মতামত

জনপ্রত্যাশা পূরণে আস্থার ঠিকানা আওয়ামী লীগ

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আজকের দিনে আওয়ামী লীগ যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তার দু’বছর আগে ১৯৪৭ সালে জন্ম হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। তবে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিরা অংশ নিয়েছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল- নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তাদের সে স্বপ্ন ভেঙে যায়। বাঙালির ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ, আঞ্চলিক বৈষম্য ও নিপীড়ন।

Advertisement

রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলাকে অগ্রাহ্য করার মধ্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র উন্মোচিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ববাংলা বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ, দেশ পরিচালনায় মুসলিম লীগের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দমননীতি, সাধারণ জনজীবনের বিপর্যয়সহ নানাবিধ ঘটনা দারুণভাবে হতাশ করে। তৎকালীন সময়ের এসব রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নতুন এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ।

শুরুতে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম ছিল। পরে ছয় বছরের মাথায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সেই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে পরিণত হয়।

তাই বলতে হয় ঐতিহাসিক একটি সময়ে জন্ম আওয়ামী লীগের। ৭৩ বছর আগে জমিদার ও ধনিক শ্রেণির স্বার্থের বিপরীতে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে পথচলা শুরু দলটির। আজও সেই পথেই হেঁটে যাচ্ছে। সেই পথ দীর্ঘ সংগ্রামের ও ত্যাগের। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নৌকা প্রতীকের এ দলটির প্রতি সর্বস্তরের জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছিল এবং আছে। আওয়ামী লীগও জনগণের অধিকারের প্রতি আপসহীনভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থেকেছে।

Advertisement

সেই ধারাবাহিকতা আজও বহমান। সঠিক পথে থেকেছে বলেই ইতিহাসের নানা বাঁকে অসাধারণ সব সাফল্য এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এসেছে আওয়ামী লীগ ও এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের হাত ধরেই। সময়ের পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ আজ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন দল। টানা ১৪ বছর এবং সবচাইতে দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে জনগণের সমর্থনে। সাম্প্রতিক করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক নানা সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশে একের পর এক অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাঙালির আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ভূমিহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্প ইত্যাদি হাজারও উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দীর্ঘ এ সময়ে সমান্তরালভাবে জনপ্রত্যাশা পূরণে আওয়ামী লীগ বরাবরই আস্থার প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রমাণ দিয়ে এসেছে। চলার পথে যেমন উত্থান ছিল তেমনি ছিল নানা প্রতিবন্ধকতাও। উত্থান পর্বের কথা যদি বলি- পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিরোধীদের ওপর মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়ন ও নির্যাতন এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তখন বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। সেই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক সমস্যা সামনে রেখে একের পর এক কর্মসূচি প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ। এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল জমিদারি প্রথার বিলোপ, বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির উচ্ছেদ, পাটের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, সারাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি।

এসব কর্মসূচি থেকে স্পষ্ট যে, এ দাবিগুলো ছিল সাধারণ জনগণের দাবি। এমন গণমুখী কর্মসূচি জনগণের সামনে আনায় আওয়ামী মুসলিম লীগ দল দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। সরকারি বৈরিতা এবং দমন-নির্যাতন সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এই দল পূর্ববাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।

শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করে গেছে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৪২ দফা এজেন্ডা গ্রহণ করে। পাকিস্তানের শাসনামলের প্রাথমিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রধান দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাকে দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

১৯৪৮-৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন-ছাত্রলীগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে জেল খেটেছেন আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিব। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সার্থক সংগ্রামের সূচনা হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৯৫০ দশকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও পূর্ববাংলার ন্যায্য অধিকার নিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে।

Advertisement

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনকালীন যুক্তফ্রন্ট গঠনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা এজেন্ডা প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনে জনগণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। এই ২১ দফার দুটি প্রধান দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা ইস্যু’ এবং ‘পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি’।

১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে আরও সংগঠিত করতে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীর পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিলেন, যা সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী সরকারের আমলে পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে নিজেরদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচিত হয়ে দলকে পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেন। পরে নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করলেন-জাতীয় মুক্তি অর্জন ছাড়া বাঙালির পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করলেন। ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি। এই ছয় দফার মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা, একটি স্বতন্ত্র বাণিজ্য নীতি এবং পূর্ব পাকিস্তান মিলিশিয়া সংগঠন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এই যে ছয় দফা দাবি তুলে ধরা হয় প্রকৃতপক্ষে সেটিই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ।

এরপর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের আপসহীন সংগ্রামী ভূমিকা দলটিকে এই অঞ্চলের একক বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত করে। শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হন দলের অবিসংবাদিত নেতায়। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় লাভ করে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রধান রাজনৈতিক দল এবং বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির একক নেতা হয়ে উঠলেন।

এই বিশাল জয়ের পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তান সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিব ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নামে গণহত্যা চালায় তখন বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

পুরো বাঙালি জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে পুনর্গঠন করেন। মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষণমুক্ত-উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি নির্মাণ করে দিয়েছে।

পরে বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করলে দেশের অগ্রগতির পথ শ্লথ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর সামরিক শাসনের নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি।

এরপর দীর্ঘদিনের জন্য সামরিক সরকারের শাসনে চলে যায় বাংলাদেশ এবং বিরাট ছন্দপতন নেমে আসে আওয়ামী লীগে। ১৯৮১ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বেঁচে যাওয়া দুই মেয়ে দেশে ফেরেন। শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা ও ঐক্যের প্রতীক শেখ হাসিনা নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর আওয়ামী লীগের এই ছন্দপতন দূর হয়। পরে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে যে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তার অন্যতম শরিক হয় আওয়ামী লীগ। যুগপৎ আন্দোলনে স্বৈরশাসকের পতন হয়। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনা দলের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হতে থাকে। তবে ২০০১ সালের কারচুপির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হলে সেই অগ্রযাত্রা পুনরায় থেমে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে। ২০১৪ সালে দশম এবং ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয় জনগণের ভোটের মাধ্যমে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরপর তিন মেয়াদে বিশাল বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন দেশের উন্নয়নে। তার নিরলস পরিশ্রমের কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশ।

লেখক: কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এইচআর/ফারুক/এএসএম