নেননি। এটাও তার ‘সফট কূটনীতি’। মূলত তিনি এ মুহূর্তে দক্ষিণ কোরিয়াকে কোয়াডে না নিয়ে উত্তর কোরিয়া ও চায়নার সঙ্গে আলোচনার পথটি আরও বেশি খোলা রাখলেন।
বাস্তবে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ককে এই এলাকায় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটা অর্থনৈতিক ফোরাম গড়তে চাচ্ছেন তার উদ্যোক্তারা। এটা তো সত্য, বর্তমান বিশ্বে- চায়না, রাশিয়াসহ কয়েকটি অটোক্রেটিক দেশের ব্যবসার সঙ্গে গণতান্ত্রিক বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যকে লড়তে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে সব সময়ই বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব পায়। প্রথমত ব্যবসাকে অবশ্যই জনগণের কল্যাণে ও দেশের কল্যাণে হতে হবে। গুটিকয়েক মানুষের কল্যাণে নয়। তাছাড়া ওই ব্যবসা করতে গিয়ে দুর্নীতি ও মানবাধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। ব্যবসা যেন কোনো মতেই দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করার মতো কাজ বাড়ানোর হাতিয়ার না হয়।
Advertisement
ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামটি তাই মূলত জোর দিয়েছে, ব্যবসার সাপ্লাই চেইনকে সহজ করা, ক্লিন এনার্জি ও কার্বন নিঃসরণ কমানো, ট্যাক্স ও দুর্নীতি এবং বাণিজ্যের ওপর। অর্থাৎ তাদের এই চারটি পিলারকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, তারা মূলত স্বচ্ছ বাণিজ্য প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্যই এ ফোরাম করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ এলাকায় কেন এই ফোরাম? বাস্তবে এই ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বাস করে। এবং পৃথিবীর মোট জিডিপির ৬০ শতাংশ এখানে। তাই স্বাভাবিকই এখানে এমন একটি ফোরাম তৈরি হওয়া দাবি রাখে। তারা এই এলাকার পণ্যের অন্যতম বাজার হিসেবে আমেরিকা এখানে আসবেই।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশ কেন এ ফোরামে যাবে? তাছাড়া বাংলাদেশ এ ফোরামে গেলে তার সঙ্গে চায়নার সম্পর্ক খারাপ হবে। বাংলাদেশ কেন অহেতুক চায়নার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে যাবে। এর থেকে তার নিশ্চুপ থাকাই ভালো। আসলে বাংলাদেশের নিশ্চুপতার অর্থ কিন্তু চায়নার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নয়। কারণ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট বলছেন, বাংলাদেশকে সঠিকভাবে এখনও কিছু জানানো হয়নি।
তবে তারপরও বলা যায়, চায়নার সঙ্গে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক কূটনীতিক সম্পর্ক সেটা যতদূর পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করে যাওয়া যায় সেভাবেই চলতে হবে। তাতে এই ফোরামে গেলে কোনোমতেই চায়নার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। যেমন- সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমরা কখনই একটি পার্টির বা শক্তির ওপর নির্ভরশীল হতে পারি না। আমাদের উন্নতি করতে হবে সবার সঙ্গে মিলে।
বাংলাদেশকেও সত্যিকার অর্থে উন্নতি করতে হবে সবার সঙ্গে মিলে। এটা বাংলাদেশের জন্য সিঙ্গাপুরের থেকে আরও বেশি দরকার। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন কেবল অবকাঠামো উন্নতি ও শ্রমবিক্রির পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশের এর পরের অধ্যায়ই উৎপাদনশীল ও রফতানিমুখী অর্থনীতিতে যাওয়া। এখন বাংলাদেশ যে গার্মেন্টসপণ্য রফতানি করে এটা মূলত আমাদের দেশে বসে শ্রমবিক্রি। আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের রফতানি নয়। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই আজ অবধি নিজস্ব কোনো ব্র্যান্ড নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি যেমনটি পেরেছে উত্তর পূর্ব এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। তাদের স্যামসাং এবং হুন্দাই এখন গোটা বিশ্বের প্রয়োজনীয় ব্র্যান্ড।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অনেক আগেই বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার পথে পা দিতে পারে। তেমন ইঙ্গিত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আছে। সেক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতির বাজার পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও গ্রহণযোগ্য করতে হবে। এবং ক্রোনি ক্যাপিটালইজম বা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দেওয়ার অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে সঠিক ক্যাপিটালইজমের পথটি সুগম করতে হবে।
এ দুটো কাজ করতে পারলে বাংলাদেশ যে শুধু পশ্চিমা বিশ্বের বাজার পাবে তা নয় বাংলাদেশে অনেক উদ্ভাবনী তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। যার সুফল শুধু আর্থিক উন্নতি নয় তারা বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বাজার বলতে কেন পশ্চিমা বিশ্বের বাজার বলা হচ্ছে। বাস্তবে এখনও এশিয়া, আফ্রিকা পণ্য উৎপাদক দেশ বা প্রোডাকশন হাউজ।
পণ্যের সঠিক বাজার হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব এখনও এশিয়া, আফ্রিকার উৎপাদিত পণ্যের মূল বাজার। তাছাড়া প্রযুক্তিগত ও বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব যে অটোক্রেটিক দেশগুলোর থেকে শক্তিশালী তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সময়। পশ্চিমা বিশ্বের ভ্যাকসিনই গোটা পৃথিবী বেশি গ্রহণ করেছে। চায়না বা রাশিয়ার ভ্যাকসিন সে বিশ্বাসযোগ্যতা তাদের অতি বন্ধু দেশগুলোর মানুষের কাছেও পায়নি। এর কারণ মূলত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সব কিছুতে তুলনামূলক স্বচ্ছতা থাকে অটোক্রেটিক দেশগুলোর থেকে।
বাংলাদেশকে তার অর্থনীতির এই উৎপাদনশীল দেশের পর্যায়ে যেতে হলে তাকে অবশ্যই ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের মতো বড় অর্থনৈতিক ফোরামে যোগ দিতে হবে। এই ধরনের অর্থনৈতিক ফোরাম তার জন্য অনেকগুলো দুয়ার খুলতে সাহায্য করবে। প্রথমত এখান থেকে বাংলাদেশ পাবে সফট স্কিল বা মেধানির্ভর দক্ষতা বিনিময়ের সুযোগ।
তাছাড়া উৎপাদনশীলতার পথে যেতে হলে যে অভিজ্ঞতা দরকার হয়- বাংলাদেশ সে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। বর্তমানের পশ্চিমা বিশ্বের বাজার যেমন বাংলাদেশ ধরতে পারবে তার উৎপাদিত নতুন পণ্যের জন্যে তেমনি এটাও মাথায় রাখতে হবে, এশিয়ার মধ্যে প্রথম পণ্যের বাজার হবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও জাপান। তাই তাদের সঙ্গে একসাথে এখন থেকেই পথচলা দরকার।
অনেকে বলছেন, এই ফোরাম পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত, তাছাড়া এখানে যোগ দিতে হলে যে পরিমাণ দুর্নীতি দূর করা বাংলাদেশের দরকার বা যে মানবাধিকার রক্ষা করা দরকার- তা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। এ যুক্তিগুলো মোটেই ঠিক নয়। কারণ, প্রকৃত মানবাধিকার রক্ষার দিক থেকে বাংলাদেশ ফিলিপাইন্সসহ অনেক দেশে থেকে এগিয়ে আছে। এবং এটা আরও এগিয়ে নেওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাংলাদেশে যে পরিমাণ দুর্নীতি আছে তা দূর করার ক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতা ও একটি সুবিধাভোগী শ্রেণিকে নিষ্ক্রিয় করা, যা খুব কঠিন কিছু নয়।
তাছাড়া প্রকৃত উদ্ভাবনী শিল্প তৈরি হলে তখন এই ব্যাংকখাত লুটের যে একটা অর্থনীতি- এটা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশে যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে তাতে আগামীতে উদ্ভাবনী শিল্পস্রষ্টাদের হাতেই শিল্প যেতে দিতে হবে। যেমন- আজ দক্ষিণ কোরিয়া সামসাংয়ের মতো ব্র্যান্ড তৈরি করতে পেরেছে বলেই, আমেরিকা সামসাং পণ্য দ্রুত তাদের দেশে সাপ্লাইয়ের জন্যে টেক্সাসে ১৭ বিলিয়ন ডলারের প্ল্যান্ট তৈরির সুযোগ দিচ্ছে। আজ তুরস্কের টিবি-২ ড্রোন তাদের অর্থনীতি বদলে দিচ্ছে। বাংলাদেশেরও ভবিষ্যৎ কিন্তু এই সামসাং বা টিবি-২ ড্রোনের মতো পণ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাবে। সে অবকাঠামো বাংলাদেশে তৈরি হয়ে গেছে।
এখন একটি বিষয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য নীতি এমনকি রাষ্ট্রীয় নীতিতে অনেক প্রভাব ফেলে। সেটা নিরপেক্ষ থাকা। অর্থাৎ কোনো জোটে না যাওয়া। বাংলাদেশের এই নীতিতে থাকা ঠিক হবে না বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এখান থেকে বেরিয়ে আসা ঠিক হবে- সেটাই চিন্তা করতে হবে। কারণ, ‘অতীত’ অভিজ্ঞতা দেয়। কিন্তু অতীতের হাত ধরে বর্তমানে ভবিষ্যতের পথে চলা যায় না। সেটা বাস্তবতাও নয়। আসলে এই নিরপেক্ষতার ধারণাটি এসেছে ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’ থেকে। নেহরু, সুকর্ন এঁরা এটা করেছিলেন। ভারত যে সময় স্বাধীন হয়েছিল সে সময় থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি অবধি আমেরিকা চেয়েছিল ভারতের বন্ধুত্ব।
সেদিন ভারতের কমিউনিজমের জোস এবং নেহরু’র বিশ্ব নেতা হওয়ার আকর্ষণের কারণেই কিন্তু আমেরিকা ও ভারতের বন্ধুত্ব হয়নি। সে সুযোগটি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানের জন্যে খুলে দেন। এবং ভারতকে না পেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চায়নার মাঝখানে একটা বাফার স্টেট পাকিস্তানের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করে আমেরিকা। আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে পাকিস্তানের পশ্চিমখণ্ড যেমন টিকে যায় তেমনি চায়না আমেরিকা বন্ধুত্ব হয়ে- দুর্বল হয়ে পড়ে ভারত।
কিন্তু আজ এর উল্টো পিঠ দেখার সময় এসেছে। সেদিন যদি নেহরু আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন তাহলে চিত্র ভিন্ন হতো। সে সময়ে ভারত এমনিতে চায়নার থেকে প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত ভাবে অনেক এগিয়েছিল। তাই আমেরিকা বা পশ্চিমা নতুন প্রযুক্তি পেয়ে ভারত আরও এগিয়ে যেতো। তাহলে আজ তার এই চায়নার ভয়ে থাকতে হতো না। অন্যদিকে পাকিস্তান মুসলিম দেশ হয়ে কোনো মতেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে তার দেশে বাড়তে দিতে পারতো না।
তাছাড়া সোভিয়েত সামরিকখাতে প্রযুক্তিগতভাবে পাকিস্তানকে এত উন্নত করতে পারতো না। বরং আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব থাকলে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় যেমন আমাদের স্বাধীনতার উদ্যোগ নিয়েছিলেন- ওই সময়ে বা আরও আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো। অন্যদিকে দুর্বল পশ্চিম পাকিস্তানও বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ এমনকি করাচিকেও রাখতে পারতো না। এগুলো স্বাধীন হয়ে যেতো।
তাই সব সময়ই যে নিরপেক্ষতা কোন রাষ্ট্রের জন্য বড় নীতি তা নয়। কারণ, রাষ্ট্রনীতি বাস্তব। বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়েই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পৃথিবী ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও স্বৈরতন্ত্রী বিশ্বে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক চাহিদার দেশকে বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিরপেক্ষতা তাকে খুব বেশি শক্তি দেবে এমন বাস্তবতা কিন্তু এ মুহূর্তের পৃথিবী বলছে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত।
এইচআর/জেআইএম/ফারুক