দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নানান অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এতে রোধ হচ্ছে সরকারের মোটা অংকের টাকা অপচয়। কোনো শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পেলেই সোচ্চার হয় সংস্থাটি। কিছু বিষয়ে অটোমেশন চালু করায় অনেক সমস্যা মিটলেও এখনো রয়েছে লোকবল সংকট। জনবল বাড়ানো ও কর্মকর্তাদের সময়পোযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে কাজের গতি আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর।
Advertisement
জানা যায়, জালিয়াতি করে চাকরির মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়ম, জমি বেহাত হওয়া চিহ্নিতকরণ, ভুয়া শিক্ষক-ছাত্র শনাক্ত, আয়-ব্যয়ের হিসাব ও অর্থ আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ চিহ্নিতকরণ, এক শিক্ষকের একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায় চিহ্নিতকরণ, নির্ধারিত সময়ের আগে উচ্চতর স্কেল গ্রহণ বন্ধসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের অনিময়-দুর্নীতি বন্ধে কাজ করছে ডিআইএ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিআইএ থেকে এ পর্যন্ত ১১শ ৫৬ জন শিক্ষকের ভুয়া সনদ চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব শিক্ষক অবৈধভাবে নিয়েছেন সাড়ে ৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ শতাংশ শিক্ষকের কাছ থেকে সে অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়েছে। কেউ কেউ সাধারণ ক্ষমায় পার পেয়েছেন। বাকিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
ডিআইএ’র যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ডিআইএ। এ প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘চোখ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডিআইএর তদন্তের মাধ্যমে সব ধরনের স্কুল-কলেজের অনিয়ম প্রকাশ পাচ্ছে।
Advertisement
‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যারা বিধিবর্হিভূত কাজ করছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে তথ্য-প্রমাণসহ ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করছি। এর মাধ্যমে সরকারি তহবিলের অর্থ অপচয় রোধ হচ্ছে।’
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আইন শাখার উপ-পরিচালক মোহম্মদ লিয়াকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী অপরাধীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয়। সেজন্য ডিআইএ থেকে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ পাঠালে সেটি একজন অতিরিক্ত সচিবের সমন্বয়ে শুনানি করা হয়। সেখানে কেউ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে তাকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। এ পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটালে অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারেন।
জানা যায়, সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে পাঁচ-ছয় বছর আগে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহির আওতায় আনতে পরিদর্শন কাজ ডিজিটালাইজ করা হয়। এতে তদন্ত কাজে বাড়ে গতি। তবে উদ্যোগ নিয়েও তহবিলের অভাবে জোড়া পরিদর্শন (পেয়ার ইন্সপেকশন) চালু করতে পারেনি। এটি চালু করা গেলে প্রতিবছর সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা সম্ভব হতো।
বর্তমানে সংস্থাটির জনবলের অভাব আছে। চার দশক আগে মাত্র সাড়ে সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য এ সংস্থায় যে জনবল ছিল, বর্তমানে ৪০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও সেই একই সংখ্যক জনবল আছে। এ কারণে সংস্থাটি বছরে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে পারছে। ফলে একটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে আসার পর দ্বিতীয়বার যেতে সময় লেগে যাচ্ছে অন্তত ১০ বছর।
Advertisement
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১২ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এ সংস্থাটি পরিদর্শন করেছিল। ১০ বছর পর আবার সেখানে এ সংস্থার একটি টিম তদন্ত কাজ চালাচ্ছে। গত ১০ বছরে এ সংস্থার বিরুদ্ধে অবৈধ ভর্তি, জাল সনদে পদোন্নতিসহ বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।
বিভাগভিত্তিক ভুয়া সনদ ও অর্থ আদায়ের সুপারিশডিআইএর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত সারাদেশে মোট ১ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের জাল সনদ চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতায় ঢাকা বিভাগের ২৫৬ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ৪৪ জন, রাজশাহীতে ৩২৩ জন ও খুলনার রয়েছেন ১৯৪ জন।
মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগের আওতায় ঢাকা বিভাগে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ৫২ জন, রাজশাহীতে ১২০ জন, খুলনায় ৫৭ জনসহ মোট ৩৩৯ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিমাসে মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) বাবদ গ্রহণ করা ৪০ কোটি ৬৯ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬২ টাকা আদায় করতে সুপারিশ করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এসব শিক্ষকের মধ্যে একাডেমিক, এনটিআরসিএ, কম্পিউটার, কৃষি, বিশেষায়িতসহ বিভিন্ন ধরনের সনদ জাল প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা যায়।
ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর জাগো নিউজকে বলেন, শুরুতে দেশের সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ডিআইএ প্রতিষ্ঠা হলেও বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান বাড়লেও সে অনুযায়ী জনবল বাড়ানো হয়নি। অবকাঠোমো সমস্যার কারণে জরুরি ফাইল রাখারও জায়গা হচ্ছে না। এতে তদন্ত তৈরি হয়েছে কাজে ধীরগতি।
‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহুমাত্রিক অনিয়ম রোধে আমাদের পরিদর্শকরা কীভাবে কাজ করবেন সে বিষয়ে ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অন্যান্য দেশে কীভাবে পরিদর্শন-তদন্ত করা হচ্ছে সেটি দেখা সম্ভব হলে পরিদর্শকরা আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠবেন। আমাদের কাজের গতি বাড়াতে একটি অটোমেশন সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। এটি পুরোদমে কার্যকর হলে পরিদর্শকরা কাউকে ছাড় দেওয়া বা অবহেলা করার সুযোগ পাবেন না। শিক্ষা প্রশাসনের সবাই ডিআইএর কাজ যে কোনো স্থান থেকে মনিটরিং করতে পারবেন।’
পরিচালক আরও বলেন, বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ হয়। এসব শিক্ষকদের সুপারিশ করার আগে তাদের সনদ যাচাই-বাছাই করলে জাল করার সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে ডিআইএ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও একাডেমিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। কাজের গতি অনেক বাড়বে। জাল সনদ চিহ্নিত কারণে কর্মকর্তাদের বেশি সময় নষ্ট হচ্ছে।
এমএইচএম/এএসএ/জেআইএম