রাত পোহালেই নতুন এক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে স্বপ্নের একটি সেতু প্রমত্ত পদ্মার দুই পাড়ের স্বপ্নের বন্ধন তৈরি করেছে । এটা কেবল একটি সেতুই নয়, বাঙালি জাতির গর্ব, অহংকার। শনিবার সকালে সেই অহংকারের পূর্ণতা পাবে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন বহুল প্রতীক্ষিত এই সেতু।
Advertisement
বাংলাদেশও যে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প করতে পারে, সেটাই দেখিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এই সেতু দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা, পর্যটন ও খেলাধুলাসহ সব বিষয়ে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলার মেলবন্ধন হবে পুরো দেশের সঙ্গে।
আবদুস সালাম মুর্শেদী-যিনি একাধারে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক। সাবেক এই তারকা ফুটবলার খুলনা-৪ আসনের সরকারী দলীয় সংসদ সদস্য। তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি এবং বাফুফের প্রফেশনাল লিগ কমিটির চেয়ারম্যান।
পদ্মা সেতুর প্রভাব খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সেক্টরে কিভাবে পড়বে, তা নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ সংবাদদাতা রফিকুল ইসলাম।
Advertisement
জাগো নিউজ: আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারপরই যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে কিভাবে দেখছেন স্বপ্নের এই বাস্তবায়নকে?
সালাম মুর্শেদী: পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বললে কেবল খেলাধুলার মধ্যে সীমিত রাখা যাবে না। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ সব সময়ই খেলাধুলায় বিশেষ অবদান রেখে এসেছে। কেবল ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা হকিই নয়-এই অঞ্চলের মানুষ প্রায় সব খেলাতেই অবদান রেখে আসছে। তারা আবার নতুন করে ব্যাপকভাবে খেলাধুলায় অবদান রাখতে পারবে।
জাগো নিউজ: পদ্মার কারণে দেশের বড় অংশের সঙ্গে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর একটা দূরত্ব ছিল। পদ্মা সেতু সেই দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে। আপনিও ওই অঞ্চলের মানুষ। নিশ্চয়ই আপনিও সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়।
সালাম মুর্শেদী: দেখুন, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলা শেষ করেই রওয়ানা দেবো পদ্মার পাড়ের দিকে। রাতে সেখানেই আমার এক বন্ধুর বাসায় থাকবো। কারণ, সকালে এত ভিড় ঠেলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়া কঠিন হবে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কথা বলছেন? ওই অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জন্য পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার। আমার খুলনা শিল্প নগরী। ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়ে গিয়ে ওই অঞ্চলের মাধ্যমে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ১.২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এই সেতু।
Advertisement
জাগো নিউজ: পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এই সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। দেশের এই অর্জনকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সালাম মুর্শেদী: দেখুন, এই সেতুটা কেবল একটু সেতুই নয়, এটা আমাদের সামর্থ্যর প্রতীক, গর্বের প্রতীক। এই সেতু তৈরির একক কৃতিত্ব জননেত্রী শেখ হাসিনার। তার সাহস আর প্রজ্ঞা দেশ ও জাতিকে উপহার দিতে পেরেছে এই সেতু।
জাগো নিউজ: ব্যবসা-বাণিজ্যে এই সেতু কিভাবে কাজে আসবে?
সালাম মুর্শেদী: এই সেতুর কয়েকটি মৌলিক দিক আছে। এক. এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দেশের সব অঞ্চলের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করবে। দুই. ওই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে যাতায়াতের সময় কমবে, মানুষের খরচ কমবে। পায়রা বন্দর, বেনাপোলের ব্যবহার বেড়ে যাবে। এই সেতু ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রও তৈরি হবে। কুয়াকাটা, সুন্দরবন ঘিরে পর্যটক বাড়বে। নতুন নতুন হোটেল, মোটেল তৈরি হবে। তিন. সার্কসহ আঞ্চলিক যোগসূত্র বেড়ে যাবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হবে।
জাগো নিউজ: যুগের পর যুগ দেখে আসছি এই প্রমত্ত পদ্মায় নানা দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। চিকিৎসা নিতেও ওই অঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে পারতো না।
সালাম মুর্শেদী: ঠিকই বলেছেন-এই ভয়াল পদ্মা পার হতে গিয়ে অনেক মানুষ মারা গেছেন। সেই করুণ ইতিহাস আমরা জানি। মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে ঢাকা যেতে পারতো না। নদী পাড় হতে হতে অসুস্থ মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে। এখন আর ঘাটে বসে বা পদ্মায় ডুবে মানুষকে মরতে হবে না। ওই অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ বিশেষ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে দ্রুতসময়ে ঢাকায় আসতে পারবে।
জাগো নিউজ: খেলাধুলায় কেমন প্রভাব ফেলবে এই পদ্মা সেতু?
সালাম মুর্শেদী: আমি বলবো অন্যান্য সেক্টরের মতো খেলাধুলার দুয়ারও খুলে যাবে পদ্মা সেতুতে। আর সেটা সব ধরনের খেলারই। আমি যদি ফুটবলের কথা বলি, তাহলে বেশ কয়েকটি জেলায় এখন খেলা চালাতে পারবো। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করছি। এখন ভেন্যু নিয়ে ক্লাবগুলোকে আর হাপিত্যেশ করতে হবে না। ভেন্যু ভাগাভাগি করেও ব্যবহার করতে হবে না। এখন প্রিমিয়ার লিগটা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে।
জাগো নিউজ: পদ্মার পশ্চিম পাড়ে এতদিন একটি মাত্র ভেন্যু ছিল গোপালগঞ্জে। সেখানে খেলতে যাওয়া-আসার সময় ক্লাবগুলোকে পদ্মার পাড়ে নাকাল হতে হতো। এখন আর সেই অবস্থা থাকবে না। আপনি চাইলে আরো ভেন্যু বাড়াতে পারবেন।
সালাম মুর্শেদী: আমি বিশ্বাস করি, বরিশাল ও খুলনায় দ্রুতই প্রিমিয়ার লিগের ভেন্যু কার সম্ভব হবে। এ ছাড়াও ভেন্যু করার মতো স্টেডিয়াম আছে বরিশাল, ফরিদুপর, যশোর, মাগুড়া, বাগেরহাটে। কিছু স্টেডিয়াম ছোট হলেও সেখানে নতুন করে কিভাবে কি করা যায় সেটা দেখবো।
জাগো নিউজ: আপনার জেলা খুলনার খেলাধুলায় অতীত ঐতিহ্য আছে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর নিজের জেলা নিয়ে কি ভাবছেন?
সালাম মুর্শেদী: আমি মনে করি, পদ্মা সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে খুলনার খেলাধুলার অতীত ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে। সব খেলার জাতীয় দলেই এই জেলা এবং এই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে।
জাগো নিউজ: আপনি যদি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভেন্যু বাড়াতে পারেন তাহলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ওপর চাপও কমবে। তখন দেশের খেলাধুলার প্রধান এই ভেন্যু নিয়ে কি ভাববেন?
সালাম মুর্শেদী: বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছাড়াই ১২ ক্লাবের জন্য ১২টি ভেন্যু করা হবে। প্রিমিয়ার লিগের কোনো খেলা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হবে না। এখানে জাতীয় অনুষ্ঠান, ফেডারেশন কাপ ফুটবল, স্বাধীনতা কাপ ফুটবল, ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক খেলা হবে।
জাগো নিউজ: বাফুফে চাইলে তো ঢাকার বাইরে আন্তর্জাতিক ভেন্যুও বাড়াতে পারবেন, তাই না?
সালাম মুর্শেদী : অবশ্যই। আমাদের বরিশাল স্টেডিয়ামে তো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ও ম্যাচ আয়োজন করাই যায়। এর বাইরেও যে সব জেলা শহরের স্টেডিয়ামের সাইজ আন্তর্জাতিক মানের সেই সব স্টেডিয়ামকেও আমরা আন্তর্জাতিক ভেন্যুতে রূপান্তরিত করতে পারবো।
জাগো নিউজ: সরকারের একটা পরিকল্পনা আছে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন বিভাগ করার। যার নাম হতে পারে পদ্মা বিভাগ। সেটা হলে তো একটি বিভাগীয় শহরও থাকবে। যেখানে খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধাও তৈরি করতে হবে।
সালাম মুর্শেদী: অবশ্যই। নতুন বিভাগ চালু হলে সেখানে দেশের প্রধান তিন খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির জন্য আলাদা স্টেডিয়ামতো থাকবেই। সেই সঙ্গে অন্যান্য খেলার সুযোগ-সুবিধাও তৈরি করবে সরকার।
জাগো নিউজ: পদ্মার পাড়ে একটি অত্যাধুনিক ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরির চিন্তা-ভাবনাও আছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। সেটা হলেও তো ক্রীড়া ক্ষেত্রে আরো বড় অবদান রাখবে এই কমপ্লেক্স?
সালাম মুর্শেদী: এমন একটা পরিকল্পনা আছে। পদ্মার পশ্চিম পাড়ে কমপ্লেক্স তৈরির জন্য জমিও খোঁজা হচ্ছে। এই কমপ্লেক্সটা এতটাই আধুনিক হবে যে, এখানে দেশের সব খেলার জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এটা হবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের নতুন এক অধ্যায়। যে কমপ্লেক্সে খেলাধুলার অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা, থাকার জন্য ডরমেটরি-সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকবে।
জাগো নিউজ: অতি ব্যস্ত এক সন্ধ্যায় অনেক সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সালাম মুর্শেদী: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
আরআই/এমএমআর/এএসএম