শেখ হাসিনা, আপনার বেদনা আমি জানি।/আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি।/বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে/আপনি পা রেখেছেন মাত্র।/আপনার পথে পথে পাথর ছড়ানো।/পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরুপথ।
Advertisement
কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘পথে পথে পাথর’ কবিতায় অভিব্যক্ত এই কথাগুলোর সত্যতা রয়েছে শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যাচেষ্টার ঘটনায়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। যা বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার একটি। তবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনায় চ্যালেঞ্জসমূহকে সামনে এনেছে; স্পষ্টভাবে চেনা গেছে তাঁর ও এ দেশের শত্রুদের।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিএনপি’র আমলে ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদীতে শেখ হাসিনা হত্যা চেষ্টা মামলার রায়ে ৯ জনের ফাঁসির দণ্ড ঘোষিত হয়েছে। উপরন্তু ২৫ জনের যাবজ্জীবন, ১৩ জনের ১০ বছর কারাদ- হয়েছে। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার মতোই ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সন্ত্রাসীরা। ওই হামলায়ও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো পাবনার ঈশ্বরদীতে ট্রেন বহরে হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। কিন্তু অপরাধীরা পার পায়নি। ২৫ বছর পর হলেও ১৯৯৪ সালের সবচেয়ে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর এই হামলা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আর যারা সেই চেষ্টা করেছিল তাদের কাউকে হত্যার চেষ্টা করা হয়নি। এখানেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির পার্থক্য। ২১ বার হত্যা চেষ্টার মধ্যে ১৪টি ঘটনায় মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কেবল চারটি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। এসব হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬০ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হওয়ার হিসাব আছে; আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এসব ঘটনার মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো বিচার পায়নি এখনো।
Advertisement
শেখ হাসিনাকে যতবার হত্যাচেষ্টা করা হয় তার অনেক ঘটনায় মামলাও হয়নি। এমনকি হামলার পর উল্টো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার নজিরও আছে। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছিল, তার প্রতিটিরই বিচারে সময় লেগেছে এক যুগের বেশি। কোনো কোনোটির ২০ থেকে ২৫ বছর। আবার বিচারিক আদালতে রায় এলেও উচ্চ আদালতে একটিরও মীমাংসা হয়নি এখনো। ১৯৮৯ সালে ধানমন্ডিতে হত্যা চেষ্টার রায় আসে ২০১৭ সালে। সময় লাগে ২৮ বছর। ১৯৯৪ সালে পাবনা ঈশ্বরদীতে হত্যা চেষ্টার মামলায় রায় এলো চলতি বছর; সময় লেগেছে ২৫ বছর।
২০০০ সালে গোপালগঞ্জে হত্যা চেষ্টার মামলায় রায় আসে ২০১৭ সালে। সময় গেছে ১৬ বছর। তবে চূড়ান্ত রায় আসে ২০২১ সালের ২৩ মার্চ। এদিন ওই মামলায় ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের মাঠে ২০০০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। ওই মাঠেই পরদিন শেখ হাসিনার সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। ওই ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলাটি দায়ের করেন। এরপর ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর সিআইডির সাবেক এএসপি আব্দুল কাহার আকন্দ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
এ ঘটনায় হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-২ এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় হত্যা চেষ্টার রায় আসে ২০১৮ সালে। সময় লেগেছে ১৪ বছর।
Advertisement
২.জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা থেকে বেঁচে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে স্পর্শ করতে না পারলেও বুলেট তাঁর পিছু ছাড়েনি। দেশে ফেরার পর পিতার মতো তাঁকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে দুটি (১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট), ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারটি (১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, ৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ’৯৫ সালের ৭ মার্চ, ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ),
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারটি (২০০০ সালের ২২ জুলাই, ২০০১ সালের ৩০ মে, ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর), ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে চারটি (২০০২ সালের ৪ মার্চ, ২০০২ সালের ২৬ আগস্ট, ২০০৪ সালে ২ এপ্রিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট), সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি (২০০৭ সালে ১/১১ পরবর্তী সময় কারাবন্দি থাকা অবস্থায় খাবারে বিষ প্রয়োগ করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়) এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে চারটি হত্যা চেষ্টার কথা জানা যায় (২০১১ সালে শ্রীলংকার একটি সন্ত্রাসবাদী দলের প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়)।
বঙ্গবন্ধুর খুনি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি শরিফুল হক ডালিম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করে। ২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গিদের মাধ্যমে মানববোমায় তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে।
২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে কারওয়ানবাজার এলাকায় তাঁর গাড়িবহরে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা। তবে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে।
গোপালগঞ্জে ২০ জুলাই ২০০০, খুলনায় ৩০ মে ২০০১, সিলেটে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০১ এবং ঢাকায় ২১ আগস্ট ২০০৪ সালের চেষ্টা ছিল অন্যতম। আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হয় মুফতি হান্নান। একপর্যায়ে সে এদেশে ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থার সূচনাকারী হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতায় পরিণত হয়। তার নেতৃত্বে এ দেশে হুজি-বি প্রথম বোমা হামলা চালায় ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে।
এরপর সাত বছরে অন্তত ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায় তারা। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০১, আহত হয়েছেন ৬০৯ জন। উগ্রপন্থীরা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনা তথা এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নেতৃত্বকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ৫২ আসামির মধ্যে ৩৩ জন কারাগারে; পলাতক ১২ জনের মধ্যে তারেক রহমান লন্ডনে, হারিছ চৌধুরী আসামে, কেউ কেউ আছেন কানাডা, ব্যাংকক, আমেরিকায়; হুজির শীর্ষ নেতারা পাকিস্তানে পালিয়েছে।
৩.এসব হামলা-মামলা ও হত্যা-প্রচেষ্টার সংকটময় পরিস্থিতির মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। পদ্মা সেতু তাঁর জীবন মন্থন করে জেগে ওঠা অমৃত। আসলে শেখ হাসিনা তো একটি অনুভূতির নাম, তিনি দুঃখী মানুষের ভরসা। মানুষের নেতা দয়ার সাগর এই শেখ হাসিনা অসহায় মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আর্দ্র স্মৃতির আঙিনা, কখনো বা আশার আলো। পথহারাদের পথের দিশা, গৃহহীনের আশ্রয়স্থল। তিনি নৈতিকভাবে দৃঢ়চিত্ত ও বিতর্কমুক্ত। মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে রাজনীতিতে তিনি দেশের আস্থাবান নেতায় পরিণত হয়েছেন। তবে দেশপ্রেমের রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেছেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে।
জনদরদিও হয়েছেন পিতার দেখানো পথে হেঁটে। এজন্য পদ্মা সেতুজনিত ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের সংকট তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম। সাহস, ধৈর্য আর স্মরণশক্তির অনন্য অধিকারী এই রাষ্ট্রনায়ক নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও নিরপেক্ষ। কখনো কখনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তিনি নির্বিকার। সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত এই নেতা বাস্তববাদী। কিন্তু সাহিত্যের শিক্ষার্থী হওয়ায় তাঁর রয়েছে আলাদা পর্যবেক্ষণ। মানুষ ও প্রকৃতি দেখার ক্ষেত্রে তিনি আবেগময় বাক্য বিন্যস্ত করেছেন।
রাজনৈতিক জীবনে বিপদে পতিত নেতাকর্মীকে ফেলে সরে যাননি বরং ষড়যন্ত্র বা আঘাতের পরও কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি। ২১ বার তাঁর জীবননাশের চেষ্টা হয় আর এক-এগারোর সময় ঝুঁকি ও হুমকি উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন ২০০৭ সালে। সাধারণ মানুষকে তিনি যেমন ভালোবেসেছেন তেমনি এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীও তাঁর জন্য স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়েছে। গরিব রিকশাচালক হাসমত আলী তার সর্বস্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জন্য জমি কিনে দিয়েছেন।
২০১১ সালে তার স্ত্রী রমিজা খাতুনকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে সেখানে একটি বাড়ি করে দেন প্রধানমন্ত্রী। নেত্রীর নির্জন কারাবাসের সময় তাঁকে টেলিভিশন দেখার সুযোগ করে দিতে সবকিছু বিক্রি করে একটা সাদাকালো টিভি সেট নিয়ে বিশেষ আদালতের ফটকে এসেছিলেন নাম না জানা এক আওয়ামী লীগ কর্মী।
২০১২ সালের ৩ জুলাই হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা পঞ্চাশ পয়সা করে জমানো অর্থ দিয়ে একজোড়া সোনার বালা উপহার নিয়ে আসে গণভবনে তাদের প্রিয় শেখ হাসিনার জন্য। মানুষটি গণমানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ বলেই এভাবে সাধারণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন বারবার।
দূরদর্শী ও অক্লান্ত শ্রম দেওয়ার বিষয়ে নিবেদিত শেখ হাসিনা সমগ্র দেশ নিয়েই চিন্তা করেন। এজন্যই পুনর্বাসিত মানুষের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ। এমনকি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ছাত্রী হোস্টেল হলে নারীশিক্ষার প্রসার হবে সেই অসাধারণ ব্যতিক্রমী নির্দেশনা দিয়েছেন একমাত্র তিনিই। উপবৃত্তির টাকা মোবাইলযোগে সন্তানের মায়েদের কাছে প্রেরণ তাঁর আরেক অনন্য উদ্ভাবন।
অন্যদিকে বিপুল জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার পরিকল্পনা করার চিন্তা তিনিই করেছেন। পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণ বা জঙ্গি দমনের মতো অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। এমনকি তাঁর বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বানও আজ নন্দিত। পার্বত্য শান্তিচুক্তি, গঙ্গার পানিচুক্তি, সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি, দীর্ঘদিনের স্থল সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার অবসান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নেওয়ার ক্যারিশম্যাটিক নেত্রী হলেন শেখ হাসিনা। তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারায় যুক্ত রাখতে কওমি ডিগ্রিকে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী বলে যেকোনো মৌলবাদী উস্কানি কঠোর হাতে দমন করেছেন।
বাংলাদেশের বাস্তবতা মাথায় রেখে তিনি যেমন ডেল্টা-প্ল্যান বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছেন তেমনি তাঁর দশটি উদ্যোগ দেশের মধ্যে উন্নয়নের অনুঘটকে পরিণত হয়েছে। এক. একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, দুই. ডিজিটাল বাংলাদেশ, তিন. নারীর ক্ষমতায়ন, চার. কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ, পাঁচ. সবার জন্য বিদ্যুৎ, ছয়. আশ্রয়ণ প্রকল্প, সাত. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, আট. শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম, নয়. বিনিয়োগ বিকাশ এবং দশ. পরিবেশ সুরক্ষা।
করোনা মহামারির আগে গণভবনে আগত অনাথ শিশুদের মুখে খাদ্য তুলে আপ্যায়ন করা, দর্শনার্থী বয়োবৃদ্ধদের আসা-যাওয়ার সময় বিশেষ খেয়াল রাখা, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহতদের পাশে থাকা অনন্য স্মৃতি। কিংবা বিডিআর কর্তৃক সেনাকর্মকর্তাদের হত্যার পর সেই দুঃখী পরিবারগুলোকে আগলে রাখা এবং সর্বোপরি মিয়ানমার থেকে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া তাঁর মানবিকতার অনন্য উদাহরণ। সভা ও আলোচনায় তাঁর বক্তৃতাগুলো গভীর সংবেদনশীল ও মমতায় উদ্ভাসিত। হাওর অঞ্চল, পার্বত্য জেলা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার অথবা প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে চলেছেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিকতার দৃষ্টান্ত আরো আছে। মিয়ানমার থেকে জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের পক্ষে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলেছেন। ঢাকার নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডে নিহত পিতামাতার এতিম সন্তানদের অভিভাবক হয়েছেন। মায়ের দায়িত্ব নিয়ে তিন কন্যার বিয়ে দিয়ে সংসার জীবনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। স্কুল শিশু একটি ব্রিজের অভাবে স্কুলে যাওয়ার বিপদজনক পথের কথা জানিয়ে চিঠি লেখায় তিনি তার পত্রের জবাব দিয়ে ব্রিজ তৈরি করে দিয়েছেন।
লালমনিরহাটের দরিদ্র কৃষক ছয়ফুল গত ২৫ বছর ধরে গরুর অভাবে নিজেই টেনে চলেছেন ঘানি। আর এ কাজে তার একমাত্র সহযোগিতা স্ত্রী মোর্শেদা বেগম। হতদরিদ্র এ দম্পতি প্রতিদিন ঘানি টেনে যে তেল পায় তা বিক্রি করে কোনোমতে চলত তাদের সংসার। সংবাদপত্রে প্রকাশের পর বিষয়টি নজরে আসে শেখ হাসিনার। এরপরেই বদলে যায় দরিদ্র কৃষকের কষ্টের জীবন।
তিনি এ দরিদ্র কৃষকের কষ্ট লাঘবে উপহার দিলেন একটি গরু এবং গরুটির রক্ষণাবেক্ষণ ও ঘানি মেরামতের জন্য আরো ১০ হাজার টাকা। মানবিকতায় ও মহানুভবতায় অনন্য শেখ হাসিনা। যেখানেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মানুষ কষ্টে থাকে সেখানেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার পাশে এসে দাঁড়ান। তিনিই এখন বাংলার গরিব দুঃখী মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল।
৪.মানবিক পদ্মা সেতু পদ্মা নদীর উপর একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু যা নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। ২০২২ সালে উদ্বোধিত সর্ববৃহৎ সেতু এবং সড়ক চলাচলের জন্য প্রথম নির্দিষ্ট নদী পারাপার অবকাঠামো। এটি লৌহজং, মুন্সীগঞ্জকে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের সাথে এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করেছে।
প্রকল্পটি তিনটি জেলাকে সংযুক্ত করেছে- মুন্সিগঞ্জ (মাওয়া পয়েন্ট/উত্তর তীর), শরীয়তপুর এবং মাদারীপুর (জাঞ্জিরা/দক্ষিণ তীর)। অধিগ্রহণ করা প্রয়োজনীয় জমির মোট এলাকা হল প্রায় ১১৭২ হেক্টর। দ্বি-স্তরের ব্রিজটি উপরের স্তরে একটি চার লেনের মহাসড়ক এবং নিচের স্তরে একটি একক ট্র্যাক রেলপথ বহন করছে। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার চওড়া সেতু, ১৫.১ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড, টোল প্লাজা এবং পরিষেবা এলাকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত শুরু করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ২০১১ সালে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর প্রকল্পটির অগ্রগতি থমকে দাঁড়ায়। কারণ ২০১২ সালে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগের পর তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ও দাতাগোষ্ঠী অর্থ বরাদ্দ বাতিল করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটির কাজ সম্পন্ন করার সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অবশ্য পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
তবে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর মুহূর্তে এই ঘটনার কারণে প্রকল্পের স্থানগুলির এলাকার লোকেরা বিশেষ করে প্রকল্পের সমাপ্তি সম্পর্কে সন্দেহ অনুভব করেছিল। অবশ্য সরকারের সদিচ্ছায় অবশেষে মানুষের লুকোনো ভীতি ও সন্দেহ মুছে যায়।
আসলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা যারা তাদের পুরানো সম্পত্তি হারিয়েছিল, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ক্ষতির শিকার হওয়া অনেকেই ক্ষুব্ধ এবং হতাশ বোধ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্প তাদের শান্ত করতে পেরেছিল এবং তারা নিশ্চিত হয়েছিল যে জাতি উপকৃত হতে চলেছে এবং তাদের দুর্দশা লাঘব হবে।
অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য প্লট বরাদ্দের বিষয়টিতে অস্বাভাবিক সময় নেওয়া হয় যা জনগণকে বিরক্ত করেছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় রাজনৈতিক অপতৎপরতার অনুপ্রবেশ এবং দ্বিধা দেখা দিয়েছিল, অবশেষে সেগুলি সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে সফলভাবে সমাধান করা হয়েছিল।
মনে রাখতে হবে যে, সেতু নির্মাণের মতো উন্নয়ন প্রকল্পগুলি প্রায়শই বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি মানুষ বাস্তুচ্যুতির মধ্য দিয়ে গেছে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে তাদের আদি ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুতি জনগণকে যন্ত্রণা, ক্ষোভ ও উত্তেজিত করে তুলেছিল। সরকার তাদের ক্ষোভ ও দুঃখের কোলাহল প্রশমিত করার এবং তাদের স্থানান্তর করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। পদ্মা সেতু শুধু পরিবহনের ক্ষেত্রেই নয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনীতির আরও বিস্তৃত ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থাৎ উৎপাদন, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি এবং শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য হ্রাস সম্ভব হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে জাতীয় জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ১.২% বৃদ্ধি পাবে, মূল্য সংযোজন হিসাবে আয় ১.৪% বৃদ্ধি পাবে এবং মোট ৭৪৩,০০০ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ দেবে। অবশ্য সেতু নির্মাণের সময়কাল এবং বিনিয়োগের সময় ও প্রভাব বিবেচনায় ফল পেতে ৪-৫ বছর সময় লাগতে পারে। পদ্মা ‘করিডোর’- এর মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত সংযোগের প্রভাব সামগ্রিকভাবে দেশব্যাপী সুবিধাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রাথমিক কাজ ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও ডাডাবেস তৈরি করা। ফলে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত, পুনর্বাসন সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য, ক্ষতিগ্রস্ত জমির আর্থ-সামাজিক তথ্য, কাঠামো, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতির তালিকা, ক্ষতিপূরণ এবং অধিকার, অর্থপ্রদান এবং স্থানান্তর সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সংরক্ষিত হয়। এই কম্পিউটার ডাটাবেসটি পুনর্বাসন প্রকল্পের প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যে তথ্যের ভিত্তি তৈরি করেছে এবং ক্ষতিপূরণ বিতরণের দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পর্যবেক্ষণের সুবিধা দিয়েছে।
সংগৃহীত তথ্য এবং তাদের বিশ্লেষণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জীবনযাত্রার অবস্থা, জীবিকা, আয় হ্রাস, অদৃশ্য ক্ষতি এবং অন্যান্য দরিদ্রতার ঝুঁকির ক্ষেত্রে ক্ষতি এবং প্রভাবের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের অর্থ বিতরণ, বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলির স্থানান্তর, সমস্ত সম্ভাব্য পুনর্বাসনের আবেদন সংগ্রহ, তাদের বসবাসের স্থান থেকে স্থানচ্যুতি, সামাজিক সংহতি এবং জিআরসি মামলাগুলিকে প্রধান কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে আইনের অধীনে নগদ ক্ষতিপূরণ বিতরণ এবং অতিরিক্ত অনুদানও প্রদান করা হয়।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ/অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জীবন ও জীবিকার উপর প্রতিকূল প্রভাব মোকাবেলা ও প্রশমিত করার জন্য পুনর্বাসন কর্ম পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছিল। মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর এবং শরীয়তপুর জেলার জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) ক্ষতিগ্রস্ত জমি, পাকা ফসল এবং গাছ-গাছালির জন্য প্রাপ্য ব্যক্তিদের আইনের অধীনে নগদ ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছেন। সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলে পুনর্বাসন সাইটগুলির উন্নয়ন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য প্লটের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হয়।
পুনর্বাসন সাইট যথাক্রমে মাওয়া, মুন্সিগঞ্জে তিনটি এবং জাজিরা, শরিয়তপুরে দুটি সাইট এবং মাদারীপুরের শিবচরে আরেকটি সাইট তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে মুচি সম্প্রদায়ের জন্য মাওয়া এলাকায় একটি পৃথক পুনর্বাসন সাইট তৈরি করা হয়েছে এবং সেখানে ১৬টি প্লটের নকশা করা হয়েছে। সমস্ত অবকাঠামোগত নাগরিক সুবিধা যেমন, স্কুল, মসজিদ, বাজার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র জল সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাস্তা ইত্যাদির নির্মাণ সম্পন্ন হয়। পুনর্বাসন সাইটগুলিতে তিনটি শ্রেণির আবাসিক প্লট নির্দিষ্ট ছিল- ২.৫, ৫.০ এবং ৭.৫ দশমিক। সাতটি পুনর্বাসন সাইটে মোট ২৬৩৪টি আবাসিক প্লট এবং ৮০টি বাণিজ্যিক প্লট পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বাণিজ্যিক প্লটের সংখ্যা ৮০টি প্রতিটি প্লটে ১৫ বর্গমিটার।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পুনর্বাসনের বাইরেও জনগণের অংশগ্রহণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণ, জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, চর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, জীবিকা পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
৫.পদ্মা সেতুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের পুনর্বাসনে শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগগুলো সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। যেমন- জমি, বাড়ি এবং অন্যান্য সম্পত্তি হারিয়েছেন, তাদেরকে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ আইনের (১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ-২ ও ২০০৯ সালের পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষ আইন নং ৩১) বিধান অনুসরণে জমি ও তাতে অবস্থিত ঘরবাড়ি, স্থাপনা, পুকুর, গাছপালা ও দণ্ডায়মান ফসলের নগদ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে।
উপরন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সামাজিক নিরাপত্তা নীতিমালা মোতাবেক সরকার ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার ও ব্যক্তিকে জেলা প্রশাসক প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের বাইরেও অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক অবস্থা যাতে প্রকল্প বাস্তায়নের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ যথাসম্ভব উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যে সকল ব্যক্তি, কর্মচারী, ব্যবসায়ী, উথুলি ও স্কোয়াটার এবং শ্রমিক/কর্মচারী (জমি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে) বসবাস এবং/অথবা জীবিকা উপার্জন করছিলেন, তাদেরকেও পুনর্বাসনের আওতায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সহায়তার ব্যবস্থা করে। পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এগুলো হলো- ক) অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ যথাসম্ভব পরিহার করা এবং সেতু অবকাঠামো ও এর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশ নির্মাণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন শুধু সেই পরিমাণ জমিই অধিগ্রহণ করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বর্তমান জীবনযাত্রার মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অধিগ্রহণের আওতাধীন জমির ও সম্পদের পূর্ণ বদলি মূল্য বর্তমান বাজার দরে পরিশোধ করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন সহায়তা নিশ্চিত করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের ব্যবহৃত সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সংরক্ষণ করে এবং কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন সহায়তা সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। তবে অসহায় নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। জমির মালিকানা না থাকলেও প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সকল ব্যক্তি ও পরিবার পুনর্বাসন সহায়তা পায়। মহিলা খানাপ্রধান, অচল ও বয়ঃবৃদ্ধ খানাপ্রধান এবং দরিদ্র পরিবারবর্গের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হয়।
ঘর-বাড়ি অপসারণ ও জমি খালি করার পূর্বেই শনাক্ত সকল মালিক ও প্রাপ্য-যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য নগদ অনুদান পরিশোধ করা হয়। পুনর্বাসন সংশ্লিষ্ট যে কোনো অভিযোগ যথাযথভাবে নিরসন করা হয় এবং পুনর্বাসন এলাকায় প্লট বরাদ্দের জন্য নীতিমালা কওে সেসব প্লট বরাদ্দ করা হয়।
ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রে বাজার মূল্যকে ৫০% বাড়িয়ে আইনানুগ নগদ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। প্লটের জন্য যোগ্য পরিবারসমূহকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ ভিত্তিতে প্লট হস্তান্তর করা হয়। এমনকি ক্ষতিপূরণ ও অনুদানের টাকায় জমি কেনার জন্য বা অন্য কোনো উৎপাদনশীল খাতে বা জীবিকা সৃষ্টিকারী লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করার জন্য ক্ষতিগ্রস্তদেরকে সার্বিকভাবে উৎসাহিত করা হয়। ২৫০-এর বেশি পরিবার তাদের নিজস্ব উদ্যোগে নির্দিষ্ট গ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছে। তারা সরাসরি জমি কিনে নিয়েছে। স্থানান্তরের জন্য প্রস্তাবিত জমি বেশিরভাগই কম ছিল এবং এর জন্য মাটির কাজ, রাস্তা সংযোগ, স্বাস্থ্য সুবিধা, স্কুল এবং ধর্মীয় স্থান প্রয়োজন।
সরকার এই হারগুলি পর্যালোচনা করে এবং এর ফলে উন্নয়ন অনুদান বৃদ্ধি পায়। তাদের জন্য প্রসারিত সহায়তার সম্মত পরিমাণ হল প্লটের আকারের উপর নির্ভর করে প্রতিটি পরিবারের জন্য জাজিরা প্রান্তে ১,৫০,০০০ ২,০০,০০০, ২,৫০,০০০ টাকা এবং মাওয়া প্রান্তে ৩,০০,০০০, ৪,০০,০০০ ১ এবং ৫,০০,০০০ টাকা। এর পাশাপাশি ইউটিলিটি ইনস্টলেশন ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। ফলে স্ব-স্থানান্তরের জন্য আগ্রহ তৈরি করে মানুষের মনে। বসতি হারানো কৃষক পরিবার, যাদের ১.৫ একর পর্যন্ত জমি আছে বা কোনো জমিজমা নেই, তারা ৭.৫ শতক প্লট বরাদ্দ পান এবং যাদের ১.৫ একর ওপর জমি আছে, তারা ১০ শতক প্লট।
প্রথমে ২ বছরের জন্য একটি চুক্তিপত্র সম্পাদন করা হয় এবং এতে ২ বছর অন্তর-অন্তর নবায়ন করার শর্ত ছিল। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের যৌথ নামে রেজিস্ট্রি হয়। যদি স্বামীর তালাক/বিবাহ বিচ্ছেদ/মৃত্যু ঘটে, তবে স্ত্রী প্লটের মালিক হবেন। যদি স্ত্রীর মৃত্যু হয়, তবে স্বামী প্লটের মালিক হবেন। যারা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং যারা সমাজে দুস্থ তারা বাজার এলাকায় একটি বাণিজ্যিক প্লট পাবার যোগ্য বিবেচিত হন। তবে অবশ্যই ৬ বছর পর স্ব-ইচ্ছায় সকল প্লট পরিত্যাগ করে পূর্বের জায়গায় ফেরত যেতে হবে। যারা প্লট পাননি বা যারা পুনর্বাসন এলাকায় যাওয়া পছন্দ করবেন না, তাদের ৬ বছরের জন্য অন্যত্র ভাড়া নিয়ে থাকার অর্থ বরাদ্দ দেওয়া ব্যবস্থা করা হয়।
পুনর্বাসনের প্রধান কাজগুলির মধ্যে একটি হল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। সরকার আন্তরিকতার সাথে এই কাজটি সম্পন্ন করে। অতিরিক্ত অনুদান প্রদানের কাজও শেষ হয়। অ্যাপ্রোচ রোড এলাকাগুলি সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত হয় ২০১৪ সালেই।
ঐতিহাসিকভাবে মাওয়া, শিবচর ও নাওডোবা এলাকার নারীরা নিম্ন সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং পরিবারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তারা বেশিরভাগই উপেক্ষিত ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য এজেন্ডা নির্ধারণ করতে পারেনি। প্রায়ই তাদের সম্পদ এবং সম্পত্তি ভাগ করার অধিকার অস্বীকার করা হয়. এমনকি তাদের নানা কাজে দক্ষতার অভাব রয়েছে। সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তারা বেশিরভাগই দূরে ছিলেন। ফলস্বরূপ, তারা উপলব্ধ সুযোগ এবং সম্পদের সমান প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। তাদের দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে লিঙ্গ সমতাকে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছিল।
যেমন, ২০১৫ সালে মাদারীপুর, মাওয়া ও নাওডোবায় লিঙ্গ বৈষম্যের ঘটনা ঘটেছে। ভাই ও ছেলে তাদের বোন ও সৎ মাকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করেছে। ক্ষতিপূরণের টাকা না দেওয়ায় স্ত্রীকে মারধর করেছে স্বামী। সম্পত্তিতে তার প্রাপ্য অংশ থাকা সত্ত্বেও বোনকে তার ভাই এবং স্থানীয় নেতারা আদালতের মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল। এই সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নারীরা তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ সংগ্রহের জন্য অফিসে উপস্থিত ছিলেন। তারা অন্যের মাধ্যমে চেক সংগ্রহ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
৬.খুনিদের হাত থেকে বেঁচে আসা শেখ হাসিনা আজ মহিমান্বিত রাষ্ট্রনায়ক। কারণ পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথে দেশ-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকার সর্বান্তকরণে নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেছে।
বলা চলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু আজ ভরসার প্রতীক, অভিজ্ঞতার প্রতীকে, সম্মানের ঠিকানা। জননেত্রীর উপর আস্থা আছে বলেই ঘরবাড়ি ও বসতভিটা হারানো মানুষরা প্রথমে দুঃখ পেয়ে হতাশ হলেও শীঘ্রই তারা বিষয়টি মেনে নেয়। আসলে পদ্মা সেতুর অভিজ্ঞতা নিশ্চিতভাবে সরকারের জন্য ভবিষ্যতের পদক্ষেপের জন্য একটি মাইলফলক।
লেখক : বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।drmiltonbiswas1971@gmail.com
এইচআর/এএসএম