অবসরে যাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের রায় লেখা অসাংবিধানিক বলে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। আইনজীবী ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের প্রায় সবাই একসুরে বলছেন অবসরে যাওয়ার পর কোনো বিচারকের রায় লেখা অসাংবিধানিক হতে পারে না। এরপরেও প্রধান বিচারপতি বলেছেন অবসরে যাওয়ার পর তিনি আর কোনো বিচারপতিকে রায় লিখতে দিবেন না। এরই মধ্যে বিষয়টি লুফে নেয় বিএনপি। বিতর্ক শুরু হয় সংসদেও। শেষ পর্যন্ত আইনমন্ত্রীও বলেছেন, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা যাবে না। আইনমন্ত্রীও প্রধান বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষণ করলেন। কোনো কোনো সহকর্মীর রায় লিখতে দেরিতে উষ্মা প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, “কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থি।” নিষ্পত্তি হওয়া মামলার রায় ‘যৌক্তিক’ সময়ে লেখা শেষ করতে সহকর্মীদের রাজি করাতে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন বিচারপতি সিনহা। অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি বলার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না। “আদালতের নথি সরকারি দলিল। একজন বিচারপতি অবসরগ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের নিকট সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে দস্তখত করার অধিকার হারান।” বিচারকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন “আশা করি বিচারকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এমন বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকবেন।” আমরা সাধারণ নাগরিক বা বিচারপ্রার্থী হিসেবে যদি প্রধান বিচারপতির কথাগুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে আমার বিশ্বাস এমন একজনও পাওয়া যাবে না যিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত হবেন না। কারণ যে কোনো বিচারপ্রার্থীই চাইবেন তার মামলার রায় আদালত যেদিন ঘোষণা করবে সেদিনই যেন পুরো রায়টা তিনি হাতে পান। সেদিক বিবেচনা করলে প্রধান বিচারপতি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনের কথাই বলছেন। ধরা যাক কোনো একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্র বিদেশ যেতে বিধিনিষেধ জারি করেছে। ওই ব্যক্তি আদালতে আইনী লড়াই শেষে মামলায় জয়ী হলেন এবং রায় পেলেন এ সংক্রান্ত বিধি নিষেধ অবৈধ। কিন্তু বিচারক ওই রায় সম্পূর্ণ করে সই করেন নি। তখন ওই ব্যক্তির বিদেশ যেতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু হাতে সম্পূর্ণ রায় না থাকায় ওই ব্যক্তিকে রাষ্ট্র বিদেশ যেতে আটকে দিল। আর যখন তিনি পূর্ণ রায় হাতে পেলেন তখন তার বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। এই সাদামাটা উদাহরণটি প্রমাণ করে অনেক সময় পূর্ণাঙ্গ রায় না পেলে মূল রায়ের কার্যকারিতাও থাকে না। প্রধান বিচারপতি সেই চিন্তা থেকেই একথা বলেছেন। আমরা যদি তার কথার বা শব্দের আক্ষরিক ব্যাখ্যায় না গিয়ে চেতনাগত দিকটি দেখি তাহলে এত বিতর্কের প্রয়োজন পড়ে না। সংবিধানে লেখা নেই বলতে বলতে গলা ফাটিয়ে কার ফায়দা হবে? সংবিধানের কোথাও এ কথাওতো লেখা নেই বিচারপতিরা তাদের ইচ্ছেমত যখন খুশি তখন রায় লিখবেন। আমরাতো এমনও দেখেছি, রায় দেয়ার প্রায় ৪ বছর পর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা হয়েছে। তাহলে বিচারপ্রার্থী কী ন্যায় বিচার পেলেন? এখন চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দিয়ে কোনো বিচারক যদি অবসরে চলে যান এবং তার পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে যদি ৪ বছর সময় নেন তাহলে ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার বা আসামীর আপিল করতেও ৪ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আবার আসামীর আপিল খারিজ করে দিয়ে যদি কোনো বিচারপতি অবসরে চলে যান এবং তখনও কয়েক বছর সময় নেন তখন এদেশের মানুষ সেটা কিভাবে নেবে তাও ভেবে দেখা উচিত। এসবই অনুমানভিত্তিক কথা হলেও বেশ কিছু মামলার রায় নিয়ে এই দীর্ঘসূত্রতা আমরা দেখেছি। এই দীর্ঘসূত্রতার পেছনে কিছু বাস্তব কারণও থাকে। একজন বিচারপতি কোনো মামলায় কয়েকমাস শুনানী করে তার কর্মজীবনের শেষ দিনে যদি কোনো রায় দেন তখন অবসরে গিয়ে রায় লেখা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। সেক্ষেত্রে ওই বিচারপতির করণীয় কী হতে পারে? মূলত এই জায়গাটিতেই বিপত্তি। এটা ঠিক যে এ বিষয়ে কোনো আইন কানুন নেই। প্রচলিত রীতি-নীতি হলো হাইকোর্ট বিভাগের রুলে বলা বলা আছে, বিচারকদের এজলাসে বসেই রায় দেওয়ার কথা। আর আপিল বিভাগের বিচারপতিরা অবসরে যাওয়ার পর আর লিখতে পারবেন না- এমন কোনো কথা রুলস এ লেখা নেই। তবে শত শত মামলা যদি কোনো বিচারকের ঘাড়ে পড়ে তাহলে তিনি কীইবা করতে পারেন। চাইলেও তো অবসরে যাওয়ার আগে লেখে শেষ করতে পারবেন না। জনগণও নিশ্চয়ই বছরের পর বছর রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। সেক্ষেত্রে হয়তো অবসরে যাওয়ার কয়েকমাস আগে থেকেই তার মামলার শুনানি করা বন্ধ রেখে রায় লেখার কাজ শুরু করতে হবে। তাই এ বিষয়টির একটি সুরাহা দরকার।আমরা সাধারণ নাগরিকরা মনে করি বিচারকদের আনলিমিটেড সময় দেওয়া উচিত নয়। রায় লেখা নিয়ে বিলম্ব সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির উদ্বেগকে আমলে নিয়ে একটা নির্দেশনা তৈরি করা যেতেই পারে। যাতে বলা থাকবে রায় কতোদিনের মধ্যে লিখতে হবে। তাতে মামলাজটও কমবে এবং জনগণও উপকৃত হবে। এইচআর/পিআর
Advertisement