জনতার নেতা জনকল্যাণকেন্দ্রিক, জনমুখী এবং জনতাই তার শুরু ও শেষ। সেই নেতা জানে শাসনের রাজনীতি কোন পথে গেলে জনতার হৃদয়ের ছোঁয়া পাওয়া যায়। আজ সেই নেতার হাত ধরে বাংলাদেশের বড়দিন- ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন। উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ ও বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল এ সময়ে উদ্বোধন হতে চলেছে এমন এক আইকনিক প্রকল্পের।
Advertisement
এটি শুধু একটি অবকাঠামো নয়, লড়াই করে জেতা বিজয় স্তম্ভ। এই সেতু নির্মাণকে ষড়যন্ত্রের ফাঁকে আটকানোর চেষ্টা হয়েছে এবং সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে লড়াই করতে হয়েছে দৃঢ়তা নিয়ে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এটি শুধু সেই অঞ্চলের মানুষ নয়, উপকার করবে সারাদেশের মানুষের। পদ্মা বহুমুখী সড়ক-রেল সেতু, যা বাংলাদেশের মানুষের অর্থে নির্মিত হলো। সেতুটি মুন্সিগঞ্জকে শরীয়তপুর এবং মাদারীপুরের সাথে সংযুক্ত করছে এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং উন্নয়ন প্রকল্প এই সেতু যাকে বলা হচ্ছে এক ‘ইঞ্জিনিয়ারিং মিরাকল’। পদ্মা নদী পৃথিবীর উত্তাল বা খরস্রোতা নদীগুলোর মধ্যে একটি। এতো উত্তাল নদীর ওপর সেতু নির্মাণ তো চ্যালেঞ্জিং ছিলই, কিন্তু বেশি ছিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
সরকার যখন প্রকল্পটি হাতে নিল সবাই তখন উদ্বেলিত। কিন্তু অনেকেই খুশি হতে পারেনি। তবে বাংলাদেশের মানুষ এ প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছে অন্তর থেকে, কারণ সেতুটা হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাই বদলে যাবে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছোঁয়া যাবে হাওয়ার বেগে, নদী আর পথ রুখতে পারবে না।
Advertisement
এমন একটি প্রকল্পে যুক্ত থাকার জন্য নিজ থেকেই এগিয়ে এসেছিল বিশ্বব্যাংক। এমন একটা ঐতিহাসিক কাজে তাদের ছিল ব্যাপক আগ্রহ। আর্থিক সাহায্যের কথাও বলেছিল। স্বপ্নের সেতু নির্মাণ শুরু হয়েও হলো না। বিশ্বব্যাংক হঠাৎ বলে বসল, তারা সাহায্য করতে অপরাগ। বলল, দুর্নীতি হয়েছে।
অভিযোগ আছে যে, বাংলাদেশেরই কিছু খ্যাতনামা ব্যক্তি ও গণমাধ্যমও সুর মেলায় এই দাতা সংস্থার সাথে। হতাশ হয়ে পড়েন দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা দেশের মানুষ। বিব্রত সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠার পর তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ দেওয়া এবং যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার অবস্থান ছিল দৃঢ়। সরকার প্রমাণ চায়।
বিশ্বব্যাংক ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু অভিযোগ তুলল। এতে বড় কিছু প্রমাণ হয় না। পদ্মা সেতু থেমে রইল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করলেন, পদ্মা সেতুর কাজ যেমন চলছে, তেমনই চলবে। বিশ্বব্যাংকের সাহায্যের দরকার নেই। বাংলাদেশ নিজের টাকায় এ কাজ করবে।
কথাটা বিশ্বাস করেনি বিশ্বব্যাংক, অন্যান্য দাতা সংস্থা এবং এদেশের কিছু মানুষ। তাদের ভাবনায় ছিল এটি অসম্ভব। তারা বুঝতে পারেনি শেখ হাসিনার সরকারের সক্ষমতা। শেখ হাসিনা শক্ত হাতে হাল ধরলেন পদ্মা সেতুর এবং নির্মাণ কাজ দুর্বার গতিতে চলে আজ এই সেতু বাস্তব।
Advertisement
অনেকেই সেতুর নির্মাণ খরচ নিয়ে কথা বলছেন। বিষয়টা বোধহয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে, মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আপার ডেক এবং লোয়ার ডেক দুটো মিলেই যে মূল সেতু, সেই মূল সেতুর ব্যয় এটি।
বাকি টাকা খরচ হয়েছে— নদীশাসনে ব্যয় আট হাজার ৯৭২ কোটি টাকা, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে ব্যয় এক হাজার ৫০০ কোটি, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ সংক্রান্তে ব্যয় চার হাজার ৩৪২ কোটি, পরামর্শক, সেনা নিরাপত্তা, ভ্যাট, আয়কর, যানবাহন, বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় দুই হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
সেতু সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিজয় হয়েছে অন্য এক জায়গায়ও। কানাডার আদালতে দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। মামলা বাতিল করে দিল আদালত, কারণ এর কোনো সারবত্তা নেই। অবশেষে বাংলাদেশের প্রশংসায় মাতল বিশ্বব্যাংক। তাই এই সেতু এক বিজয়ে আর অহঙ্কারের নাম।
পদ্মা সেতু নিয়ে যে রাজনীতি হয়েছে তাকে পরাজিত করা হয়েছে। এর অর্থনৈতিক উপকারিতার কথা ভাবলে প্রথমেই যে কথা আসবে তা হলো মানুষ ও জনপদের সংযোগ। রাষ্ট্র বিনিয়োগ করেছে, এখন সেখানে ঘটবে মানুষের নিজস্ব বিনিয়োগ যোগাযোগ। দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে যাবে।
রাজধানীর সাথে সরাসরি যোগাযোগের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পায়ন সহজতর হবে। ২১টি জেলায় গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্প। কৃষির ব্যাপক উন্নতি হবে। কৃষকরা পণ্যের দাম ভালো পাবেন এবং উৎপাদন বাড়বে। বলা হচ্ছে দক্ষিণের জেলাসমূহের বার্ষিক জিডিপি ২ দশমিক ০ শতাংশ এবং দেশের সামগ্রিক জিডিপি ১ দশমিক ০ শতাংশের বেশি বাড়াতে সাহায্য করবে পদ্মা সেতু।
সেতুটি নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সাথে সংযুক্ত হবে। ফলে ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সহজ হবে। সেতুর দুই পাশে গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও বেসরকারি শিল্প শহর।
ফল স্বরূপ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশে বড় আবদান রাখবে এই সেতু্। দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরায় পুরোনো-নতুন রিসোর্টসহ নতুন-পুরোনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে শুরু করবে শিগগির।
নিজের অর্থায়নে এত বিশাল সেতু নির্মাণ করায় ধীরে ধীরে আরও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিজ অর্থেই সম্পন্ন করার ভিতটা সৃষ্টি হলো। পদ্মা সেতু আমাদের প্রকৌশলী, ব্যবস্থাপক ও কারিগরি মানবসম্পদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। প্রযুক্তি বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের জ্ঞান বেড়েছে। আমাদের প্রকৌশলী, কারিগরি কর্মী প্রত্যেকের জন্য এই সেতু উপহার দিল আস্থা, সক্ষমতা ও দৃঢ় মনোবল।
পদ্মা সেতু যোগাযোগের বড় দিগন্ত উন্মোচন করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই যোগাযোগ সুবিধা অর্থনৈতিক সুবিধায় রূপান্তর করতে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্য অবকাঠামোতেও নজর দিতে হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে দ্রুত এসে ঢাকার প্রবেশমুখে যদি পণ্য নিয়ে যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় তাহলে সম্পূর্ণ সুফল নেওয়া যাবে না। তাই শুরু থেকেই সতর্ক হতে হবে। আর বিনিয়োগ যা হবে সেটা যেন পরিকল্পিত হয় তার দিকেও নজর থাকতে হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/ফারুক/এএসএম