পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। স্বপ্ন ছিল, সেই লক্ষ্যে প্রতীজ্ঞা ছিল সেই কারণেই নিজ অর্থায়নে দৃশ্যমান হলো দেশের আলোচিত এই সেতুটি। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। একদিকে প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণের জটিল প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে দেশের একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র, বিশ্বব্যাংকের তথ্য-উপাত্তবিহীন ও অনুমাননির্ভর ভ্রান্ত অভিযোগ এবং তার ফলে অর্থায়নের অনিশ্চয়তা পদ্মা সেতু নির্মাণের পদক্ষেপে জগদ্দল পাথরের মতো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল।
Advertisement
১৯৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে ৪ জুলাই ২০০১ তারিখে মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অসার ও কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ আর চূড়ান্ত অসহযোগিতার সমুচিত জবাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকের ভ্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের জবাবে বাংলাদেশ বলে দেয়, এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কোনো অর্থ ছাড় হয়নি।
অন্য কেউ অর্থ দেয়নি। দুর্নীতি হবে কীভাবে? তখন বিশ্বব্যাংক বলেছিল দুর্নীতির গভীর ষড়যন্ত্র হয়েছে। তারা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ না করেই ২০১২ সালের ২৯ জুন বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। ২০১২ সালের জুলাইয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে।
Advertisement
পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফেরার জন্য বিশ্বব্যাংককে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি মূল সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসে প্রথম স্প্যান। মাঝে ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া গেলে নকশা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। তাতে বাড়তি সময় লাগে প্রায় এক বছর।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছিলেন এদেশের মানুষের প্রতি। তার চ্যালেঞ্জ আর ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার বিজয় হয়। বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা অহমিকার পরাজয় ঘটে। পরে বিশ্বব্যাংক স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে তারা ভুল করেছিল।
২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কৌশিক বসু ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের যে ইতিহাস তাতে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যথেষ্ট তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থে কাজ করেছে। ১০ বছর আগেও কেউ ভাবতে পারেনি বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই তারা এটা করতে পারছে।
Advertisement
মূল পদ্মা সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সংযোগ সেতু ও সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। প্রকল্পে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও রেললাইনসহ দ্বিতল সেতুর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন কাজে ৯ হাজার ৪০০ কোটি, পুনর্বাসনে ১ হাজার ৫০০ কোটি, ২৭০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ২ হাজার ৭০০ কোটি ও ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ৬ লেন সংযোগ সড়ক নির্মাণে ১ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
এছাড়া পরামর্শক, সেনানিরাপত্তা, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও অন্যান্য ব্যয় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুতে ২৯৪টি পাইল রয়েছে। এসব পাইলের গড় গভীরতা ১২২ মিটার; যা ৪০ তলা ভবনের সমান। নদীর তলদেশের মাটির অবস্থা খারাপ হওয়ায় ২২টি পিলারেরর ৭১টি পাইলে স্কিন গ্রাউট করতে হয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে বৈদ্যুতিক বাতি রয়েছে ৪১৫টি।
পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা সেতু পার হতে চাইলে টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। কার ও জিপের জন্য ৭৫০ টাকা আর পিকআপের জন্য এক হাজার ২০০ টাকা দিতে হবে। মাইক্রোবাসে লাগবে এক হাজার ৩০০ টাকা। বাসের জন্য আসনের ভিত্তিতে তিন ধরনের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ছোট বাসে (৩১ আসন বা এর কম) এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা এর বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাসে (৩ এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে।
পণ্যবাহী বাহনের ক্ষেত্রে ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন) দুই হাজার ১০০, মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন) দুই হাজার ৮০০ এবং বড় ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রেইলারের ক্ষেত্রে টোল ছয় হাজার টাকা। এর বেশি এক্সেল হলে প্রতি এক্সেলের জন্য এক হাজার ৫০০ টাকা হারে টোল দিতে হবে। পদ্মা সেতুর টোল নিয়ে হয়েছে অনেক সমালোচনা। কিন্তু সময়ের কাছে সব ম্লান হয়ে যাবে। যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় অপচয় হতো, ক্ষতি হতো কাঁচামালের সেখানে সুদিন আসবে এটাই স্বাভাবিক।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতির স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে। অপেক্ষা কেবল উদ্বোধনের। আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনটি বিশ্বরেকর্ড গড়ে উদ্বোধনের অপেক্ষায়। খরস্রোতার দিক থেকে বিশ্বে আমাজনের পরই পদ্মা নদীর অবস্থান। পানিপ্রবাহের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে।
বাংলাদেশ যে পথ হারানোর নয় তা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল পদ্মা সেতু। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে এগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগও নেয়া সরকার। সরকারের এই মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
শুধু প্রকল্পই নয়, সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে শতকরা ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে। ২০২০-২১ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ছিল শতকরা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭০ টাকা, যা ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা, যা ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। সুতরাং বাংলাদেশ যে একটি উন্নয়নের মডেল হতে চলেছে তা বুঝতে দেরি নেই।
পদ্মা সেতু কেবল একটি নাম নয়, এটি একটি স্বপ্ন। যে স্বপ্ন এখন বাস্তব। এই সেতুকে ঘিরে মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। ওই দিন রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি সড়কপথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগের দ্বার উন্মোচিত হবে। গাড়ির চাকার সঙ্গে ঘুরবে অর্থনীতিরও চাকা। কাঙ্ক্ষিত এ সেতুর মাধ্যমে একদিকে যেমন দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হবে, ঠিক তেমনি এই সেতু ঘিরে ওই অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। রাজধানীতে যাতায়াতে সময় লাগবে আগের তুলনায় অর্ধেক।
পদ্মা সেতু আমাদের জাতির সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। বাংলাদেশ কতটা সক্ষম জাতিতে পরিণত হয়েছে তার উদাহরণ পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের কতটা আত্মবিশ্বাস রয়েছে দেখেছি পদ্মা সেতুতে। পদ্মা সেতু একটি ভিত্তিহীন অভিযোগের সময়োচিত জবাব। পদ্মা সেতু বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক। বাঙালি যে কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে করে না পদ্মা সেতু তারই তীব্র প্রতিবাদ।
লেখক: কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/এমএস