আমরা চার বোন ও তিন ভাই। আমি শৈশবেই বাড়ি ছেড়েছি। বড় বোন আর আমি সবার ছোট; ঢাকায় থাকি। আম্মা আর বাকি পাঁচ ভাইবোন থাকে বরিশালে। বড় বোন ঢাকায় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমি তার কাছে থেকেই পড়াশোনা করেছি। সেই ক্লাস ফোর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স পর্যন্ত।
Advertisement
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলেই বরিশাল যাওয়া হতো। যেহেতু বড় আপা শিক্ষক আর আমি ছাত্র, তাই ছুটিও মিলে যেত একই সঙ্গে। বছরে একবার বা বড় জোর দুবার বরিশাল যেতাম। আমি ক্লাস নাইনে উঠে একাই বরিশাল যাওয়া শুরু করলাম। এর আগে আমি আর বড় আপা কখনো কখনো দুলাভাই-এই দু-তিনজন মিলেই বরিশাল যেতাম।
বরিশাল যাতায়াতের একটাই দুশ্চিন্তা। আরিচাঘাট। তখন আরিচায়ঘাট ছিল। ওপাড়ে দৌলতদিয়া, এপারে আরিচা। গাড়িগুলোও অধিকাংশই তখন লঞ্চে যাত্রী পার করতো। নৌপথ তখন অনেক দীর্ঘ হওয়ায় হয়তো লঞ্চে যাত্রী পারাপার করতো। কারণ, ফেরিতে সময় বেশি লাগতো। পাটুরিয়া ঘাট হওয়ার পর ফেরিতেই বেশি যাত্রী পারাপার শুরু হলো। তবে, এখনও কিছু লঞ্চ আছে।
যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল নির্ভয়ে নদী পার হতে পারা। নদীতে ঢেউ থাকলেই দুশ্চিন্তা ও ভয়ের শেষ নেই। আরিচা বা দৌলতদিয়া পৌঁছার আগে একটাই চিন্তা ছিল- নদীর কী অবস্থা। কোনো রকম পার হতে পারলেই আনন্দ। অন্তত এ যাত্রা পার হওয়া গেল-এটাই বড় পাওয়া। পদ্মা তখন প্রমত্তা পদ্মাই ছিল। সে রূপ আজ আর নেই। এখন বর্ষায় পানি বাড়লেই কেবল মাঝে মাঝে সেই রূপে ফিরে আসে পদ্মা। কিন্তু অতীতে ওটাই ছিল পদ্মার স্বাভাবিক মেজাজ।
Advertisement
আমি ছোট। কিন্তু লঞ্চে উঠলেই আমি বড় হয়ে যেতাম, বড় আপা হয়ে যেতো ছোট। খুব বেশি ভয় পেত। তখন বড় তাকে অভয় দেওয়াই ছিল আমার কাজ। সেই রাক্ষুসে ঢেউগুলো যখন লঞ্চটিকে উপরে উঠিয়ে নিচে থেকে সরে যেতো আর লঞ্চটি যখন ওপর থেকে নিচে পড়তো তখন আবার কোনোদিন দুই ভাইবোন মাথা তুলে দাঁড়াতো পারবো এমন ভাবনা ছিল না। এভাবে কোনো রকম বেশি ঢেউয়ের জায়গাটা পার হওয়ার পর মনে হতো জীবন ফিরে পেয়েছি। সেই আরিচা-দৌলতদিয়া আজ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়েছে। দূরত্ব কমেছে। কিন্তু যারা এ পথে এখনও যাতায়াত করেন, করবেন তারা জানেন মুসিবত কত প্রকার ও কী কী।
ঘাটকেন্দ্রিক অব্যবস্থাপনা ও ঝক্কি-ঝামেলার কথা বাদই দিলাম। স্বাভাবিকভাবে ফেরি পার হওয়া ও গন্তব্যে পৌঁছানো যে কত বড় চ্যালেঞ্জ তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। ঢাকা থেকে বরিশাল ওই পথে স্বাভাবিকভাবেই লাগে ৮ ঘণ্টা। যদি ঘাটে জ্যাম থাকে তখন ৮ ঘণ্টা ১৮ ঘণ্টায় ঠেকতে পারে। ফরিদপুর ৩ ঘণ্টার পথ। কিন্তু এখন স্বাভাবিকভাবেই সেখানে যেতে লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। ৮ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টা লাগলেও কারও কিছু বলার নেই, করার নেই।
পদ্মার এ পারে আমার জীবিকা আর ওপারে জীবন। মা ও ভাইবোন বরিশালে। আবার স্ত্রীর বাড়িও ফরিদপুরে। বছর দুয়েক সপ্তাহান্তে ফরিদপুর যেতে হতো। সেই ঝড়ের রাত আর মুষলধারে বৃষ্টির মাঝেই পদ্মা পাড়ি দেওয়া এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে।
আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। আপাও বুড়ো গেছে। এসবই বয়সের বিষয়। সময়ের হিসাব-নিকাশ। আম্মা এখনও বরিশালেই আছেন। আমি বরিশালে যাই প্রায়ই, আপাও যান বছরে একবার। কিন্তু একসঙ্গে আর যাওয়া হয় না। ব্যস্ততাই আজকের জীবন। সেই যে বড় বড় ঢেউয়ের সময় আপা আমার হাত চেপে ধরতেন, যতো বড় ঢেউ, ততো জোড়ে হাত চেপে ধরা- তা আমি আজও মিস করি, অনুভব করি।
Advertisement
এখন সেই ঢেউ নেই, লঞ্চও নেই। এমনকি আজ থেকে সেই পথও নেই। আজ থেকে আমরা ভিন্ন পথে বাড়ি যাবো। পাশাপাশি বসে। আনন্দে। হাত ধরাধরি করে। সঙ্গে দুলাভাই আর আমার স্ত্রীও। যাবো বরিশাল, যাবো ফরিদপুর। এসবই আমাদের স্বপ্ন। কিন্তু এ স্বপ্ন আজ আর অধরা নয়। আমাদের পেছনের সেই ভালোলাগা- মন্দলাগা, দুঃস্বপ্নের দিনগুলোকে পেছনে ফেলে আমরা বাড়ি যাবো নতুন পথে, নতুন আনন্দে। সময় সব কিছু বদলে দেয়। অতীত আমাদের বেদনা জাগাতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতের কাছে আমাদের বশ্যতা স্বীকার করতেই হবে। জীবন মানে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
আমি আর আমার বোন ও স্ত্রী দৌলতদিয়ার পথে ভ্রমণ করতে করতে আজও বেঁচে আছি। কিন্তু ওই আরিচা-পাটুরিয়ায় পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে যে কত মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে তার হিসাব নেই। কত লঞ্চ ডুবেছে, কত যাত্রী প্রাণ দিয়েছে সেসব কথা কেউ মনে রাখেনি। মনে রেখেছে শুধু বোন হারানো ভাই, ভাই হারানো বোন, আর সন্তান হারানো বাব-মা। আজ পদ্মায় সেতু হয়েছে। এতে অন্তত একটি অঞ্চলের মানুষ দুঃস্বপ্নের সেই পথ পেছনে ফেলে ভিন্ন পথে যাতায়াত করতে পারবে।
মাওয়াঘাট হয়ে খুব বেশি বরিশাল যাওয়া হয়নি আমার। কিন্তু যতোবার গেছে, ততোবারই ওই ঘাটের চরম অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম চোখে পড়েছে। পাটুরিয়াঘাটে অন্তত কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ছিল। মাওয়াঘাট নিয়মের বালাই ছিল না। কিন্তু তারপরও দক্ষিণের বহু মানুষ সময় ও খরচ বাঁচাতে মাওয়া রুট দিয়ে ঢাকা আসা-যাওয়া করতো। কিন্তু এক সময় শুধু আরিচার পথেই ঢাকা বরিশাল বা ঢাকা থেকে দক্ষিণের যোগাযোগ হতো। কিন্তু দক্ষিণের সঙ্গে যোগাযোগের এ বিকল্প পথটিই আজ আসল পথ, মূল সড়ক যোগাযোগের পথ। দক্ষিণের ২১টি জেলার মানুষ আজ থেকে পাটুরিয়ায় পদ্মা পাড়ি না দিয়ে মাওয়া-ভাঙ্গা হয়ে সোজা চলে যাবেন বরিশাল, গোপালগঞ্জ বা অন্য কোথাও।
শীত-গ্রীষ্ম সব মৌসুমেই মানুষ অনেক দুর্ভোগ সহ্য করে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতো। বর্ষা মৌসুমে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে মানুষ জীবন হাতে করে কোনো রকম নদী পার হতো। কত যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার হিসাবও নেই। ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট পিনাকি-৬ লঞ্চডুবিতে কয়েকশ’ যাত্রীর সলিল সমাধি হয়েছে। এরকম ছোটবড় দুর্ঘটনা এই নদীতে প্রতি বছরই হয়েছে। তারপরও মানুষ নাড়ির টানে বাড়ির টানে বাড়ি গেছে। রাজধানীর এতো কাছে থেকেও দক্ষিণ ছিল ঢাকার সবচেয়ে দূরে। আজ তা একেবারেই কাছে।
বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ায় ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের দূরত্ব ঘুঁচেছে। আগে উত্তরবঙ্গেও ওই আরিচা হয়েই যেতে হতো। আরিচা আর নগরবাড়ির সেই দিনগুলো আজ ইতিহাস। উত্তর অনেক আগেই দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাকি ছিল দক্ষিণ। দক্ষিণ ঢাকার এতো কাছে থেকেও ছিল বহু দূর। আজ সে দূরত্ব ঘুঁচলো। আজ দখিনের দুয়ার খুললো।
আজ থেকে তিন দশক আগে যখন মোবাইল ছিল না তখন বাড়ি থেকে আসা মানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। চিঠিই ছিল তখন যোগাযোগের মাধ্যম। বাড়ি থেকে ঢাকা ফেরার কদিন পর চিঠি আসতো আম্মার কাছ থেকে। আম্মা বড় আপার কাছে চিঠি দিতো-আশা করি ঠিকভাবেই ফিরেছো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই চিঠিতে শেষের দিকে আমার নাম বা আমার কথা বলা আছে কি না আমি শুধু স্টোই খুঁজতাম। পেতামও সব সময়। সেই চিঠিগুলো আজ আর নেই। মাঝে মাঝে মনের কোনে শুধু উঁকি দেয়। চিঠি দেওয়ার সেই দিনগুলোও আজ আর নেই। প্রয়োজনও নেই। টেলিযোগাযোগ সেই দূরত্ব ঘুঁচিয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনে দুঃস্বপ্নের সেই সড়ক ও নৌপথের বিভীষিকাময় দিনগুলোর অবসান হলো।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণের ২১টি জেলা আরও কাছে এলো। কিন্তু এখনও কয়েকটি জেলা-রাজবাড়ি, ফরিদপুরের একাংশ ও কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি জেলাকে সেই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার পদ্মা পাড়ি দিতে হবে। এখানে একটি সেতু হলে পুরো দেশই নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের আওতায় চলে আসবে। আমরা শুধু স্বপ্ন দেখতে পারি। সুযোগ্য নেতৃত্বই পারে মানুষের সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে। পদ্মা সেতু তারই প্রমাণ।
এক সময় বাড়িতে যাওয়া ছিল এক স্বপ্ন। বাড়ি যাওয়া আকাঙিক্ষত হলেও যাত্রাটি ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। গ্রামীণফোনের সেই বিজ্ঞাপনটি আজও সবার স্মৃতিকে নাড়া দেয়। এদেশের মানুষ দূরে থেকেও কাছে থাকতে চায়, পাশে থাকতে চায়। কাছে থাকার এ আকুলতা আমাদের চিরন্তন। পদ্মা এখন সবাইকে আরও কাছে নিয়ে এলো। পদ্মা নিয়ে নানা মানুষের নানা অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, আবেগ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় পদ্মা সেতু আজ বাস্তবতা। এটি দেশের একটি মাইলফলক। এটি শুধু একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সোপানই নয়। এর মাধ্যমে একটি দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ জনগণ সরাসরি উপকৃত হবে। দেশের বিশাল এক ভূখণ্ড আজ থেকে এক অবিচ্ছিন্ন জনপদে রূপান্তরিত হলো। এই সেতু আমাদের দীর্ঘ দিনের দুঃখ-বেদনার অবসান ঘটালো। এই সেতু শুধু একটি জনপদ নয়, পুরো দেশের জন্য কল্যাণকর হোক- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস