বিশেষ প্রতিবেদন

কিবরিয়া হত্যার ১১ বছর : বিচার নিয়ে অনিশ্চয়তা

আজ ২৭ জানুয়ারি। ২০০৫ সালের এ দিনে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভা শেষে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, তার ভাতিজা শিল্পপতি শাহ মঞ্জুর হুদা ও স্থানীয় তিনজন আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন ৪৩ জন।পরে ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু বিচার নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। বার বার তদন্ত আর আইনি জটিলতায় এ বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। হত্যা মামলাটি বিচার প্রক্রিয়ায় গেলেও নির্ধারিত সময়ে তা শেষ না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কিশোর কুমার করের আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটির কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত আছে।বিস্ফোরক মামলাটি বর্তমানে হবিগঞ্জ দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতে বিচারিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ অবস্থায় দিনে দিনে স্থানীয় সাধারণ মানুষ, নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতদের মাঝে বিচার নিয়ে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় বের হওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি। তাকে প্রথমে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় নেয়ার পথে তিনি মারা যান।হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন তার ভাতিজা শিল্পপতি শাহ মঞ্জুর হুদা, আওয়ামী লীগ কর্মী আদ্যপাশা গ্রামের আবুল হোসেন, বনগাঁও গ্রামের সিদ্দিক আলী ও আব্দুর রহিম। এতে আহত হন আরও ৪৩ জন। এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল মজিদ খান এমপি বাদি হয়ে সদর থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন।হত্যা মামলাটি সিআইডিতে ন্যস্ত হলে তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান। তিনি ওই বছরের ১৯ মার্চ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বিস্ফোরক মামলাটি তদন্ত শেষে তৎকালীন সদর থানার ওসি এমএস জামান একই আদলে আদালতে ২০ এপ্রিল চার্জশিট দেন।উভয় চার্জশিটে ১০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এবং জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি একেএম আব্দুল কাইয়ুম, শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদ জেলা সভাপতি সাহেদ আলী, লস্করপুর ইউনিয়ন সভাপতি জয়নাল আবেদীন মোমিন, বিএনপি লস্করপুর ইউনিয়ন সভাপতি জমির আলী, বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জালাল, আয়াত আলী, তাজুল ইসলাম, কাজল মিয়া, মহিবুর রহমান ও জেলা ছাত্রদলের তৎকালীন সহ-দফতর সম্পাদক সেলিম আহমদ।এর মধ্যে মহিবুর রহমান ও কাজল মিয়া ছাড়া অপর আটজন বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময় ওই আটজন হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করেন। বাদিপক্ষের কয়েক দফা নারাজির প্রেক্ষিতে মামলাটির অধিকতর তদন্ত হয়। সর্বশেষ তদন্ত করেন সিলেট সিআইডির সিনিয়র এএসপি মেহেরুন্নেছা পারুল।২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি আদালতে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেন। আর ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট দেন বিস্ফোরক মামলার চার্জশিট। উভয় চার্জশিটেই সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ ও খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়।এর মধ্যে মো. আহসান উল্লাহ কাজল মারা যান এবং ইউসুফ বিন শরীফ ও আবু বক্কর ওরফে আব্দুল করিমের ঠিকানা সঠিক না পাওয়ায় তাদেরকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করা হয়। বাকি ৩২ জনের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, সিলেটের সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জি কে গউছসহ ১৪ জন দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক আছেন। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, মাওলানা তাজ উদ্দিন, মুফতি শফিকুর রহমানসহ ১০ জন পলাতক ও আটজন জামিনে রয়েছেন।হত্যা মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়ে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা হলে সেখানে কয়েকজনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মাঝে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। এ অবস্থায় বিধান অনুযায়ী মামলাটি হবিগঞ্জ আদালতে চলে যাওয়ার কথা। এরই মাঝে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে তা বর্তমানে স্থগিত আছে।অপরদিকে বিস্ফোরক মামলাটি হবিগঞ্জ দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন বিচারের জন্য এ মামলাটিও প্রস্তুত হবে। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখতে চান নিহতদের স্বজন ও আহতরা। সব জটিলতার অবসান ঘটিয়ে চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচার অনতিবিলম্বে সম্পন্ন করা হবে বলে আশা করছেন হবিগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ।এ বিষয়ে মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম আকবর হোসেন জিতু জাগো নিউজকে বলেন, হত্যা মামলায় মোট সাক্ষী রয়েছেন ১৭১ জন। এ মামলা সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মাত্র ১৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এর মাঝেই মামলার বিচারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এটি বর্তমানে ওই আদালতে স্থগিত অবস্থায় আছে। মামলাটি সরকারের পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। একই ঘটনায় দায়ের করা বিস্ফোরক মামলাটি বর্তমানে হবিগঞ্জে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ ও দায়রা জজ আদালতে চলমান আছে। ইতিমধ্যে মামলাটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেয়া হয়েছে। এখন বিচারের জন্য প্রস্তুত হলে এ মামলাটিও সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা হবে।সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/বিএ

Advertisement