মতামত

রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে, সমাজ গেছে ছিনতাই হয়ে

বাংলাদেশের মানুষের অনেক অর্জনের মধ্যে একটি হলো পদ্মা সেতু নির্মাণ। পদ্মা সেতুর কাহিনি এখন দেশ-বিদেশের মানুষ জেনে গেছেন। পদ্মা সেতু উৎকর্ষ, প্রযুক্তির নিদর্শন। পাশ্চাত্য পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে যে অপমান করেছিল বাঙালি সে অপমানের উপযুক্ত জবাব দিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ অর্জন হয়েছে শেখ হাসিনার আমলে।

Advertisement

জিয়া পরিবার ও এরশাদ পরিবারের নেতৃত্বে পাকিস্তানিয়ন প্রকল্প রোধ, বাংলাদেশের সীমানার স্থায়ীকরণ, সমুদ্র সীমা জয়, পার্বত্য শান্তি ও গঙ্গা চুক্তি, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার- এ তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। নাই বা করলাম। শেখ হাসিনাকে পছন্দ না করতে পারি কিন্তু এ কাজগুলো যে তিনি করেছেন তাতো অস্বীকার করার জো নেই। চ্যালেঞ্জ তিনি নিয়েছেন এবং জিতেছেন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যখন দেশের জঙ্গিয়ান হচ্ছিল তখন হাসিনা রুখে দাঁড়িয়েছেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। ক্ষমতায় গিয়ে জঙ্গি দমন করেছেন। আমরা জানি, জঙ্গিরা দমিত হয়েছে কিন্তু তাদের আদর্শ দমিত হয়নি। আওয়ামী লীগেরও একটি আদর্শ আছে যার মূল কথা অসাম্প্রদায়িকতা। এই আদর্শ বিনষ্ট করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে এর বিরোধীরা। এর মধ্যে আছে জামায়াত-বিএনপি, আওয়ামী লীগের দক্ষিণাংশ, হেফাজত ইসলাম, কওমি মাদরাসা, বিভিন্ন পিরের দল। কিছুদিন আগে হেজাবিদের [হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি] সঙ্গে সমঝোতা এদের আরও শক্তিশালী করেছে।

তত্ত্ব ছিল, এই সমঝোতা আওয়ামী লীগের ভোটের বাক্স ভরে দেবে। ভোটের বাক্স ভরেনি বরং তারা আরও উদ্ধত হয়ে ধমক দিচ্ছিল। শেখ হাসিনা এখন সেই তত্ত্ব থেকে খানিকটা সরে আসায় হেজাবিরা কিছুটা ক্ষুব্ধ ও ম্লান। ভোটের বাক্স যেমন ছিল তেমন আছে। বরং যারা ক্ষুব্ধ ছিল এ তত্ত্বে তারা ফিরে এসেছেন। কিন্তু আসলেই কি সব ঠিকঠাক আছে? হাসিনাবিরোধীরা কি চুপ করে গেছে? মোটেই না। আদর্শগত যুদ্ধে তারা আরও প্রভাব বিস্তার করছে। সেটি আওয়ামী লীগ নেতারা যারা সব পেয়েছিল দেশে আছেন তারা অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু অন্যরা করবেন না।

Advertisement

শেখ হাসিনার সময় কেন এমন হবে?

গত ২৬ জুন জাহানারা ইমাম স্মৃতি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে নাট্যজন মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান এবং আমাদের দায়’ প্রবন্ধে বিষয়টির একটি রূপরেখা প্রদান করেছেন। এ প্রবন্ধে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তা’হলো, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন কিন্তু সমাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। এ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- জয়বাংলা ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। জয়বাংলা তিনি আবার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। কিন্তু সমাজ তো জয়বাংলা বলে না। সমাজ যদি ছিনতাই হয়ে যায় তা’হলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সমীকরণে সাহায্য করে না। কয়েকটি উদাহরণ দিই।

এই নিয়ন্ত্রণটা নিয়েছেন তিনি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সাহায্যে। যে আমলাতন্ত্র সব সময় পরবর্তী সরকারের আগমন প্রতীক্ষায় সতর্ক থাকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আমলাতন্ত্র শেখ হাসিনার সব ডিক্টাট মানেন। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মুখ ফসকে একটি কথা বলে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের গলায় রশি বেঁধে ঘোরান আমলারা।’ [সমকাল, ২৭.৬.২২]

তিনি নিজে ছিলেন আমলা। সুতরাং অবুঝ কথা তিনি বলেননি। আসলে তিনি ভদ্রলোক এখনও, সেজন্য তাকে সবাই পছন্দ করে। প্রচলিত নেতাদের মতো, পকেট ভারী করতে পারেননি, দু’মুখো কথাও বলেন না। কিন্তু, আমলানির্ভরতা যে কতো বিপজ্জনক তা আমরা জানি। ভোটের বাক্সে তারা হয়তো সহায়তা করতে পারেন কিন্তু খুব গ্রহণযোগ্য হবে না। যে কারণে, জিয়া ও এরশাদকে এখনও বৈধ বলতে অনেকে দ্বিধা করেন।

Advertisement

পদ্মা সেতু নিয়ে যখন আমরা সবাই মেতে উঠেছি তখন রাজধানী থেকে দূরে প্রান্তিক দুটি অঞ্চলে দুটি ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমে এ খবর আসেনি। ইচ্ছে করেই হয়তো দেওয়া হয়নি বা এমনটি মনে হয়েছে তাদের যে, হরহামেশা এগুলো ঘটছে, এগুলো আবার সংবাদ হয় কী করে? বা রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এত ক্ষুব্ধ হবে। এ দুটি ধারণাই বিপজ্জনক। সংবাদ মূল্য যখন থাকে না এর অর্থ এগুলো স্বাভাবিক। এর অর্থ সমাজ এখন হাসিনাবিরোধীদের হাতে।

পদ্মা সেতুতে উল্লাস করতে পারি কিন্তু সমাজবিরোধী হলে ভোটের বাক্স তো ভরবে না। যদি সেটি না হয় তা’হলে অর্থ দাঁড়ায় রাষ্ট্র তার মতো সংবাদ চায় এবং সংবাদ মাধ্যমও তাই চায়। তা’হলে সংবাদ মাধ্যম গুরুত্বহীন হয়ে দাঁড়ায়, বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন বরং গুরুত্বপূর্ণ। এবং এখানে সরকার পরাজিত। কেননা এ মাধ্যমটি এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের দখলে। বিটিআরসির একমাত্র কাজ শেখ হাসিনা বা ‘নেতা’দের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তাকে হেনস্তা করা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর/শেখ হাসিনার আদর্শের পক্ষে যারা তাদের হেনস্তা করলে চুপ থাকা বা বঙ্গবন্ধু/শেখ হাসিনার আদর্শবিরোধী মন্তব্য দেখলে নিশ্চুপ থাকা। তা’হলে ইউসুফ যে বললেন, রাষ্ট্র শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে সেটি কাগজ কলমে কতটুকু আর বাস্তবে কতটুকু?

সমাজ যে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে তার একটি উদাহরণ দিচ্ছিলাম। ঘটনাটি ছেপেছে একমাত্র ভোরের কাগজ। সংবাদ অনুযায়ী, “সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ তুলে আবারো শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে এমন পরিস্থিতিতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। আর ওই ঘটনার সূত্রপাত বিজেপির বহিষ্কৃত নেত্রী নূপুর শর্মাকে প্রণাম জানিয়ে ওই কলেজের ছাত্র রাহুল দেবের ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টকে কেন্দ্র করে।’

জানা যায়, রাহুল গত ১৭ জুন ফেসবুকে ভারতের নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ‘প্রণাম নিও বস নূপুর শর্মা’ জয় শ্রী রাম’ ক্যাপশন দেয়। ১৮ জুন সকালে তাকে কলেজে দেখে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে একপর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের সহায়তা চান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। কলেজে পুলিশ এসে রাহুলকে নিয়ে যেতে চাইলে ছাত্ররা বাধা দেয়। এরপর অতিরিক্ত পুলিশ আসে। স্থানীয় লোকজনের সংখ্যাও বাড়ে। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা।’

বিকালে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের আশ্বাসেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এ সময় উত্তেজিত জনতার চাপে পরে পুলিশের পাহারায় জুতার মালা পরিয়ে রাহুল ও অধ্যক্ষকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসে। এই ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। পুলিশের উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।”[২৭.৬.২০২২]

শুধু তাই নয়, “শিক্ষকদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা ও পোড়ানো, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা ও মারপিটের ঘটনায় কোনো মামলা করা হবে না সংসদ সদস্য কবিরুল হক ও কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি অচিন চক্রবর্তী কোনো মামলা করবেন না বলে জানান।” এর কারণ বোঝা কঠিন হয়। সংসদ সদস্য মনে করছেন, মামলা করলে তার ভোট বিনষ্ট হবে। তারা স্বপ্ন দেখেন আওয়ামী আদর্শবিরোধীরা তাদের আত্মসমর্পণের কারণে ভোটের বাক্স ভরে দেবেন। আর শ্রী চক্রবর্তীর ঘাড়ে এত মাথা নেই যে তিনি মামলা করবেন। তা’হলে তাকে এলাকা ছাড়তে হবে। যে শেখ হাসিনা বিশ্বের শক্তিশালী নেতাদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু করেন তাঁর আমলে তাঁর দেশে এরকম ঘটনা কেন ঘটবে?

সংশ্লিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করতে হয়। ভারতের সঙ্গে পরম মৈত্রীর কথা যতই বলি, ভারতের কর্ণধারদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এটি কোনো লুকোছাপার ব্যাপার নয় যে, ভারতীয় দর্শন এখন হিন্দুত্ববাদে পরিণত হয়েছে। এর অভিঘাত আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর পড়ছে এবং তারা ক্ষুব্ধ। হিন্দু সম্প্রদায়ের উচিত উসকানিমূলক কোনো কাজ না করা। এটি বাস্তবসম্মত নয়।

নূপুর শর্মাদের মুরুব্বিরা বাংলাদেশে হিন্দুদের সহায়ক শক্তি নয়। সহায়ক শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। ছাত্রটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে এক মাদরাসা শিক্ষক। ছাত্রটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অধ্যক্ষ পুলিশ সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় নেতা ও পুলিশের উদ্যোগে [দেখুন যোগাযোগ মাধ্যম] এদের দুজনকে জুতোর মালা পরিয়ে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়। গত ৭৫ বছর কেন ১০০ বছরে বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটানো হয়নি। পুলিশ গলায় জুতোর মালা পরাবে শিক্ষক ছাত্রকে? এটি কোন বাংলাদেশ? বেশ কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জে জাতীয় পার্টির নেতা বা সংসদ সদস্য এক শিক্ষককে কানে ধরিয়েছিলেন। কবি তারিক সুজাত তখন লিখেছিলেন-বাংলাদেশকে কানে ধরিয়ে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের গৌরবের সময় বাংলাদেশকে জুতোর মালা পরানো হলো?

শেখ হাসিনার সময় এমন ঘটবে এই বাংলাদেশে? তাহলে তিনি না থাকলে বাংলাদেশ কোথায় থাকবে? ইতিহাস বলে, শেখ হাসিনা না থাকলে যারা তাঁর পাশে থেকে এখন তাঁর স্তব করছে, গান গাইছে, টাকা বানাচ্ছে তারা সব হবে পগার পার। মার খাবো আমরা? বারবার? আপনারা বলবেন, এ তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কী আছে?

কয়েকদিন আগে মুন্সিগঞ্জে ঘটছে হৃদয় মণ্ডলের ঘটনা, আমোদিনী পাল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক লাঞ্ছনা। এ তালিকা দীর্ঘ হবে। এর মধ্যে একটি প্যাটার্ন আছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন হিন্দুকে অভিযুক্ত করা হয়, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, সারা জীবন তাকে মামলার ঘানি টানতে হয়। যারা ঘটনা ঘটায়, মামলা করে তাদের কিছু হয় না, যদিও ঘটনাগুলো সাজানো প্রতিটি ঘটনার পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দক্ষিণাংশ জড়িত। এরপরও যদি কেউ বলে সমাজ ছিনতাই হয়ে যায়নি। তাহলে তারা এমনও বলতে পারে পদ্মা সেতু হয়নি।

প্রশ্ন শেখ হাসিনার আমলে কেন এসব পুলিশের বিচার হয় না, স্থানীয় নেতা যারা জড়িত তাদের দলে রাখা হয়? কোনো কৈফিয়ত চাওয়া হয় না। ভারতে মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হবে দেখে আমাদের এখানে হিন্দুরা তা হবে কেন? শেখ হাসিনা তো তা বিশ্বাস করেন না। করলে প্রশাসনে এতোসব উচ্চপদে তো কোনো হিন্দু থাকতেন না? কিন্তু, ওই যে, সমাজ আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই। দেশের আর্থিক উন্নয়নে নজর দেওয়া হয়েছে, মানস জগৎ বদলানোর কাজে বিনিয়োগশূন্য।

একই সময় আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে একই মনোভাব ঘটেছে। ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’র এক নম্বর প্রশ্ন-

“বিত্তশালী বাবার একমাত্র মেয়ে সেজুতি এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়ে প্যান্ট শার্ট পরে আধুনিকভাবে ঘুরে বেড়ায়। পাড়ার বখাটে যুবকেরা প্রায়ই তাকে অশালীন কথাবার্তা বলে উত্ত্যক্ত করে। এ ব্যাপারে সেজুতি বাবার নিকট অভিযোগ করলে, বাবা বলল তুমি শালীনভাবে চলাফেরা করো কেউ তোমাকে কিছু বলার সাহস পাবে না।

ক. হাক্কুল্লাহ শব্দের অর্থ কী?খ. হাদীস কাকে বলে?গ. “অশালীন পোশাকের কারণে অধিকাংশ ইভটিটিং হয়ে থাকে।” উদ্দীপকের আলোকে ব্যাখ্যা করো। ঘ. সেজুতির বাবার কথার মূল্যায়ন কর।” প্রশ্ন জাগে, মেয়ে এতোদিন বাবার সামনে ‘অশালীন’ পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে মা বাবা কি তখন আঙুল চুষছে? কোন পোশাক শালীন? আরও লক্ষ্য করুন গ ও ঘ তে ১০ নম্বরের মধ্যে ৭ নম্বর। অর্থাৎ বলতেই হবে ‘প্যান্ট শার্ট’ পরা ‘আধুনিক’ এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়। এধারণা এখন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কয়েকদিন আগে টিপ পরা নিয়েও পুলিশ এক কাণ্ড করেছে যার বিচার হয়নি এখন দেখছি শুধু পুলিশ নয়, সেনা বিভাগেও এই মনোভাব ছড়াচ্ছে, যে পোশাক আশাকের কথা মাদরাসা শিক্ষিত মানুষজন ওয়াজের মারফত প্রচার করে তাকেই গ্রহণ করতে হবে? এ পোশাক কি বাঙালি কখনও পরে?

কয়েকদিন আগে ফুটপাতে এক ল্যাম্প পোস্টের নিচে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। ১০ মিনিটে দেখলাম বারোজন মেয়ে-মহিলা ফুটপাত ধরে হেঁটে গেলেন। নয়জনের পরনে হিজাব ও বোরখা এমনকি দুই কিশোরী হবে এমন দুজনের হাতে কালো রঙের মোজা। সারাদেশে এ সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামের স্কুল-কলেজ শিক্ষকরা মেয়েদের এ পোশাক পরতে বাধ্য করছেন। এ পোশাক কি বাঙালিদের? আমাদের মা, দাদি, নানিদের তো এ পোশাক পরতে দেখিনি। হ্যাঁ, বোরখা অনেকে বাইরে গেলে পরতেন। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী এমনকি ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী, তাদের কন্যারা কি এই পোশাক পরেন? কারা পরেন? তাহলে এটি হচ্ছে কেনো? এটি তাদের রুচি আদর্শ ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে হেজাবিদের প্রতিবাদ। তারা চায় মেয়েরা এভাবে থাকুক।

পর্দা কেউ করতে চাইলে অবশ্যই করতে পারেন। কিন্তু পর্দা কি? এর অর্থ তাকে ঘরে আবদ্ধ থাকতে হবে? অসূর্যম্পশ্যা হতে হবে। স্বামী ছাড়া তার কাছে বিনা অনুমতিতে কেউ যেতে পারবে না। এমনকি পুত্রও নয়। এখানে পর্দার নামে যা করা হচ্ছে তাতো পর্দা নয়। তাহলে, লেকে, পার্কে বিভিন্ন আনাচে কানাচে বোরখা হিজাব হাত মোজা পরা তরুণীরা যা করছে তা কি? পর্দা? গত এক দশকে এ ধারা বৃদ্ধি পাচ্ছে?

শেখ হাসিনা যিনি সমুদ্রের সীমা নির্ধারণ করতে পারেন, দেশের স্থল সীমানা নির্ধারণ করতে পারেন তিনি এ ধারা দেখেও দেখেন না, এটা হতে পারে?

এ আমলে মসজিদে মসজিদে ওয়াজে ওয়াজে গণতন্ত্রের নামে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, শেখ হাসিনার আদর্শের বিরুদ্ধে যা বলা হয় শেখ হাসিনা কি তা জানেন, শোনেন? কয়েকদিন আগে ধানমন্ডির এক মসজিদে ঈদের আগে জুমায় শুনি, ইমাম বলছেন, ঈদ আসছে। ঈদ আনন্দের নামে টিভিতে এক সপ্তাহব্যাপী যা প্রচার হবে তা বেদাত। অর্থাৎ টেলিভিশনে সব সময় খুতবা পাঠ করতে হবে? মসজিদে মসজিদে ওয়াজে ওয়াজে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ধূলিস্মাৎ করা হচ্ছে।

শুনেছি, কিছুদিন আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এক সচিব মঙ্গল শোভা যাত্রার বিরুদ্ধে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন, তার কিছুই হয়নি। অথচ ইউনেস্কো এই সরকারের অনুরোধেই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে ঘোষণা করেছে। মিশরে, কেন্দ্রীয়ভাবে জুমার খুতবা ঠিক করে দেওয়া হয়। সব সমজিদে তাই পাঠ করতে হয়। এখানেও তেমনটি করার অনুরোধ করেছি, গ্রাহ্য হয়নি। এসব প্রচারণায় সমাজ কীভাবে ছিনতাই হয়ে গেছে তার উদাহরণ দিই। যে ব্যক্তি সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি করেছেন, ঘুস খেয়েছেন, ছেলে মেয়েদের মাদরাসায় না পড়িয়ে ইংরেজি বা সেক্যুলার মাধ্যমে পড়িয়েছেন এবং ‘ইসলামী’ দেশে নয় খ্রিস্টানদের দেশে পাঠিয়েছেন, অবসর নিয়ে তিনি প্রথমেই গ্রামে মাদরাসা করছেন।

প্রত্যেক এক মাইলে কয়েকটি মসজিদ। ধর্ম নিয়ে মনে হয় এক ধরনের প্রদর্শনী চলছে। অথচ ব্যক্তি জীবনে সুযোগ পেলে সবাই ঘুস খাচ্ছেন, ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। নির্মূল কমিটি এরকম ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া ধর্ম ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রদান করেছিল দুদকে। তারা ভয়ে সেটিতে হাত দিতে পারছে না। আমার দেশে আমাকে মুসলমান কি না তার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।

শেখ হাসিনা যিনি গঙ্গাচুক্তি করেছেন, শান্তি চুক্তি করেছেন, নারীদের ক্ষমতায়ন করছেন তাঁর আমলে এরকম কেন হবে?

সৌদি আরবের মতো কট্টর ওয়াহাবিরা এখন তাদের তথাকথিত ধর্মীয়নীতি থেকে সরে আসছে। আরব আমিরাত সরে আসছে। আর বাংলাদেশ সে পথে যেতে চাইছে যারা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ হত্যাকে সমর্থন করেছে। এই মাদরাসাভিত্তিক সমাজ গড়তে গিয়ে পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তা দেউলিয়া হয়েছে। মিয়ানমারে একই ঘটনা ঘটছে। তাদের সমাজ ছিনতাই হয়ে গেছে।

পাকিস্তান আমলে আমরা বড় হয়েছি। তখনও তো এতো সাম্প্রদায়িকতা, এতো সাম্প্রদায়িক মনোভাব, এতো ধর্ম ব্যবসা তো দেখিনি, যা দেখতে হচ্ছে এখন। মধ্যপ্রাচ্যে যারা জঙ্গি ইসলাম রফতানি করতো তারা দেখছে জঙ্গি ইসলাম দেশের জন্য মঙ্গলময় নয়। আমরা ভাবছি এই জামায়াত-বিএনপির ইসলাম আমাদের জন্য শ্রেয়?

সভায় রামেন্দু মজুমদার গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজনীতির সঙ্গে যদি সংস্কৃতির যোগসূত্র ঘটানো না যায়, রাজনীতিকদের যদি সংস্কৃতিমনা করা না যায়। তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। শেখ হাসিনা প্রথম আমলে এবং পরেও যোগসূত্র ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সব রাজনৈতিক নেতাই সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করেছেন। শেখ হাসিনার আমলে মডেল মসজিদ হয়, মডেল সংস্কৃতিকেন্দ্র কেন হয় না? শাহরিয়ার কবির ওই সভায় বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা পদ্মা সেতু নির্মাণে যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রক্ষা করার জন্য, তাঁর পিতার আদর্শকে রক্ষা করার জন্য, সেই সাহসের পরিচয় দিতে হবে। এ দাবি এখন সব সংস্কৃতিসেবীদের।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অর্থনীতির যে দোরগোড়ায় এনেছেন তা কেউ আনতে পারেননি। একটি নিঃস্ব দেশকে তিনি সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে যেখানে এনেছেন তা দেখে সবাই চমকিত। আর তিনি আমাদের মনোজগৎ বদলানোতো বিনিয়োগ করতে পারবেন না? এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদি সমাজের বা মানুষের মনোজগৎ এমন হয় তাহলে এই উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে না। সমাজ ছিনতাই হয়ে গেলে, আদর্শ ছিনতাই হয়ে যায়, রাষ্ট্রও ছিনতাই হয়ে যায়? আপাতত মনে হচ্ছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে? কিন্তু আদৌ কি নিয়ন্ত্রণে তা হলে কি এমন সব ঘটনা নিত্য ঘটনা ঘটে যা ঘটতো পাকিস্তানে? এবং এরকম ঘটনা ঘটতে ঘটতে পাকিস্তানকে বলতে হচ্ছে আমাদের একজন শেখ হাসিনা দাও। আর সেই শেখ হাসিনা কি চোখের সামনে সমাজ ছিনতাই হওয়া দেখবেন?

লেখক: ইতিহাসবিদ। বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস