দেশজুড়ে

বেনাপোল স্থলবন্দরের দৃশ্য পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু

বেনাপোল স্থলবন্দরের জন্য সৌভাগ্যের ডালি সাজিয়ে হাজির হচ্ছে পদ্মা সেতু। সেতু উদ্বোধনের পরই চাপ বাড়তে থাকবে এ বন্দরে। তবে সেই চাপ সামাল দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আমদানি-রপ্তানিকারকরা। দীর্ঘদিনের অচলায়তন নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি বন্দর কর্তৃপক্ষের।

Advertisement

তারা বলছে, বেনাপোলকে আন্তর্জাতিক মানের স্থলবন্দর তৈরিতে হাতে নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। এরই মধ্যে ৩৫৬ কোটি টাকার তিন প্রকল্পের কাজ চলছে। যা শেষ হতে আরও দু’বছর লাগবে। ফলে পাল্টে যাবে বেনাপোল বন্দরের দৃশ্যপট। অবসান হবে সব সমস্যার। সুফল ভোগ করবেন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত বন্দর ব্যবহারকারীরা।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু পদ্মা সেতুকে সৌভাগ্য হিসেবে দাবি করলেও অভিযোগ করেছেন, বেনাপোল বন্দরে পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে হয়তো সামনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। জায়গা সংকটের কারণে আমদানিকৃত পণ্য লোড-আনলোড করতে সমস্যা হয়। রয়েছে উপকরণেরও অভাব। বিশেষ করে ক্রেন/ফর্কলিফটের যথেষ্ট অভাব আছে।

আমদানিকারক কপোতাক্ষ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মশিয়ার রহমানের অভিযোগ আরও গুরুতর। তার দাবি, যারা এ বন্দর দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা করছেন, তারা বর্তমানে খুবই অবহেলিত। বর্তমানে ভারত থেকে এক গাড়ি পণ্য বেনাপোল বন্দরে আসতে এক মাসেরও বেশি সময় লাগছে। এক কনসাইনমেন্ট পণ্য ভারত থেকে বেনাপোল দিয়ে আমদানি করায় ওপারে আমদানিকারকদের একমাসে অতিরিক্ত গুণতে হয় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার রুপি। বাড়তি এ খরচের চাপ পরবর্তীতে পড়ে ভোক্তার কাঁধে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে এক গাড়ি পণ্য আনলোড হতে সময় লাগে সাত থেকে ১০ দিন। ট্রাকগুলো এক শেড থেকে আরেক শেডে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় যেন এগুলো বেওয়ারিশ। এ শেড ইনচার্জ বলে জায়গা নেই, ওই শেড ইনচার্জও বলে জায়গা নেই। ফলে দীর্ঘদিন ট্রাকে পণ্য থাকার কারণে মালের গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে।

মশিয়ার রহমান মনে করেন, দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে পদ্মা সেতুর প্রভাবে যে চাপ বেনাপোল বন্দরে পড়বে তা মিটিয়ে পরিপূর্ণ সুফল ঘরে তোলা দুরূহ হয়ে উঠবে।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, সোনামসজিদ বা বাংলাবন্ধায় যেসব পণ্য চালান আসে সেগুলোকে অনেক ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। অন্যদিকে, বেনাপোল হলো ভারতের কলকাতায় প্রবেশদ্বার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এ কারণে ব্যবসায়ীরা চাইবেন বেনাপোল দিয়ে অধিক পণ্য পাঠাতে। কিন্তু বেনাপোলে তো অবকাঠামো বলতে কিছু নেই। এর আমূল উন্নতি ছাড়া পদ্মা সেতুর সুফল মিলবে না।

বেনাপোল আমদানি ও রপ্তানিকারক সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক আনু জাগো নিউজকে বলেন, পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেনাপোল বন্দরে ঘটেনি। প্রতিদিন এক হাজার ট্রাকের ভারত থেকে পণ্য আমদানির সুযোগ থাকলেও স্থান সংকটের কারণে মাত্র ২০০-৩০০ ট্রাক আসে। পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করতে হয়, তাহলে বন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে। যানজট দূর করতে হবে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বন্দরে ক্রেন ও ফর্কলিপট বাড়াতে হবে। জনবল দ্বিগুণ করতে হবে।

Advertisement

বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ কিছুটা সঠিক বলে মনে করেন বেনাপোল কাস্টম হাউজের কমিশনার আজিজুর রহমানও। তিনি বলেন, বন্দরের কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। বন্দরে এখন সক্ষমতা আছে বছরে ৪৫ হাজার টন ধারণক্ষমতা। কিন্তু বছরে এক লাখ টনেরও বেশি পণ্য লোড-আনলোড হচ্ছে। এখানে নতুন নতুন কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ দু-তিনটা প্রকল্প দিয়ে সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই শেড বাড়াতে হবে, এটার বিকল্প নেই। আমদানি-রপ্তানিকারকদের দাবিকে মাথায় রেখে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এটাকে সম্প্রসারিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

বন্দরের সমস্যার পাশাপাশি কাস্টমসেরও কিছু প্রস্তুতির কথা জানান কাস্টম কমিশনার। তিনি বলেন, ডিম্যান্ড ক্রিয়েট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গ কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।

এদিকে, পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের সক্ষমতা বাড়ার কাজও এগিয়ে চলেছে বলে দাবি করেছেন বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার। তিনি বলেন, বন্দরে ৩৫৬ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। এ প্রকল্প শেষ হলেই বন্দরের স্থান সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের নিরাপত্তা বাড়বে এবং পণ্যের গুণগতমানও অক্ষুণ্ন থাকবে।

মামুন কবীর তরফদার আরও বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা বাড়ায় পরিবহনের চাহিদাও বাড়বে। এটি মাথায় রেখে ২৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পরে আরও সাড়ে ১৬ একর জায়গা অধিগ্রহণ হয়েছে। আরও ১০০ একর জমি অধিগ্রহণ হবে।

তিনি বলেন, ২৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জিরো পয়েন্টের পাশে ২৫ একর জমিতে নির্মাণ হচ্ছে কার্গো ভেইকেল টার্মিনাল। এ কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হবে। এ টার্মিনালে একসঙ্গে ৩০০ পণ্যবাহী ট্রাক অবস্থান নিতে পারবে। ভারত থেকে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকগুলোই এ টার্মিনালে অবস্থান করবে, তারা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না। এতে একদিকে যেমন দ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্য আনলোড করা যাবে তেমনি যানজট দূর হবে।

বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক বলেন, ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে ১৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন বাউন্ডারি ওয়াল। এ ওয়ালের ভেতরে যে কেউ ইচ্ছা করলে প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ, অটোমেশন সিস্টেমের আওতায় এর এক্সেস কন্ট্রোল থাকবে কর্তৃপক্ষের হাতে। এ ওয়ালের দৈর্ঘ্য সাড়ে পাঁচ হাজার রানিং মিটার। বন্দরের ভেতরে অনধিকার প্রবেশ ও চুরি রোধসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্প শেষ হলেই পাল্টে যাবে বন্দরের সার্বিক চিত্র।

এসজে/এএইচ/এএসএম