জাতীয়

‘সর্বনাশা’ থেকে ‘সর্বআশা’ পদ্মা

সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই

Advertisement

বল আমারে তোর কি রে আর

কুল কিনারা নাই, কুল কিনারা নাই?

আব্দুল লতিফের কথা ও সুরে শিল্পী আব্দুল আলীমের দরদি কণ্ঠে বিধ্বংসী পদ্মার রূপ সবার পরিচিত। জীবনঘনিষ্ঠ এ গান যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয় কেড়েছে। এটি সারাদেশের মানুষের কাছে নিছক মরমী সঙ্গীত। কিন্তু পদ্মপাড়ের মানুষের কাছে চরম বাস্তবতা। দীর্ঘকালের পদ্মার সর্বনাশা সেই চরিত্রের অবসান হয়েছে। বাঙালির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মার ওপর নির্মিত হয়েছে সেতু। আর সেই স্বপ্ন পূরণের মধ্য দিয়ে পদ্মার সর্বনাশা চরিত্রের কালিমাও এখন দূরান্তর। পদ্মা এখন আর শুধু সর্বনাশা নয়,পদ্মা এখন সর্বআশার।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীশাসনের ফলে যেমন ভাঙন আতঙ্কও দূর হয়েছে পদ্মার, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যাতায়াতের দীর্ঘ সংকটও কাটছে। কেটেছে ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে খরস্রোতা পদ্মা পাড়ি দেওয়ার ভোগান্তি। থাকছে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার প্রহরও। পদ্মা পার হওয়া যাবে এখন ৫-৬ মিনিটে। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে পর্যটনসহ নানা খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। যেটি দেশের প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় দুই শতাংশের কাছাকাছি।

পদ্মাপাড়ে কথা হয় জাজিরা কাজিরহাট বন্দরের আমিনুল মাতব্বরের (৮০) সঙ্গে। পদ্মার ভাঙনে কতবার নিজের বসতভিটা এই জীবনে সরাতে হয়েছে তা আঙুলে গুনে গুনে হিসাব দিচ্ছিলেন মানুষটি। খরস্রোতা পদ্মার ভাঙন যেন তার জীবনকে বিষণ্ন করে তুলেছে। পদ্মা সেতুর কল্যাণে নদীশাসনের কাজ যেন তার জীবনে বয়ে এনেছে সবচেয়ে বড় কল্যাণ।

পূর্ব নাউডোবা ইউনিয়নে চা খেতে খেতে কথা হয় সেরু কাজীর সঙ্গে। তার কাছেও সেতুর সবচেয়ে বড় দিক নদীশাসন। তিনি বলেন, আগে বন্যায় অনিশ্চয়তা থাকতো। এই বুঝি বাড়িঘর পদ্মা নিয়ে গেলো। কিন্তু বাঁধ দেওয়ার কারণে সেই ভয় এখন নেই। রাতে অন্তত শান্তিতে ঘুমাতে পারি।

পদ্মাপাড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাষিরাও অনেক লাভবান হবেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ফলে অর্থনীতির চাকাও হবে সচল। সাধারণ মানুষ কৃষিপণ্য সুলভমূল্যে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করবেন। পদ্মাপাড়ে নানা ধরনের শাক-সবজি হয়। এসব শাক-সবজি ঢাকায় নিতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতো। অথচ এখন স্বল্পসময়ে ঢাকায় নেওয়া যাবে। ফলে সবাই উচ্ছ্বসিত সেতুর উদ্বোধনে।

Advertisement

মাদারীপুর শিবচরের সাহেব বাজারের মোহাম্মদ বাহাদুর জাগো নিউজকে বলেন, আমার মোট দুটি দোকান আছে। এখন পান কিনি বরিশাল থেকে, সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে কিনতে পারবো। আগে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগতো এখন এক থেকে দেড় ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছাতে পারবো। মালপত্র নিয়ে একদিনে দু-তিনবারও ঢাকায় থেকে আসা যাওয়া করতে পারবো। আমার একটা দোকান আছে পার্টসের। সেতু চালু হলে দ্রুতসময়ে এটা-ওটা ঢাকা থেকে আনা যাবে।

আরও পড়ুন: পদ্মার বুক চিরে বাংলাদেশের ‘সাহস’

পদ্মাপাড়ের উর্বর জমিতে নানা ধরনের ফসল হয়। জমিগুলো অনিশ্চয়তায় থাকতো ভাঙনের কারণে। তবে সেই অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দূর হয়েছে সেতুপাড়ে। চাষিদের নানা ধরনের ফসল ও সবজি দ্রুত ঢাকায়ও নেওয়া যাবে। পদ্মাপাড়ে কথা হয় বিকে নগরের সবজি চাষি হাফিজুর ব্যাপারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের এখানকার পাটশাকের কদর ঢাকায় অনেক বেশি। এছাড়া পেঁয়াজ, করলা, শসা, ধুন্দল ও লাউ ভালো হয়। ঢাকায় বর্তমানে ফেরি পারাপারের কারণে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। ফেরিতে সময় বেশি লাগে, ঝামেলা হয়। তবে সেতু চালু হলে এক থেকে দেড় ঘণ্টায় সবজি ঢাকার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারে বিক্রি করতে পারবো।

শুধু পদ্মার পাড় নয়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায়ও প্রভাব পড়েছে। নড়িয়া পৌরসভার শুভগ্রাম, বাড়ইপাড়া, বিসমিল্লাহনগর, বৈশাখীপাড়া, ঢালিপাড়া ও বাঁশতলায় এক কড়া জমি ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নানা ধরনের ফাস্টফুডের দোকান তৈরি হয়েছে। ছোট ছোট বিপণিবিতানও তৈরি হয়েছে। কারণ বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীর সংখ্যা।

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে, এই খবরে আমরা খুশি। পদ্মা সেতু হওয়ায় ফেরিতে ঢাকা যাওয়ার যে বিড়ম্বনা ছিল, সেটা দূর হবে। অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল হবে মাদারীপুর। সদর, শিবচর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী জেলা শরীয়তপুরে শিল্পায়ন হবে। পদ্মাসেতু ঘিরে এই এলাকায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবকাঠাবো হবে। এতে মাদারীপুরের আর্থ-সামাজিক ব্যাপক উন্নয়ন হবে বলে আশা করি। এক কথায়- পদ্মা সেতু চালু হলে সব সুবিধাই পাবে মাদারীপুরবাসী।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের বিষয়। এটি শুধু সেতুই নয়, পদ্মা সেতু হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ফলে আমাদের ভৌগোলিক যে বিভাজন ছিল, তাতে সংযোজন স্থাপন হবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটা একীভূত অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হবে। পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের বিনিয়োগ, বিতরণ ও বিপণনগুলোতে যে সাশ্রয় হবে, সেটা অর্থনীতিতে ইতিবাচকভাবে ভূমিকা রাখবে। এছাড়া ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। এরই মধ্যে পদ্মার করিডোরের পাশ দিয়ে বিনিয়োগের বিভিন্ন ধরনের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তবে এসব বিনিয়োগে যে কর্মসংস্থান হবে, সেগুলো আমাদের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করছি।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর আদ্যোপান্ত

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের অগ্রযাত্রার ঐতিহাসিক মাইলফলক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ সেতু ব্যাপক অবদান রাখবে, ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সহজ করে তুলবে।

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে, যেন বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যত বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে, জিডিপিতে এর অবদান তত বেশি হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের পণ্য আমদানি সহজ হবে। মালামাল দ্রুত সময়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবে। প্রবৃদ্ধি ১ থেকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ বাড়বে। পদ্মা সেতুর সর্বোচ্চ বেনিফিট (উপকার) পেতে দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগ দরকার। সব খাতে বিনিয়োগ হতে পারে। ফলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। কুয়াকাটায় আরও বিনিয়োগ করতে হবে। মানুষ কক্সবাজার বাদ দিয়ে কুয়াকাটায় যাবে।

তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে ক্রেতা ও ব্যবসায়ী উভয়ই লাভবান হবেন। এই সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে কাঁচামাল আমদানি আরও সহজ, সুলভ ও দ্রুত হবে। এতে আমদানি-রপ্তানি আরও সহজ হবে। বিভিন্ন বন্দর এলাকায় পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার হবে।

আরও পড়ুন: ‘আমার ওপর দায়িত্ব ও দেশ ত্যাগের চাপ ছিল’

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেন, পদ্মা সেতু খোলামাত্রই জিডিপি বেড়ে যাবে ও শিল্প-কারখানা হয়ে যাবে, তা হবে না। আমি ব্যাংকগুলোতে দেখছি, গত দুই বছরে শিল্প-কারখানার যত প্রস্তাব এসেছে তার অধিকাংশই পদ্মার ওপাড়ের অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে এবং এর অধিকাংশই কৃষিভিত্তিক শিল্প। এর মানে মানুষ অলরেডি ওইসব অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে। পদ্মা সেতুর কারণে ২০২৭ সালে জিডিপির ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ অবদান থাকবে। ওই সময় দেশের জিডিপির আকার হবে ৬৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ লাখ কোটি টাকা হবে দক্ষিণাঞ্চলের কারণে।

এসইউজে/এএসএ/ইএ