রাজধানীর প্রতিটি সড়কের মোড়ে মোড়ে দেখা যায় হিজড়াদের। কখনো তারা সিগন্যালে বসে থাকা যাত্রীদের সামনে গিয়ে হাতে তালি বাজিয়ে টাকা আদায় করে। কখনো টাকা তুলতে হাজির হয় বিয়েবাড়িতে। আগে মানুষ খুশি হয়ে যা দিতো তা নিয়েই খুশি থাকতো হিজড়ারা। তবে এখন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের। এতে শারীরিক লাঞ্ছনা, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তবে জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। হিজড়ারা নয়, বরং অনেকে হিজড়া সেজে এই চাঁদাবাজি, লাঞ্ছনা, মাদক বাণিজ্য করছে। তাদের মদদ দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য। রাজধানীর গুলশান, বনানী, নিকেতন, সাতরাস্তা, মগবাজার, মধুবাগ, হাতিরঝিল, রমনা এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রায় ২০ জন হিজড়া। এই এলাকার হিজড়াদের সরদার বা গুরু হচ্ছে- স্বপ্না হিজড়া ওরফে খায়রুল। আর স্বপ্নার অধীনে কাজ করা প্রায় সিংহভাগ হিজড়াই পুরুষ। এদের মধ্যে কেউ কেউ অপারেশন করে হিজড়ায় রূপ নিয়েছে। মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিনা পরিশ্রমে অর্থ উপার্জনই তাদের মূল উদ্দেশ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বপ্না হিজড়ার আসল নাম মো. খায়রুল ইসলাম। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কাতিয়ার চড় গ্রামে। বর্তমানে ৬০২ নম্বর বড় মগবাজারের কামাল মিয়ার বাড়িতে থাকেন তিনি। হিজড়া রূপ ধারণের আগে তার পেশা কি ছিল তা জানা না গেলেও প্রায়ই সে কাকরাইল মসজিদে তবলীগ জামায়াতে অংশ নিতো। খায়রুলের দুই স্ত্রী রয়েছে। বড় স্ত্রীর নাম কোহিনুর বেগম। ১২ বছরের একটি মেয়েও রয়েছে তার ঘরে। কোহিনুর গ্রামের বাড়িতে থাকেন। খায়রুলের দ্বিতীয় স্ত্রী শাহনাজ। তিনি ঢাকায় খায়রুলের সঙ্গেই থাকেন। এই সংসারে একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।কিশোরগঞ্জে খায়রুলের অঢেল সম্পত্তি রয়েছে। মহাখালী ৭ তলা বস্তিতে রয়েছে খায়রুলের মাদক স্পট। বনানী থানা পুলিশ বিষয়টি জানলেও এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। খায়রুলের মগবাজারের বাড়িতে অসামাজিক কার্যকলাপ হয় বলেও এলাকাবাসী জানিয়েছে।গুলশান-বনানী এলাকায় সরকারদলীয় রাজনৈতিক সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অর্থপ্রদানসহ নানাভাবে সাহায্য করে খায়রুল। এলাকায় চাঁদাবাজিতে যেন কোনো বাধা বিপত্তি না আসে সেজন্যই বনানী-কাকলী এলাকার শ্রমিকলীগের সহ-সভাপতি উজ্জ্বলকে ৪০টি চেয়ার, এলসিডি টিভি, ফ্রিজ কিনে দেয়াসহ মাসিক চাঁদা দেয় সে। এলাকার ক্যাডারদের ১৭টি মোটরসাইকেলও কিনে দিয়েছে হিজড়ারূপী এই পুরুষ। ২০১৫ সালের মার্চে বাড্ডা ও বিশ্বরোড এলাকার গুরু পিংকী হিজড়াকে হত্যা চেষ্টায় খিলক্ষেত থানায় মামলা রয়েছে খায়রুলের বিরুদ্ধে। এছাড়া, বিভিন্ন অপরাধের কারণে বাড্ডা থানায় একটি মামলা (মামলা নং. ৮৩-২৭.০৪.২০১০) এবং গুলশান থানায় একটি জিডি (জিডি নং. ২৬২৪-৩০.০৫.২০১১) রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রয়েছে আসল হিজড়াদের নির্যাতনের অভিযোগও। খায়রুল ওরফে স্বপ্না হিজড়ার অধীনে থাকা ২০ জনের মধ্যে শুধুমাত্র ৩ জন প্রকৃত হিজড়া। এরা হচ্ছে ঝুমা, সরলা এবং হাসি। বাকিরা সবাই পুরুষ। এদের কয়েকজনের পুরুষত্বের প্রমাণ রয়েছে জাগো নিউজের কাছে। খায়রুল নিজ টাকায় অপারেশন করিয়ে তাদের হিজড়া বানায়। তাদের দিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে টাকা কালেকশন করানো হয়। গুলশান এলাকার হিজড়াদের ভাষ্য অনুযায়ী, কালেকশনের যে টাকা পাওয়া যায় এর মধ্যে ৫০ ভাগ নেয় গুরু খায়রুল, ৩০ ভাগ দেয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। বাকি ২০ ভাগ পায় হিজড়ারা। নকল হিজড়া হয়ে চাঁদাবাজি এবং আসল হিজড়াদের ওপর নির্যাতনের দায়ে কথিত স্বপ্না হিজড়ার বিরুদ্ধে হিজড়াদের একটি প্রতিনিধি দল ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দাখিল করে। একই অভিযোগ দাখিল করা হয় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বরাবর। তবে এগুলোর কোনোটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স এবং ডিএমপি। এবিষয়ে স্বপ্নার সাবেক শিষ্য ঝুমা হিজড়া (ছদ্মনাম) জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বপ্নার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা-জিডি থাকলেও পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্বপ্না বনানী থানা পুলিশের বেশ কয়েকজন অফিসারকে নিয়মিত টাকা দেয়। রাজনৈতিক নেতাদেরও টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে। স্বপ্নার বিরুদ্ধে প্রকৃত হিজড়ারা একটি মামলা করে (১৩৪৫/২০১৫)। তদন্ত অফিসার বনানী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বজলুর রহমান তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাদের কাছ থেকে তদন্তের খরচ বাবদ ৩৫ হাজার টাকা নিয়েছে। আর নকল হিজড়াদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করেন বনানী থানার পুলিশ সোর্স শহীদ।’ বনানী থানা পুলিশের সবচেয়ে পুরনো সোর্স শহীদ। তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্রবহন-ব্যবহার, হুমকি-ধামকি দিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে বনানীতে। নকল হিজড়াদের চাঁদাবাজি ও কুকর্মের বিষয়ে জানেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলাকায় নকল হিজড়া রয়েছে বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। অভিযান এখনো চলমান। আরো কাউকে পাওয়া গেলে আটক করা হবে।’ এঘটনায় দায়ের করা মামলাটির তদন্তের বিষয়ে ওসি সালাউদ্দিন বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে।’ নকল হিজড়াদের দৌরাত্ম নিয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘হিজড়াদের স্বার্থ নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে অমিল থাকলেই আসল নকলের প্রশ্ন তুলে তারা। নকল হিজড়াদের বিষয়ে সম্প্রতি পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ এসেছে। সেই প্রেক্ষিতে তদন্তও চলছে।’ এআর/একে/এমএস
Advertisement